শর্ত মঞ্জুর হ্যায়? / The Lagaanology

ক্যাপ্টেন রাসেল স্থানীয় রাজামশাইকে পাশে দাড় করিয়ে ভুবনকে জিজ্ঞেস করলেন, “তিনগুনা লগান দোগে, ইয়ে শর্ত মঞ্জুর হ্যায়?” পিন ড্রপ সাইলেন্ট, সবাই অপেক্ষায়। ইস্পাত দৃঢ় দৃষ্টিতে চোখে চোখ রেখে উত্তর কি এসেছিল, তা সবাই আমরা জানি। সিনেমা হল ফেটে পড়েছিল সেই “শর্ত মঞ্জুর হ্যায়” সংলাপে। কিন্তু ভুবন সেই সংলাপ বলার ঠিক পরেই কি হয়েছিল, সেটা খেয়াল করেছিলেন কি? গ্রামবাসীরা সবাই একসাথে ভুবনকে বলেছিল, “পাগল হো গ্যায়া হো কা”, তারপর গরিব গ্রামবাসীরা ছুটছিল রাজার ঘোড়ার গাড়ির দিকে। নাহ্, রাজা ফিরেও তাকাননি, কিন্তু গরিব গ্রামবাসীরা ছোটা থামায়নি, সবাই ছুটছিল রাজার পিছু পিছু, আর ভুবন দাঁড়িয়েছিল একা। বঙ্গদেশের পরিস্থিতি অনেকটা এরকমই।

গত মাসের শেষে মুখ্যমন্ত্রীর করা মন্তব্যের পর, পঞ্চায়েত নির্বাচন যে আসন্ন, তা নিয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক মহলে জোর চর্চা শুরু হয়েছে। যদিও এই মুহূর্তে ঘটনার ঘনঘটায় জেরবার রাজ্যের শাসক দল, প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো নেতাকে ছুটতে হচ্ছে সিবিআই অথবা ইডির দপ্তরে। সেই ঘটনার তালিকায় চুরি-জোচ্চুরি, খুন-খারাপি থেকে শুরু করে তোলাবাজি, কাটমানি, গরু পাচার, কয়লা পাচার, কি নেই! এদিকে পাড়ায় পাড়ায় সিণ্ডিকেটরাজ তো একরকম প্রায় প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পেয়ে গেছে। কলকাতা এবং আশপাশের শহরতলিগুলোতে পুকুর বুজিয়ে, গাছ কেটে অথবা খেলার মাঠ হাফিস করে দিয়ে স্থানীয় নেতা-নেত্রীদের প্রত্যক্ষ মদতে, সরকারী নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চলছে দেদার বহুতল-মল-মাল্টিপ্লেক্স নির্মাণ। আর গ্রামাঞ্চলে যেখানে চট করে মিডিয়ার ক্যামেরা বা বুম পৌঁছবে না, সেখানে চলছে আরও বড় দাঁও মাড়বার ফন্দি ফিকির। কোথাও আস্ত একটা পাহাড় বেচে দেওয়া হচ্ছে, তো কোথাও আবার কেটে সাফ করে ফেলা হচ্ছে পুরো জঙ্গল। এভাবেই শহর থেকে গ্রাম, প্রায় সর্বত্র, নানবিধ অসামাজিক কাজকর্মের সাথে শাসকদলের সর্বস্তরের নেতারা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ায়, গুলি-গোলা খুন-জখম এখন আমাদের কাছে জলভাত হয়ে গেছে। কিন্তু তারপরেও গ্রাম বাংলার নির্বাচনে এখনো অবধি অ্যাডভান্টেজ শাসক দল। অনেকেই এই কথা শুনে ভ্রু কোঁচকালেও, এটাই বাস্তব। সৌজন্যে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের পকেটে টান, রাজ্যের শাসক দলের ভাতা নির্ভর রাজনীতি, কেন্দ্রের শাসক দলের ভাড়া নির্ভর রাজনীতি আর সঙ্গে প্রথম সারির মিডিয়ার ব্যবসানির্ভর তথ্য পরিবেশন।

খাতায় কলমে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল এখন ছত্রভঙ্গ, তাদের বর্তমানে না আছে ঢাল, না আছে তরোয়াল। একের পর এক নির্বাচনে তাদের শিবরাত্রির সলতে প্রায় নিভে গেলেও, রাজ্যে অবশিষ্ট একটু আগুন এখনও রয়ে গেছে, উত্তরবঙ্গের কিছু অংশে আর দুই মেদিনীপুর জেলায় যার ভরকেন্দ্র মূলতঃ তিনটি শহর, মেদিনীপুর সদর, খড়্গপুর এবং কাঁথি। এরমধ্যে উত্তরবঙ্গে তাদের হাতিয়ার হল মূলতঃ বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে বাংলাভাগের চক্রান্তে মদত দেওয়া। হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই শুনছেন! আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে, আমাদের রাজ্যের খাতায় কলমে যে দলটি প্রধান বিরোধী দলের তকমা পেয়েছে, তাদের একটা মূল অ্যাজেন্ডা হল আমাদের রাজ্যটাকেই ভেঙ্গে দু-তিন টুকরো করা। ভোট এলে স্বয়ং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাটার্ড ফ্লাইট উড়িয়ে এসে সেইসব বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সাথে প্রাতরাশ বা লাঞ্চ করে যান। কাজেই এরপর আমাদের আর কিছু বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

এবার আসা যাক মেদিনীপুর জেলার কথায়। সেখানে খড়্গপুর-মেদিনীপুর অঞ্চলে যে নেতার কারণে দলটির বাড়বাড়ন্ত, সেই নেতারই নানা সময়ে করা আলটপকা মন্তব্যের কারণেই যে বৃহত্তর বঙ্গীয় সমাজে দলটি ব্রাত্য থেকে গেছে, সেকথা তাঁদের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব দেরীতে হলেও বুঝতে পেরেছেন। মানে সহজপাঠ, বিদ্যাসাগরের লেখা থেকে শুরু করে রবি ঠাকুরকে ‘অল্পশিক্ষিত’ আর রামকৃষ্ণকে অশিক্ষিত বলে অলরেডি উনি প্রমাণ করে ছেড়েছেন, আর যাইহোক তিনি বাঙালী মেটিরিয়াল নন। যদিও তার দলীয় আনুগত্য এবং উদ্যমী লড়াকু রাজনৈতিক প্রচেষ্টায় কোন খামতি ছিল না। কিন্তু অনেকটা শাঁখের করাতের মতই সর্বভারতীয় নেতৃত্ব, সেই নেতাটিকে রাজ্য থেকে সরিয়ে দিল্লী নিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। আর তারফলে যথারীতি মেদিনীপুর ও খড়্গপুর শহরে কমতে শুরু করেছে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব।

আর মেদিনীপুর জেলার যে কাঁথি শহরের কথা বলা হচ্ছিল, তার এক এবং একমাত্র কারণ হল, নিও-হিন্দুত্বের অধিকারীরা এই শহরে থাকেন। বাড়ির নাম শান্তিকুঞ্জ। এই বাড়িরই মেজো ছেলে এই মুহুর্তে বিধানসভার বিরোধী দলনেতা। যদিও বছর দুয়েক আগেও তিনি ছিলেন বর্তমান শাসকদলেরই দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা। কিন্তু বিগত রাজ্য বিধানসভা ভোটের আগে অনেকের মতই দল পাল্টে, ভোল পাল্টে গেরুয়া শিবিরে ভিড়ে যান। বিধানসভা ভোটে নন্দীগ্রামের প্রেস্টিজ ফাইটে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে হারান। কিন্তু ব্যস, তারপর আর কোন সাফল্য নেই। বিগত পুরসভা ভোটে নিজের কাঁথি শহর ছেড়ে দিন, নিজের বাড়ির ওয়ার্ডে পর্যন্ত জিততে পারেননি। এমনকি আমরা যদ্দুর জানি, নিজেদের বাড়ির ওয়ার্ডের সব বুথগুলোতে এজেন্ট পর্যন্ত জোগাড় করতে পারেননি। ফলে ফলাফল সামনে আসতেই কাঁথি শহরে অধিকারীদের রাজনৈতিক এফিটাফ লেখা শুরু করে দিয়েছে রাজনৈতিক মহলের বড় অংশ। আর তাই অনেকটা অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই বাড়ির কর্তা তারপর থেকেই নিজের রাজনৈতিক অবস্থান খোলসা করে বলছেন না! তিনি শাসক শিবিরে না গেরুয়া শিবিরে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা জিইয়ে রেখেছেন। গতকালও শুনলাম তিনি সাংসদ হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দিতে দিল্লী পাড়ি দিয়েছেন এবং বলছেন ভোট প্রদান একটি গোপনীয় ব্যাপার কাজেই দ্রৌপদী মুর্মু না যশবন্ত সিনহা কাকে ভোট দেবেন, তা তিনি প্রকাশ্যে বলবেন না। যদিও এই দিল্লী যাত্রায় তাঁর সঙ্গী ছোটপুত্র স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন তিনি শাসকদলের টিকিটে জেতা সাংসদ, কাজেই গেরুয়া শিবিরের মুর্মু কে ভোট দেওয়ার প্রশ্নই নেই। মানে সব মিলিয়ে যা দাঁড়াচ্ছে, তা হল নিও-হিন্দুত্বের পোস্টারবয় তথা বিধানসভার বিরোধী দলনেতার বাড়ির লোকেরাই আর তাঁর সঙ্গে নেই! এর মধ্যে বাড়ির কর্তাটি তো আবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে গেরুয়া শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন! যে নেতা নিজের বাড়ির লোককেই নেতৃত্ব দিতে পারেন না, তিনি বিধানসভার মধ্যে বিরোধী স্বরকে কিভাবে তুলে ধরবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিলই! আড়ালে লোকে হাসি-ঠাট্টার ছলে বলাবলি করে, ওনাকে নাকি বিধানসভার থেকে রাজভবনের অলিন্দে বেশি দেখা যায়!

এদিকে মেদিনীপুর-খড়গপুর অঞ্চলের প্রভাবশালী নেতাটিকে দিল্লী পাঠিয়ে, তাঁর জায়গায় নতুন যাকে রাজ্য সভাপতি পদে বসানো হয়েছে, তিনি হলেন বর্তমান শাসকদলেরই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপক সংগঠনের প্রাক্তন নেতা। তাঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা নিয়ে ওনাদের দলের মধ্যেই হাজারো প্রশ্ন! ফলে শুরু হয়ে গেছে দলীয় কোন্দল! দলের একটা বড় অংশ ওনাকে মানতে নারাজ! তাদের বক্তব্য বিধানসভার মধ্যে দলের মুখ এবং রাজ্যস্তরে দলের মুখ দুজনেই প্রাক্তন ঘাসফুলী! এনাদের নিয়ে আদৌ কি ঘাসফুলের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব! কারণ সব কাঁটা দিয়ে যে ঘাসফুল কাঁটা তোলা যায় না, তা বিগত বিধানসভা ভোটেই স্পষ্ট! আর এমন দিশাহীন নেতৃত্বহীন অবস্থায় দিশাহারা হয়ে যেভাবে তাদের দলের লোকজন মুড়ি-মুড়কির মত শাসক দলে যাওয়ার জন্য লাইন লাগিয়েছে, তাতে ওই একই লাইনে শান্তিকুঞ্জের অধিকারীদের দেখতে পাওয়া আর অসম্ভব বলে মনে হচ্ছে না। যদিও এমন দল বদলানোর আগের মুহুর্ত পর্যন্ত চলবে পরস্পরের দিকে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, কিন্তু সবশেষে হেরে যাব আমরা, জিতে যাবে কাদা।

ফলে লগান সিনেমায় স্বদেশী রাজাকে দিয়ে যেমন বিদেশী ক্যাপ্টেন রাসেলের “লগান” আটকানো যায়নি, ক্রিকেট ম্যাচটা খেলতেই হয়েছিল, খেলে জিততেই হয়েছিল, আমাদের রাজ্যেও তেমনই এই বিরোধীদের পেছনে ঘুরেও আদৌ বিরোধী স্বর প্রতিষ্ঠা করা যাবে কি না, আমাদের কাছে তা স্পষ্ট নয়। তবুও মানুষ ছুটছে! কিন্তু ভুবন কই! পর পর ঐতিহাসিক ভুল করা দল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা কি পারবে ভুবন হতে! তারা ভুবনের মতই একলা ঠিকই, কিন্তু পারবে কি বাড়ি বাড়ি ঘুরে এগারোটা প্লেয়ার জোগাড় করতে! প্লেয়ার জোগাড় করতে হলে, কিন্তু ভুল করাটা বন্ধ করতে হবে। এদ্দিনের অভ্যাস পারবেন কি ছাড়তে! এই ঘনঘন ভুলের জন্যই তাদের এক সময়ের সমব্যাথীরা আজকাল সামান্য পান থেকে চুন খসলেই, দল ও দলীয় নেতৃত্বকে দেদার খিস্তি দেন, কিন্তু তারা রাজী হবেন কি খেলতে! মানুষ কি গ্যালারিতে ফিরবে তাদের খেলা দেখতে, সমর্থন দিতে! ৫% থেকে ১৫% যদিও হয়েছেন ভুবন কিন্তু এখনও মিসিং! মিসিং এগারোজন প্লেয়ারও! চার-পাঁচটা দেখতে পাচ্ছি বড় জোর! কাজেই এখনও ওঁদের অনেকটা পথ যেতে হবে।

আর তাই এই মুহুর্তে রাজ্যে কার্যত একটা বিরোধীশূন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি! আর এমন পরিস্থিতিতে যা হয় আর কি! স্বৈরাচার! পপুলিজম বা লোকরঞ্জনবাদ। চলতি ভাষায় পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি। এতে খরচা হয় দেদার, কিন্তু আখেরে সমস্যার সুরাহা হয় না। বাড়তে থাকে ঋণের বোঝা। রাজ্যের ঋণ পৌঁছে গেছে শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের কাছাকাছি। এটা শুনে যদি কেউ ভাবেন, ভারত খুব শীঘ্রই শ্রীলঙ্কা হতে চলেছে, তবে তিনি ১০০% ভুল ভাবছেন। যাই হোক, মহামারীর সময় থেকে অনেকে হারিয়েছেন কাজ, মানুষের জীবনে নেমেছে নানান প্রতিবন্ধকতা, যার মধ্যে অন্যতম মূল্যবৃদ্ধি আর আয়ের অনিশ্চয়তা। দিনের পর দিন রাজ্যের ওয়ার্কফোর্স নষ্ট হয়েছে, ম্যানপাওয়ার নষ্ট হয়েছে, শ্রমিকদের সুলভ থেকে সুলভতর করা হয়েছে, যাতে তাদের ওপর টুক করে চেপে বসা যায়। আর হয়েছে সেটাই, ১২ ঘন্টা কাজের শ্রম আইন চালু হলেও নীরবে তা মেনে নিয়েছে প্রায় সবাই, পেটের দায়ে। কারণ, প্রতিবাদ করলে তো কাজটাই থাকবে না। আর বিকল্প কাজ কোথায়? সে তো নেই, দিনের পর দিন রাস্তায় বসে আন্দোলন করে চলেছে শিক্ষিত বেকার ছেলে মেয়েরা। সরকারেরও কোন পদক্ষেপ নেই, কারণ তারা জানে, কয়দিন পর এরাও কেউ থাকবে না। গ্রামের পর গ্রাম শিক্ষক নেই, পড়াশুনা নেই, তাহলে চাকরি চাইবে কে? কেউ না। তাই মাননীয়া ভরা সভায় আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে পারেন, তার দল না করলে সরকারি প্রকল্পের সুযোগ সুবিধা পাবেন না। নাহ্, কিছু বলা যাবে না, কারণ মাননীয়াকে সারের দাম বাড়ছে কেন প্রশ্ন করায়, এক নিরীহ গ্রামবাসীর কি অবস্থা হয়েছিল, তা সবার জানা। তাই বলে কি উপায় নেই। এটাই কি দস্তুর হয়ে গেছে এই বাংলায়।

নাহ্, চাপে কিন্তু মাননীয়া তার কার্যকালে সবাইকে রাখতে পারেননি। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তাররা সম্ভবত প্রথম এমন কিছু করেছিলেন, তাতে উনি ভালই অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। প্রথমাবস্থায় আলটিমেটাম দিলেও, জুনিয়র থেকে সিনিয়র ডাক্তারদের পরের পর পদত্যাগ, রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার জোগাড় হতেই, উনি পিছু হাটেন, মেনে নেন তাদের দাবি। ডাক্তাররা পেরেছিলেন, কারণ তারা দুর্লভ, শ্রমিক-কৃষক-সাধারণ কর্মচারীদের মত সুলভ নন। সুলভ হলেই সমস্যার শুরু, আর আমাদের রাজ্যে শ্রমিকরা ঠিক কতটা সুলভ হয়ে গেছে, তা কয়েকদিন আগের পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট।

আরবিআই-এর সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে কেরালায় নির্মাণ শ্রমিকের নূন্যতম আয় দৈনিক ৮২৯.৭০ টাকা আর পশ্চিমবঙ্গে সেটাই ৩০৮.২০ টাকা, অর্ধেকেরও কম, আর ত্রিপুরায় সেটা আরো কম, মাত্র ২৫০ টাকা। আবার কৃষি শ্রমিকদের মজুরি যেখানে কেরালায় দৈনিক ৭০৬.৫০ টাকা, গুজরাতে সেটাই ২১৩.১০ টাকা। তাহলে কেন বাংলা থেকে দলে দলে ছেলে মেয়েরা ভিন রাজ্যে পারি দেবে না? এই রাজ্যে তো ইনকামটাই নেই। অন্তত আরবিআই-এর রিপোর্ট তেমনই বলছে। এটাকে কেউ চক্রান্ত বললে, কি আর বলা যাবে!

আর দুর্নীতি, তা নিয়ে আর বিশেষ কিছু বললাম না। এটা খোলা বইয়ের মত সবার কাছে স্পষ্ট হলেও, তার বিরোধিতা করতে মানুষের ঠিক সাহস হচ্ছে না। জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা থেকে আইন রক্ষক দ্বারা ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার অভিযোগ, সবই রমরমিয়ে চলছে এই বাংলায়।

মানুষের হাতে কাজ নেই, মার্কেটে চাকরি নেই, স্কুলে মাস্টার নেই, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডাক্তার নেই, চাকরি পাওয়ার জন্য ঘুষ দেওয়ার টাকা নেই, শুধু আছে ভাতা। ওটাই ভরসা। প্রতিদিন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম চড়চড় করে বাড়ছে। বিদেশের থেকে ৫০.৭৫ টাকায় আমদানি হওয়া খনিজ তেল থেকে তৈরি পেট্রল বিক্রি হচ্ছে ১০৬ টাকায়, যাকে বলা যেতে পারে দোগুনা লগান। আবার রায়গঞ্জে আলু চাষ করে ১১০০ টাকা কুইন্টাল (১০০ কেজি) চাষিরা পেলে, আলু কলকাতায় বিক্রি হয়েছে ৩০ টাকা কিলো দরে, যেটা প্রায় তিনগুনা লগান। এতেই শেষ নয়, চেন্নাইতে যে কেরোসিন ১৫ টাকা লিটারে পাওয়া যায়, সেটাই কলকাতায় ১০১ টাকা, প্রায় সাতগুনা লগান। কথায় আছে সাত খুন মাফ, তাহলে দোষ আর কাকেই বা দেওয়া যায়! তার ওপর মাননীয়া এবং তার ভাবশিষ্যরা যখন ওপেন স্টেজে বলছেন, তাদের দল না করলে কোন সুযোগ সুবিধা পাবেন না। তখন তাদের দল করাই শ্রেয়, উটকো ঝামেলায় কে আর পড়তে চায়। যদিও আমাদের এই স্পিকটি নট অভ্যাসের সুযোগ নিতে কেন্দ্রীয় সরকারও ছাড়ছে না। আজ থেকে প্যাকেটে মোরা মুড়ি, আটা, ডাল, চাল, দই, দুধ ইত্যাদি একগুচ্ছ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের ওপর ৫% হারে নতুন লগান আজ থেকে লাগিয়ে দিল কেন্দ্রীয় সরকার। এমনকি আইসিইউ বাদে দৈনিক পাঁচ হাজার টাকার বেশি দামের হাসপাতালের শয্যা পরিষেবা বা ব্যাঙ্কের চেকবুকেও লাগল নতুন লগান যথাক্রমে ৫% ও ১৮% হারে। ছাপার কালি, পেন্সিল কাটবার ব্লেড ইত্যাদি লেখাপড়ার সাথে সম্পর্কযুক্ত জিনিষের ওপরও নতুন লগান লাগানো হল ১৮% হারে যা আগে ছিল ১২%।

একদিকে এভাবেই দিনদিন খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকবার খরচা বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে রাজ্যে ওয়ার্কফোর্স প্রায় ধ্বংস হওয়ার মুখে। ফলে মানুষ ভাতা নির্ভর হতে বাধ্য হচ্ছেন। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার থেকে দুয়ারে সরকার প্রকল্পের ক্যাম্পের লাইন। সত্যিই যদি সরকার মানুষকে স্বনির্ভর বানাতে পারত, তবে এই সব ক্যাম্পে কেবল অল্পকিছু প্রান্তিক মানুষেরই দেখা পাওয়া যেত, এটা সত্যিই তাদের প্রয়োজন। কিন্তু, আজ মানুষ স্বনির্ভর হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে না বলেই, এই ক্যাম্পে তাদের দলে দলে যেতে হচ্ছে। তাদের তো কোনো দোষ নেই, কি করবে তারা।

এখন আবার গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় শুরু হয়েছে আরেক সিস্টেম, অনেক জায়গায় ৫ দিনের কাজ পেলে, জব কার্ডে লেখা হবে ২০ দিন। যিনি কাজ করেন, তিনি পাবেন ১০ দিনের টাকা আর শাসক দলের নেতা নেবেন বাকি ১০ দিনের টাকা। উপায় নেই, কারণ কেস খেলে, খাবে তো গরিব মানুষটাই, কারণ এ রাজ্যে ছোট বড় নেতাদের জন্যে তো কলকাতার হাসপাতালে সংরক্ষিত ওয়ার্ড আছেই, সাথে আইন আছে, আদালত আছে, সাথে আছে বিশেষ আশীর্বাদ, তাই সাধারণ মানুষকে মুখ বুজেই থাকতে হবে। একদম গ্রাউন্ড লেভেলই সমস্যা, আটকাবেন কিভাবে!

তবে একা নেতায় রক্ষা নেই, মানি মার্কেটিং কোম্পানিগুলো দোসর। গ্রামাঞ্চলে মানি মার্কেটিং কোম্পানিগুলো চড়া সুদে মহিলাদের লোন দিয়ে এখন ব‍্যবসা করছে। গ্রাম বাংলার অনেক মহিলাই হাজার হাজার টাকার ঋণগ্রস্থ। এরা নিজেরাও জানেন না এরা কত শতাংশ সুদ দেন। এরা এটাও জানেন না এই মানি মার্কেটিং কোম্পানিগুলো কার মদতে টাকা তুলছে। কারণ, খিদে পেটে তা জানার ইচ্ছে কারোরই তেমন থাকে না, তাই জন্যেই একসময় সঞ্চয়িতা, সারদা, রোজ ভ্যালি চুটিয়ে ব্যবসা করেছিল গ্রামে গ্রামে। আর এখন আরেক দলের আবির্ভাব হয়েছে মানি মার্কেটিং কোম্পানির ছদ্মবেশে। আশা করব, এমন কোন দিন আর যেন এই গরিব মানুষের জীবনে নেমে আসে, যেখানে মাননীয়াকে আবার না বলতে হয়, “যা গেছে তা যাক।”

এখন অনেক মহিলাই প্রত্যন্ত গ্রামে দু-তিনটে করে লোন চালায়। যা আয় করেন, লোন দিতে দিতেই শেষ। সঞ্চয় নেই। এমনও অনেকে আছেন যারা, লোন করে দোতলা বাড়ি করেছেন, কিন্তু ইলেকট্রিক বিল দিতে পারেননি। ফলস্বরূপ, বিদ্যুৎ দফতর লাইন কেটে দিয়ে গেছে। এমন ঘটনা আকছার হচ্ছে এই বাংলায়, কিন্তু অনুপ্রাণিত কলকাতামুখী এবং গ্রামবিমুখ সংবাদমাধ্যম “পজিটিভ নিউজ” করার তাড়নায়, এসব খবর করে না। করবেটাই বা কি করে, একটা খবরের কাগজ ছাপাতে এখন ১৫-২০ টাকা খরচ পড়ে, সেই টাকা দিয়ে তো আপনারা খবরের কাগজ পড়েন না। তাই বর্ধিত টাকাটার জোগান পেতে বিজ্ঞাপন নির্ভর হয়ে থাকতেই তো হয়, ওদের আর কি দোষ। তাই কেন্দ্রের শাসক দলের সেইভাবে কোনও সংগঠন না থাকলেও, তাদের শরীরচর্চার খবরটাও খবরের কাগজে টুকুস করে রোজ রোজ চলে আসে, ২০১৯ থেকে ১৮টা সাংসদ নিয়ে, এই বাংলায় একটা ইট না গেঁথেও তাদের সারাক্ষণ টিভির পর্দায় দেখানো হয়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর আক্রমন দেখলে, শান্তিপুর গিয়ে গর্বের সাথে এনারা বলতে পারেন, এবার আমরা উপনির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতব। শাসক হোক বা প্রধান বিরোধী, গদিটাই তাদের কাছে সব। যেমন ছিল “লগান” ছবিতে ক্যাপ্টেন রাসেল অথবা রাজামশাইয়ের। চুলোয় যাক গ্রামের মানুষ। তাহলে কি আশার আলো নেই!

আছে, গ্রামে গ্রামে ভুবনরা আওয়াজ তুলতে শুরু করেছে, সে দেউচা-পাঁচামি হোক বা হোক চোপড়া, মানুষ বলছে, প্রতিবাদ করছে, অন্যায়ের বিরোধিতা করছে। তাদের আর দোষ কোথায়, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তো উঠে দাঁড়াতেই হয়।

দোষ তাহলে কাদের?

আমাদের, রাইজ অফ ভয়েসেসের। কারণ গালভরা নাম দিলেও আমরা পারছি না সেই সব ভুবনদেরকে কন্ঠ দিতে! প্রতিটা গ্রামের ভুবনদের লড়াইয়ের পাশে সেভাবে থাকতে! যদিও চেষ্টার খামতি রাখছি না। কারণ জানি, একদিন এই ভুবনদের সাথেই সারা গ্রাম মাতবে। শুধু মেজাজটা ফিরে আসার অপেক্ষা।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস