এ খেলা কি যে ঠ্যালা / The Game Is On
লোকসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর পর থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির ধূ-ধূ করছে, খালি মাঠে এখন বাস্তবিকই ঘু-ঘু চড়ছে। চারিদিকে অপার নীরবতা। এক পাশে গাছতলার ছায়ায় দাঁড়িয়ে শুভেন্দু অধিকারী-মহম্মদ সেলিমরা শান্ত অলস গরু-ছাগলের তৃতীয় সন্তানের মত রাজ্য জুড়ে বিগত এক দশক ধরে ঘটে চলা সীমাহীন দুর্নীতি ও বিপন্ন আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে নিয়ম মাফিক জাবর কাটলেও, সেদিকে আম জনতার খুব একটা নজর নেই। রাজভবনের কালো চশমা পড়া বড়লাটও চেষ্টা করছেন শান্ত পুকুরে ঢিল ছুঁড়ে তরঙ্গ আনতে, কিন্তু শাসকদলের কাছ থেকে পাল্টা ‘আধলা ইঁট’ খেয়ে তিনিও ঘরে ঢুকে গেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে নারী নিগ্রহের একাধিক অভিযোগের তথ্য ও প্রমাণ নাকি শাসকদলের সুপ্রিমোর টেবিলে মজুত আছে, এমনটাই বাজারে শোনা যাচ্ছে। মানে সোজা কথায় শাসক তৃণমূল বেড়ালের গলায় ঘন্টা না বেঁধে জল ছিটিয়ে দিয়েছে। আর তাতেই কার্যসিদ্ধি হয়ে গেছে।
বিজেপি একসময় বেশ জমিয়ে খেলছিল, কিন্তু পর পর নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর এখন তাদের দৌড়টা বেশ মন্থর হয়ে গেছে। আসলে অজস্র তারিখ পে তারিখ পেরিয়ে গেছে, কিন্তু তা সে সারদা-নারদা কেলেঙ্কারি হোক, অথবা নিয়োগ দুর্নীতি-কয়লা পাচার বা গরু পাচারই হোক, তথাকথিত চৌকিদারের অধীনস্থ কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা কোন ক্ষেত্রেই আসল ‘মাথা’ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। আসলে ‘পারেনি’ নাকি ‘চায়নি’ সেটা নিয়েও জনতা যথেষ্ট সন্দিহান। দিদি-মোদি “সেটিং” যে একটা আছে সেটা যত সময় গড়াচ্ছে জনতার মনে ধীরে ধীরে গেঁথে বসতে শুরু করেছে। আসলে জনতা জানে দুর্নীতি হয়েছে, এবং তা একটা-দুটো নয়, হয়েছে ভুড়িভুড়ি। জনতা এও জানে, এইসব দুর্নীতির মাথার টিকি বাঁধা আছে কালীঘাটে। অথচ বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও জনতা দেখছে সেই আসল মাথারা দিব্যি বুক ফুলিয়ে কলার তুলে নাকের ডগায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। খবরের কাগজ-টিভির হেডলাইন হচ্ছে। ফলে বঙ্গ জনমানসে এই সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ে রাজ্য বিজেপি নেতাদের দৈনিক আস্ফালনের বিশ্বাসযোগ্যতা ধাক্কা খাচ্ছে। মাঝে একশ্রেণীর বিজেপি নেতা ও তাদের ভাড়া করা সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সাররা ‘ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স’ (FATF) নামক এক আন্তর্জাতিক সংস্থার ধুয়ো তুলে দাবী করেছিল মানি লন্ডারিং এর কেসে ভাইপো জেলে গেল বলে! সেটাও যে নিছক অসাড় গপ্পো ছিল তা আজ প্রমাণিত। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে দিই এই FATF হলো প্রায় ৩৫ বছরের পুরোনো একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা যারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ঘটে চলা মানি লন্ডারিং এর ঘটনার গতি প্রকৃতি এবং তার বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট সেই দেশ কি কি ব্যবস্থা নিয়েছে তার ওপর নজরদারি চালায়। কোনো দেশ যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে না, এমনটা নজরে এলে FATF তাদেরকে ধূসর বা কালো তালিকাভুক্ত করে দেয়। ফলে আন্তর্জাতিক মঞ্চে সেই দেশের আর্থিক ব্যবস্থার ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখে তো পড়েই, এমনকি বিদেশী ঋণ মেতেও সমস্যা হয়। বিজেপি নেতা ও বিজেপিপন্থীদের দাবী ছিল দেশের ভাবমূর্তি বাঁচাতেই নাকি কেন্দ্রীয় সরকার অভিষেক বন্দ্যোপাধায়কে মানি লন্ডারিং কেসে জেলে ঢোকাবে। কিন্তু তাদের যেটা জানা জরুরি তা হলো ভারত ২০১০ সাল থেকে FATF এর সদস্য। আর চিটফান্ড বা নারদা আর্থিক কেলেঙ্কারি তারও অনেক পর সামনে এসেছে এবং এই সমস্ত কেলেঙ্কারির মূল সন্দেহভাজনদের অনেকেই জেলে না ঢুকে দলে মানে বিজেপিতে ঢুকেছে। শুধু তাই নয়, তাদের একজন বিজেপির সর্ব ভারতীয় সহ সভাপতি পর্যন্ত হয়েছিলেন এবং অপরজন এই মুহুর্তে বঙ্গ বিজেপির এক নম্বর নেতা। কাজেই পিস-ভাইপো গ্রেপ্তার হওয়ার ভুসি গপ্পো ছড়িয়ে বেশিদিন চলে না। আর সেটাই এবার লোকসভা ভোটের ফলাফলেও প্রমাণিত। এমনকি আরেকটু হলে তথাকথিত কাঁথি-তমলুকের অধিকারীগড় তৃণমূলের কাছে হাতছাড়া হতে বসেছিল। অবশ্য রাজনীতির নামে সারাক্ষণ হিন্দু-মুসলিম তরজা, কৃষি আইন আর সিএএ -এনআরসি নিয়ে জাতীয়তাবাদের মোড়কে রাজনৈতিক হুমকি এবং তার সাথে একশ্রেণীর প্রথমসারির সংবাদমাধ্যমের বিজেপির হয়ে নির্লজ্জ দালালিও আম জনতার বিরক্তি উৎপাদনের বড় কারণ বলে আমাদের মনে হয়েছে।
অন্যদিকে, বঙ্গের পুরোনো শাসক দল, মানে বামেরা নবীনদের কাঁধে ভর করে আবার নতুন উদ্যমে মাঠে নামলেও, ভোটবাক্সে তার প্রতিফলন নেই। জনতা জনার্দন যে তাদেরকে এখনও খুব একটা ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না, তা গত লোকসভা ভোটের ফলাফলেই স্পষ্ট। কেন আনছে না, তা নিয়ে আমাদের প্রতিবেদন ‘বামরোগ’ আগেই লেখা হয়ে গেছে। চাইলে পড়তে পারেন। তবে বাম জনতার কাছে যেটা তার থেকেও বেশি আশঙ্কার তা হলো, যে উদ্যম নিয়ে মীনাক্ষী বাহিনী ভোটের আগে ময়দানে নেমেছিল, লোকসভা ভোটের হতাশাজনক ফলাফল সামনে আসতেই তার ছিঁটেফোটাও আর দেখা যাচ্ছে না। ভোটের ঠিক আগে আগে এরা রুটি-রুজি-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মত ইস্যুকে সামনে রেখে কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই শাসককে দুবেলা আক্রমণ করতো, অথচ ভোটের ঠিক পরপরই কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নিট কেলেঙ্কারি আর রাজ্যের তৃণমূল সরকারের হকার উচ্ছেদের মত দুটো হাতে গরম ইস্যু সামনে এলেও, সেভাবে মীনাক্ষীদেরকে মাঠে দেখা গেল না, যদিও ইস্যু দুটির প্রথমটি শিক্ষা ও দ্বিতীয়টী রুটি-রুজির সাথে জড়িত। উলটে ফলাফল পর্যালোচনার নামে এই মুহুর্তে প্রধান বাম দল সিপিআই(এম)র মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে নবীব-প্রবীন দ্বন্দ্ব। বাম নেতাদের বুঝতে হবে নবীন হোক বা প্রবীণ, রোজকার লড়াইতে ময়দানে না থাকলে ন্যারেটিভ তৈরি হয় না, আর ন্যারেটিভ না থাকলে সবাই শূন্য। কর্মসূচী ভিত্তিক দাবি-দাওয়ার মিছিল-আন্দোলন সরিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের চাহিদা ও প্রতিক্রিয়া বুঝে তাৎক্ষনিক আপদকালীন লড়াইতে মানুষকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের নিজেদের স্বপক্ষে ন্যারেটিভ তৈরি করতে হবে। কাজটা কঠিন, কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। তা না হলে তাদের এই ‘শূন্য দশা’ ঘুচবে না। তাছাড়া কথায় কথায় ডেপুটেশন দেওয়ার রোগটাও ছাড়তে হবে। একটা আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত সরকার ও তার প্রশাসনকে মিটিং মিছিল করে দাবি সনদ পেশ করে লাভ যে খুব একটা হয় না সেটা ১৩ বছরের অভিজ্ঞতার নিরিখে এখনও না বুঝলে সেটাকে অপদার্থতা হিসেবেই দেখতে হবে। বাম আমলে তৎকালীন বিরোধীনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকার বা পুলিশ প্রশাসনের কাছে ডেপুটেশান দিচ্ছে এমন কোন ছবি কি আছে আদৌ! থাকলে দিন, আর না থাকলে বুঝুন তফাৎটা কোথায় ? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী নেত্রী হলে এদ্দিনে রাজ্যজুড়ে হুলস্থূলু লাগিয়ে দিতেন ! আজ রাজ্যের বিরোধী দল গুলোর বিশেষত বামেদের ভূমিকা তার সামনে নিতান্তই ম্লান।
আর মূলতঃ বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের এই অপদার্থতা আর আগোছালো অবস্থার কারণেই এই মুহুর্তে বঙ্গ রাজনীতি কার্যত বিরোধীহীন জগদ্দল পাথরের মত বঙ্গবাসীর বুকের ওপর চেপে বসেছে। ‘খেলা হবে’র নামে সেই পাথর ঠেলেই বঙ্গবাসীকে প্রতিদিন বাঁচতে হচ্ছে। এই ‘পাথর ঠ্যালা’র খেলা কদ্দিন চলবে বা আদৌ শেষ হবে কি না এখনই সেভাবে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না। শুধু আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস যা দেখতে পাচ্ছি তা হলো – “দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বাংলা ‘পিসি’ময়/ জনতার মনে শুধু নীল-সাদা চটি।”
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
Snehangshu Ghosal
নিচু তলার বাম সেটিংবাজদের কর্পোরেট স্টাইলে খাতা ভরানো “মিনিটস” সর্বস্বতা শেষ করে দিয়েছে সি পি আই এম কে।।জনগণের সঙ্গে কোন যোগাযোগই নেই পার্টির।।
গতকালের নির্বাচনে সিপি আই এম আবারও মমতার সরকারকে সহযোগিতা করেছে।চূড়ান্ত রিগিং হলেও কোত্থাও প্রার্থীকে প্রত্যাহার বা অন্যকিছু প্রতিবাদ দেখা যায়নি।ফসিল হবার অপেক্ষা শুধু।