আইন আইনের পথে, সেটিং সেটিংয়ের পথে / Professionalism

মুকুল রোহতাগি। নামটা শোনা শোনা লাগছে কি? ইনি হলেন সুপ্রিমকোর্টের একজন প্রথিতযশা দুঁদে আইনজীবী। কিন্তু আমরা হলাম গিয়ে পারতপক্ষে আইন-আদালত মারাতে না চাওয়া জনতা। জেলা আদালত থেকেই যেখানে আমরা শত হস্ত দূরে থাকতে চাই, সেখানে সুপ্রিম কোর্ট তো অনেক দূরের কথা, একে কষ্ট কল্পনাই বলা চলে। তাহলে যতই দুঁদে হোন না কেন, সেখানকার এক আইনজীবীর নামটা এত শোনা শোনা লাগছে কেন!   

আসলে ইনি হলেন কেন্দ্রের মোদি সরকারের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল। ২০১৪ থেকে ২০১৭-এই সুদীর্ঘ তিন বছর তিনি ছিলেন দেশের চিফ ল অফিসার। ফলে সেই সময় খবরের কাগজের প্রথম পাতায় প্রায়ই তার নাম ছাপা হত। বিভিন্ন বৈদ্যুতিন চ্যানেলগুলোতে চর্চা হত তাঁকে নিয়ে।

কিন্তু তারপর সুদীর্ঘ ৫-৬ বছর ধরে তিনি আর সেই পদে নেই। ফলে খবরের চর্চায় তেমন আসেন না। ফলে দুর্বল স্মৃতিশক্তির আম জনতা ভুলে গেছেন তাঁর কথা। নামটা একটু চেনা চেনা ঠেকে এই যা! আর তাই রাইজ অফ ভয়েসেস আপনাদেরকে একটু মনে করিয়ে দিল!

কিন্তু কেন মনে করিয়ে দিল! হঠাৎ কথা নেই বার্তা নেই মুকুল রোহতাগিকে নিয়ে পড়লো কেন রাইজ অফ ভয়েসেস!

কারণ, মিঃ রোহতাগি সম্প্রতি বিগত এক মাসের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে দু-দুবার চাকরিহারা অযোগ্যদের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সওয়াল করেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম সুপ্রিম কোর্টে গত মার্চ মাসের একদম শেষদিকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের টিভিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গটি সুপ্রিম কোর্টের সামনে আনেন এবং কার্যত ওনার এজলাস থেকে যাতে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাগুলি সরিয়ে নেওয়া হয়, তার জন্যে সওয়াল করেন। কার্যত এই সওয়াল থেকে ‘কিউ’ নিয়েই তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওঠা কয়লা পাচার মামলায় সওয়াল করতে গিয়ে কংগ্রেস নেতা তথা আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভি ফের টিভি সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গটি ফের তোলেন। বার বার এভাবে সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গটি ওঠায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের থেকে এই প্রসঙ্গে হলফনামা চেয়ে পাঠান। আর তাতেই শাসক তৃণমূল শিবিরে উল্লাস পরিলক্ষিত হয়। কারণ মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের একের পর এক সাহসী দ্রুত শুনানি ও নির্দেশের কারণেই এক প্রকার বাধ্য হয়ে সিবিআই/ইডি স্কুলে নিয়োগ দুর্নীতি মামলার তদন্ত দ্রুততার সাথে করতে থাকে, আর তাতেই গ্রেপ্তার হতে থাকে তৃণমূল কংগ্রেসের একের পর এক  কেষ্টবিষ্টুরা। দেশে আইনের শাসন বলে কিছু অবশিষ্ট আছে এখনও, এমনটাই মনে করতে শুরু করে বাংলার মানুষ। তাদের অনে আশা জাগে আসল রাঘব-বোয়ালদের ধরা পড়া এবার শুধু সময়ের ব্যাপার! আর ঠিক তখনই সেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে শাসকদলকে বাঁচাতে আসরে বিজেপি ঘনিষ্ঠ রোহতাগি। একদম মামলা থেকেই বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল।

অবশ্য এখানেই তিনি থেমে থাকলেন কই! বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের একের পর এক নির্দেশে যে সমস্ত তৃণমূলের কেষ্টবিষ্টুরা জেল খাটছেন তাদেরকে জেল থেকে বার করতে হবে তো! কাজেই এবার তিনি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এদ্দিন ধরে দিয়ে আসা সেই সব নির্দেশ বা অর্ডারগুলো নিয়েই সুপ্রিমকোর্টে প্রশ্ন তুলে দিলেন! মানে মিঃ রোহতাগি যা বললেন তা সহজ ভাষায় বললে দাঁড়ায়, মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের হলফনামা পড়ে যদি তাঁকে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলা থেকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন, তাহলে সেক্ষেত্রে তাঁর দেওয়া এই সংক্রান্ত নির্দেশগুলোও বাতিল করতে হবে! মানে সোজা কথায় তৃণমূল থাকুক, নিজেদের মত চুরি-চিটিংবাজি করে! বেশি বিচার-ফিচার করতে গেলে বিচারপতিকেই ট্রান্সফার করে দেব আর তার দেওয়া নির্দেশগুলো বাতিল করে ফের ক্লিন স্লেট বানিয়ে দেব যাতে তৃণমূল ইচ্ছেমত নবজোয়ার তুলতে পারে!   

স্বভাবতই বাংলা জুড়ে বহু মানুষের কপালে ভ্রুকুঞ্চন! ‘খেলা হবে’র আসল খেলা কি তবে শুরু হয়ে গেলো! একজন বিজেপি ঘনিষ্ঠ দুঁদে আইনজীবী কি নিছকই পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকে চাকরিহারা অযোগ্যদের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে লড়ছেন! আইনজীবী হিসেবে তাঁর বিপুল সাম্মানিক বহন করবার ক্ষমতা আদৌ কি সরকারী স্কুলের চাকরিহারা অযোগ্য স্কুল শিক্ষক/শিক্ষাকর্মীদের আছে! নাকি পেছনে অন্যকেউ! কোন বিশেষ প্রতিপত্তিশালীদের নির্দেশে ও অঙ্গুলিহেলনেই রোহতাগির এমন দায়িত্বপালন! কারণ ঘুস দিয়ে চাকরি পাওয়া অযোগ্যদের চাকরিতে পুনর্বহাল মানে শাসক তৃণমূলের রাজনৈতিক জয়। কাজেই প্রশ্নটা কিন্তু উঠবে, তা সে মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম যতই কভার-আপ করবার চেষ্টা করুক!

একই প্রশ্ন থাকছে কংগ্রেস নেতা ও দুঁদে আইনজীবী অভিষেক মনু সিংভির জন্যেও যিনি একের পর এক দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের হয়ে সুপ্রিম কোর্টে সওয়াল করতে ব্যস্ত! কংগ্রেস হাইকম্যান্ড কি তবে ২০২৪এ যে কোন শর্তে যে কোন মুহুর্তে মমতার দিকে ঝুঁকে যাওয়ার পথ খোলা রাখলেন!  

তৃণমূল নামক একটি আপাদমস্তক দুর্নীতিতে যুক্ত দক্ষিণপন্থী দলকে বাঁচাতে, তাদেরকে রাজনৈতিক অক্সিজেন জোগাতে তবে কি বিজেপি-কংগ্রেসের মত দেশের বাকি দক্ষিণপন্থী দলগুলো হাত মিলিয়ে ফেললো! এতো আইন আইনের পথে চলবে বলে চিৎকার চলছে একদিকে, আর পেছনে সেটিং চলছে সেটিংয়ের পথে।  

এপ্রসঙ্গে বলে রাখি, বামপন্থী সাংসদ ও বিশিষ্ট আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য্যও বলেছেন তিনিও অযোগ্য ঘুষ দিয়ে চাকরি পাওয়াদের হয়ে মামলা লড়বেন। তবে যদ্দুর জানি তিনি বলেছেন, ঐ সমস্ত চাকরিহারা অযোগ্যরা যদি ঘুষের টাকা আদায় করবার জন্য মামলা করেন, তবে তিনি তাঁদের হয়ে মামলা লড়বেন। কিন্তু তাদের হারানো চাকরি পুনরুদ্ধারের জন্য বা তাদের চাকরিতে পুনর্বহাল করবার জন্য কোন মামলায় তিনি অংশ নেবেন না। যদি তিনি নেন তাহলে তাঁকেও রোহতাগি-সিংভিদের দলে ফেলে দিতে আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস দ্বিধা করব না।

আম জনতার কথা বলবে রাইজ অফ ভয়েসেস। রাজনৈতিক রং না দেখে।

ভালো থাকবেন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস


 
তথ্যসূত্র
a) https://news8plus.com/supreme-court-demand-for-issuance-of-rule-against-justice-ganguly-in-supreme-court-justice-abhijit-ganguly-supreme-court-mukul-rohtagi-justice-abhijit-ganguly-advocate-mukul-rohtagi-supreme-court/
b) https://www.thewall.in/news/i-want-to-see-how-big-of-a-lawyer-is-mukul-says-justice-abhijit-gangopadhyay/
c) https://www.anandabazar.com/india/what-will-happen-to-justice-gangopadhyays-judgments-if-he-loses-the-right-to-hear-cases-the-question-is-in-the-supreme-court/cid/1425553