গাজরগামী: পুঁজিবাদের করুণ বাস্তবতা / Carrot Race

ধরুন, আপনি প্রবাদপ্রতিম জাদুকর পিসি সরকারের কাছ থেকে একটি বিশেষ জাদু কলম পেয়েছেন যা আপনাকে আরও বেশি এবং তাড়াতাড়ি লেখালেখির ও অফিসের কাজ করতে সাহায্য করে। আপনার তো খুব আনন্দ! কিন্তু পিসি সরকার মজা পেয়ে বললেন, “এটা ব্যবহার করলেই কিন্তু আপনার বেতন কমে যাবে!” মানে?

হ্যাঁ, ঠিক এমনটাই ঘটে পুঁজিবাদ বা ক্যাপিটালিস্ট দুনিয়ায়।

পুঁজিবাদ বা ক্যাপিটালিস্ট ব্যবস্থায় যখন প্রোডাকশন বা উৎপাদনশীলতা বাড়ে, তখন সাধারণ কর্মচারীরা মনে করে তাদের মজুরি বাড়বে। কিন্তু ঘটে উল্টোটা। মালিকপক্ষ সেই বাড়তি কাজের মুনাফার বেশিরভাগই নিজেদের পকেটে ভরে ফেলে। আর আমাদের হাতে থাকে সেই পুরনো বেতনের খাম থুড়ি স্যালারি স্লিপ অথবা নামমাত্র বর্ধিত বেতন যার প্রায় পুরোটাই মুদ্রাস্ফীতি খেয়ে ফেলে।

এটুকু পড়েই যারা রাইজ অফ ভয়েসেসকে সেকু-মাকু বা চীনের দালাল বলে খিস্তি দেবেন বলে মনে মনে তৈরি হচ্ছেন, আস্তিন গুটোচ্ছেন, তাদেরকে জানিয়ে রাখি, ঠিক এটাই ঘটেছে বিগত চার বছরে আমাদের দেশে। স্বয়ং মোদি সরকারের করা অর্থনৈতিক সমীক্ষায় উঠে এসেছে এই ছবি। ২০২০ সাল থেকে থেকে ২০২৩ এর মধ্যে দেশের ছোট বড় ৩৩ হাজার কোম্পানির করোনা মহামারির মধ্যেও মুনাফার পরিমাণ বেড়েছে চারগুণ মানে প্রায় ৩০০%। অথচ সেই অনুপাতে দেশজুড়ে কর্মসংস্থান বা বেতন কোনটাই বাড়েনি। উলটে এই কোম্পানিগুলোতে কর্মসংস্থান কমেছে সাড়ে ষোল লক্ষ মত। আর বেতন বৃদ্ধির কথা আর নাই বা বললাম। আপনার জানাশোনা একজনও আছে কি যার গত চার বছরে চারগুণ মাইনে বেড়েছে! বেড়ে ন্যুনতম দ্বিগুণ হয়েছে এমনও কেউ আছে নাকি! সহজ উত্তর নেই। কারণ এটা হওয়া সম্ভব নয়।

কেন সম্ভব নয়! কারণ এটা ক্যাপিটালিস্ট ব্যবস্থা। এটি ক্যাপিটালিস্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, চালিত ও পালিত। এখানে দেশ গঠনের ধুঁয়ো তুলে লাভের ক্ষীর চিরকাল মালিকরাই খাবে। এ হলো এক উগ্র জাতীয়তাবাদ জারিত ব্যবস্থা যেখানে খেটে খাওয়া আম জনতা জারজ উদ্বৃত্ত সন্তানের মত। এখানে দেশনেতাদের লালন-পালন করেন এই মালিক পক্ষ। আমার আপনার চোখের সামনেই কিভাবে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক নেতাদের কোষাগার ভরে কর্পোরেট ট্যাক্সে বিপুল ছাড় আদায় করে মুনাফা বাড়াতে হয়, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে দেশজ কর্পোরেট সংস্থাগুলো। আর খেটে খাওয়া আম জনতা গত দশ বছর ধরে একের পর এক নির্বাচনে বুথে বুথে লাইন দিয়ে নেতাদের ভোটবাক্স ভরেও এক চিলতে কর ছাড়ের আশা নিয়ে বছরের পর বছর চাতক পাখির মত বাজেটের দিন অর্থমন্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হয়রান হচ্ছে। জুটছে না কিছুই। একদিকে গ্রামের চাষি ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করছে। কৃষি ঋণ শোধ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে চাষের জমিজমা বেচে দিয়ে ক্ষেতমজুর বা পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পাড়ি দিচ্ছে ভিনরাজ্যে বা ভিনদেশে। আর কর্পোরেট মালিকরা ঋণ ফাঁকি দিয়ে সরকারি খাতায় কলমে ফেরার হয়েও হাওয়ালার মাধ্যমে চেটেপুটে টাকা পয়সা ঝেড়ে নিয়ে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন, আন্টিগা, দুবাই, সিঙ্গাপুর বা ভানুয়াটুতে গিয়ে বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছে।

এরই মধ্যে কিছু শিক্ষিত বেকার সাকার হওয়ার তাগিদে ব্লগার, ইউটিউবার বা সাংবাদিক সেজে নেমে পড়ে মানুষকে বোঝাতে এই যে, আম্বানির ছেলের বিয়েতে হাজার হাজার কোটি টাকার খরচ, সেই টাকা আদতে কিভাবে আমাদের হাত ঘুরে অর্থনীতিতে ফিরে এসে তাকে চাঙ্গা করছে। এদেরই একদল অপভ্রংশ আবার ঐ একই কায়দায় দূর্গাপূজোর সরকারি অনুদানে বঙ্গ অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার রসদ খুঁজে পাবেন। কিন্তু আসলে যা হওয়ার নয়, তা হয় না! রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে গাঁক গাঁক করে চিৎকার করলেও না।

কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি কি, স্বীকার করছি কি এই করুণ কঠিন বাস্তব সত্যিটাকে। নাকি ‘আচ্ছেদিন’, ‘বিকশিত ভারত’, ‘এগিয়ে বাংলা’ ইত্যাদি হাজারো ঝোলানো গাজরের পেছনে হাগড়ে উদ্বৃত্ত জারজের মত ছুটতেই থাকবো!

আপনারা জানান আপনাদের মতামত! লিখুন আমাদের কমেন্ট বক্সে।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস