‘সত্য’বচন / The Hidden Truth

মুখ খুললেন জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল মালিক। তিনি কোন যে সে লোক নন। একসময় বিজেপির সর্বভারতীয় সহ সভাপতি ছিলেন। তারপর মোদি জমানায় একে একে বিহার, জম্মু-কাশ্মীর, গোয়া এবং মেঘালয়ের মত চার রাজ্যের রাজ্যপাল হয়েছেন। বিহারের রাজ্যপাল থাকাকালীন সময় কয়েক মাসের জন্য উড়িষ্যার রাজ্যপালের অতিরিক্ত দায়িত্বও সামলেছেন। খেয়াল করলেই দেখবেন এই সবকটা রাজ্যে তাঁর আমলে মূলতঃ রাজভবনের মাধ্যমেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার প্রভাব বাড়াতে সচেষ্ট হয়েছে এবং সফলও হয়েছে। সংবাদমাধ্যমও সেসময় সংবিধানের ধুঁয়ো তুলে সাংবিধানিক প্রধান তথা রাজ্যপালকে মাস্টারস্ট্রোকের অংশীদার বানিয়েছে! কাজেই সত্যপাল মালিককে একজন অভিজ্ঞ ও পরিক্ষিত বিজেপি নেতা বলাই যায়।

কিন্তু হঠাৎই বিশিষ্ট সাংবাদিক করণ থাপারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই সত্যপাল এমন কিছু বিস্ফোরক ‘সত্য’ সামনে এনেছেন যা বিজেপির নেতাদের হজম করতে অসুবিধা হচ্ছে। মূলতঃ তিনটি বিষয় তিনি সামনে এনেছেন।

এক, সত্যপাল বলেছেন পুলওয়ামা সন্ত্রাসবাদী হামলায় পাকিস্তানের হাত ছিল ঠিকই, কিন্তু তা তারা সংগঠিত করতে সক্ষম হয়েছে মূলতঃ ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা দপ্তর ও সেনাবাহিনীর অপরিণামদর্শিতার কারণে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি সত্যপাল তখন জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্যপাল। ২০১৯ সালের ১৪ ই ফ্রেব্রুয়ারি। প্রায় ৯০০ জনের ব্যাটেলিয়নকে সেদিন কোন রকম সুরক্ষা বলয়ের ব্যবস্থা না করেই সড়কপথে ৭৮ টা বাসে করে ৪৪এ জাতীয় সড়ক দিয়ে জম্মু থেকে শ্রীনগরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। যে পথ দিয়ে সেনাবাহিনীর কনভয়টি যাচ্ছিল সেই রুটে আরও ৮-১০ টি রাস্তা বিভিন্ন জায়গায় জাতীয় সড়কে এসে যুক্ত হয়েছে জানা থাকলেও সেই সংযোগ স্থলগুলোতে কোন রকম পাহারা বা চেকিং এর ব্যবস্থা ছিল না। যে কেউ চাইলে সেনাবাহিনীর কনভয়ের কাছে বা মধ্যে চলে আসতে পারত এবং সেদিন হয়েছিলও তাই। আদিল আহমদ দার নামের জনৈক পাকিস্তানপন্থী কাশ্মীরি উগ্রপন্থী প্রায় ৪০০ কেজির মত আরডিএক্স ও অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট জাতীয় শক্তিশালী বিস্ফোরক বোঝাই একটি গাড়ি নিয়ে এমনই একটি অরক্ষিত সংযোগস্থল দিয়ে কনভয়ে ঢুকে পড়ে এবং আত্মঘাতী হামলা চালায়। হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হয়। জৈশ-এ-মহম্মদ নামক কুখ্যাত উগ্রপন্থী সংগঠন হামলার দায় স্বীকার করে। এপ্রসঙ্গে সত্যপাল আরও জানিয়েছেন এই মর্মান্তিক উগ্রপন্থী হামলার আগেরদিন অর্থ্যাৎ ১৩ই ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত কম করে ১১ টি ইন্টেলিজেন্স ইনপুট ছিল সেনাবাহিনীর কাছে যে জৈশ-এ-মহম্মদ, লস্কর-ই-তইবা যে কোন সময় ভারতে প্রাণঘাতী হামলা করতে পারে। এ খবর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংও জানতেন। অথচ তাও দেশের মাটিতে দেশের সেনাবাহিনীর জওয়ানদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়া খুবই লজ্জাজনক এবং এর যাবতীয় দায় কেন্দ্রীয় সরকারের। এমনকি সেসময় জম্মু কাশ্মীরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি থাকায় রাজ্যপাল হিসেবে নিজেও তাঁর ব্যর্থতার কথা মেনে নেন। তিনি আরও অভিযোগ করেন যে সড়কপথে এত্ত বড় সেনাবাহিনীর ব্যাটেলিয়নকে সারিবদ্ধভাবে নিয়ে যাওয়ার কোন অতীত নজির নেই। সেনার এত বড় ‘বিশাল মুভমেন্ট’ সাধারণত উড়ান পথে বিমান মারফত হয়ে থাকে। তিনি জানতে পারেন সিআরপিএফের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই সেনা মুভমেন্টের জন্য জম্মু থেকে শ্রীনগর বিমান পরিষেবার আবেদন করাও হয়, অথচ সরকারের তরফ থেকে সদর্থক কোন সাড়া আসেনি। তাই একরকম বাধ্য হয়েই সিআরপিএফ জওয়ানরা ৪৪এ জাতীয় সড়ক দিয়ে শ্রীনগরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। অথচ কেন্দ্রীয় সরকার সেদিন জওয়ানদের জন্য বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করলে এই দুর্ঘটনা এবং ৪০ জন তরতাজা জওয়ানের মৃত্যু এড়ানো সম্ভব হতো। সত্যপাল জানিয়েছেন এই সরকারী ব্যর্থতার কথা তিনি নিজে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে ফোন মারফত জানিয়েছিলেন। যদিও প্রধানমন্ত্রী ও পরবর্তীতে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল তাকে এব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের সামনে মুখ খুলতে বারণ করেন এবং অবশেষে উরি সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের মাধ্যমে উগ্র জাতীয়তাবাদের ধ্বজা উড়িয়ে সরকারী ব্যর্থতার ওপর পর্দা টানতে কেন্দ্রীয় সরকার সক্ষম হয়।

দুই, সত্যপাল মালিকের দ্বিতীয় অভিযোগটি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে। তাঁর জম্মু-কাশ্মীর ও গোয়ার রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়কার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল দেশের প্রধানমন্ত্রী নাকি দুর্নীতির প্রশ্নে যথেষ্ট নমনীয়। এপ্রসঙ্গে তিনি জানান জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যপাল থাকার সময় তিনি প্রধানমন্ত্রীকে কিছু অনিয়মের বিষয়ে জানিয়েছিলেন। এপ্রসঙ্গে তিনি রিলায়েন্স শিল্পগোষ্ঠীর চিকিৎসা বিমা সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব এবং একটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের উদাহরণ দেন। এগুলির স্বপক্ষে খোদ প্রধানমন্ত্রী দফতরের প্রতিমন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ থেকে শুরু করে আরএসএস নেতা রাম মাধবের মত প্রভাবশালীরা সক্রিয় ছিল বলে তাঁর অভিযোগ। দুটিই তিনি রাজ্যপাল হিসেবে নাকচ করে দেন এবং এই সমস্ত প্রভাবশালীদের সক্রিয়তা সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্কও করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। গোয়ার রাজ্যপাল থাকার সময়ও সেখানকার বিজেপি সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীর দুর্নীতির বিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছিলেন। তারপরেই তড়িঘড়ি তাঁকে একদিনের নোটিসে মেঘালয়ের রাজ্যপাল হিসেবে বদলি করে দেওয়া হয়। এমনকি সম্প্রতি আদানি-হিন্ডেনবার্গ কান্ডে আদানি শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে দেশবাসী যে প্রধানমন্ত্রীর তরফে কোন সদুত্তর ও যথাযথ তদন্তের আশ্বাস পায়নি তারও উল্লেখ করে সত্যপালের দাবী, প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতিকে খুব একটা ঘৃণা করেন না। মানে ঘুরিয়ে সত্যপাল যা বলছেন তা হলো ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’ হলো শুধুই লোক দেখানো আস্ফালন মাত্র।

তিন, সত্যপাল মালিকের তৃতীয় অভিযোগটি রাষ্ট্রপতি ভবনকে ঘিরে। তাঁর মতে রাষ্ট্রপতি কাদের সাথে দেখা করবেন আর কাদের সাথে করবেন না, তা ঠিক হয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে। তাঁর নিজের রাষ্ট্রপতির সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট শেষ মুহুর্তে অজ্ঞাত অঙ্গুলিহেলনে বাতিল করা হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ। তাঁর মতে আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি আদতে প্রধানমন্ত্রীর হাতের পুতুল। তাঁর কোন রকম স্বাধীনভাবে কাজ করবার ক্ষমতা ও পরিসর নেই। কাজেই এই যে দেশের প্রথম আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে এত ঢাক-ঢোল পেটানো চলছে তাও আদতে লোক দেখানো যাকে ইংরাজীতে বলে ‘প্লেয়িং টু দ্য গ্যালারি’।

এখন সত্যপাল সত্য বলছেন কি মিথ্যা বলছেন আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস জানি না। কিন্তু আমরা যেটা দেখলাম তা হলো সত্যপাল মালিকের এই বিস্ফোরক সাক্ষাৎকার সামনে আসবার পর আমাদের দেশের কোন প্রথমশ্রেণীর সংবাদমাধ্যম ও সংবাদপত্র সেটা যথাযথ মর্যাদা সহকারে দেশের মানুষের সামনে পরিবেশন করলো না বা তুলে ধরল না।

আজ থেকে দশ বছর আগে এমন কোন খবর বা সাক্ষাৎকার সামনে এলে পরদিন দেশের সব কাগজে হেডলাইন হয়ে যেত। নিউজ চ্যানেল গুলোতে শুরু হয়ে যেত রাজনৈতিক তর্জা। ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত দল থেকে বিতাড়িত খুচরো বাম নেতা কেরালার বাম সন্ত্রাস নিয়ে মুখ খোলায় সর্বভারতীয় ইংরাজি চ্যানেলের সাংবাদিক, যিনি এখন ‘ইন্ডিয়া ওয়ান্টস টু নো’ বলে চিল্লে বেড়ান, ঋতব্রতর প্রায় এক ঘন্টার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তাও আবার প্রাইম টাইমে! কিন্তু আজ কেন সেই তাঁদের এই অপার নীরবতা! আর তাদের এই নীরবতার জন্যই সরকারের তরফ থেকে অভিযোগের কোন জবাব নেই। তথাকথিত বাগ্মী প্রধানমন্ত্রীও চুপ।

এডিটোরিয়াল ইন্ডিপেন্ডেন্সের মুখোশ পরে দেশের সবকটা সংবাদমাধ্যমের সম্পাদক/সম্পাদিকারা এভাবে শাসকের পদলেহনে ব্যস্ত হয়ে পড়লো বলেই ‘রাইজ অফ ভয়েসে’সকে বাধ্য হয়ে ভয়েস তুলতে হলো। লিখতে হলো এই প্রতিবেদন।

সবাই ভালো থাকুন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://www.youtube.com/watch?v=b8wmHUhLvOI&feature=youtu.be
b) https://youtu.be/4ex2gYn7Tvg
c) https://www.anandabazar.com/india/satyapal-malik-slams-pm-narendra-modi/cid/1422794
d) https://thewire.in/government/watch-karan-thapar-satya-pal-malik-narendra-modi
e) https://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2023-04-16/202304152308041.jpg&category=0&date=2023-04-16&button=
f) https://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2023-04-16/202304152326296.jpg&category=0&date=2023-04-16&button=