লাল মাটির বিটি / Daughter of The Red Soil

তিনি থাকেন খড়ের ছাউনি দেওয়া এক চিলতে ছোট্ট কাঁচা বাড়িতে। না। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনাতে তিনি কোন ঘর পাননি।

কেন?

কারণ তালিকায় তার নাম নেই।

কেন নাম নেই?

কারণ তিনি স্থানীয় তৃণমূল নেতাদেরকে কাটমানি দেবেন না বা দিতে রাজি হবেন না, যেটা এই ঈশ্বর পরিত্যক্ত বঙ্গদেশে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ঘর পেতে হলে দেওয়া একপ্রকার ‘বাধ্যতামূলক’!

স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে সবাই তো দেয়, তিনি কেন দেবেন না?

কারণ প্রশ্নটা শুধু যেন তেন প্রকারেণ মাথার ওপর একটা ছাদ জোটানোর নয়! প্রশ্নটা নীতি নৈতিকতার!

এ আবার কোথাকার যুধিষ্ঠির! কিসের এত ‘নীতি’ কপচানি!

না। তিনি কোন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির না। তিনি এক একাকী ‘অনাম্নী’ লড়াকু কন্যা।

লড়াকু বলছি কারণ তাঁর লড়াই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের থেকে কম কিছু নয়! তাঁর যুদ্ধভূমির নাম বোলপুর হলেও, জেলাটির নাম বীরভূম এবং তাঁর প্রতিপক্ষের নাম ‘কেষ্ট’। আর ‘একাকী’ বলছি কারণ তিনি সদ্য পঞ্চাশ পেরোনো এক মহিলা যাকে রাস্তার মোড়ে মোড়ে খড়্গ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা উন্নয়নের সাথে ‘গুড়-বাতাসা’, পাঁচন ইত্যাদি খেয়ে এমন একটি দলের ঝান্ডা হাতে লড়তে হয় যার ইদানীং নাম হয়েছে ‘শূন্য পার্টি’।

হ্যাঁ । ঠিকই ধরেছেন, তিনি সিপিআই(এম) করেন। এই মুহুর্তে তিনি সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সদস্য।

আর মহিলার নাম…. শ্যামলী প্রধান।

যাদের নামটা শোনা শোনা লাগছে তাদেরকে বলি, তিনি একযুগ আগে ২০১৬ সালে নানুর থেকে সিপিআই(এম) এর হয়ে বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। হারিয়েছিলেন লোকাল তৃণমূল (থুড়ি ‘কেষ্ট’মূল!) স্ট্রং ম্যান গদাধর হাজরাকে। স্থানীয় লোকে বলে সেটা নিছকই একটা কাকতালীয় ঘটনা। তৃণমূলের উপদলীয় কোন্দলে একপক্ষের সমর্থন পেয়ে যাওয়াতেই এসেছিল সেই জয়।

কিন্তু তারপর ‘কেষ্ট’দাপটে আর জেলার আর পাঁচজন বামনেতার মতই ২০২১ এর বিধানসভা ভোটে হেরে গিয়ে একপ্রকার হারিয়ে গিয়েছিলেন।

কিন্তু সত্যি কি তাই!

নাহ! শ্যামলী প্রধান যে হারিয়ে যাননি ফের একবার ফিরে এসে প্রমাণ দিচ্ছেন। নির্বাচনী ময়দানে কয়েকবার হেরে গেলেও আপস না করে বুক চিতিয়ে লড়ে গেলে যে রাজনীতির ময়দানে টিকে থাকা যায় সেটাই করে দেখাচ্ছেন তিনি।

তিনি অসৎ, একথা রাজনীতিতে তার চরম শত্রুও বলবে না। বললে শ্যামলী প্রধানের কিছু যাবে আসবে না, উলটে যিনি বলবেন তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। বরং একসময়ে তার প্রবল দোর্দন্ডপ্রতাপ প্রতিপক্ষ কেষ্ট মণ্ডল, যাঁকে একসময় বঙ্গ মিডিয়া ‘বীরভূমের বাঘ’ বলে অভিহিত করেছিল, সেই তিনি এই মুহুর্তে নিজের মেয়েকে নিয়ে একসাথে দুর্নীতির অভিযোগে সুদূর দিল্লির তিহার জেলে জেল খাটছেন ও জেলের ভাত খাচ্ছেন। এমনকি ইডি হানার সময় ধরা পড়বার ভয়ে তথাকথিত ‘বীরভূমের বাঘ’কে ইঁদুরের মত পালিয়ে চিলেকোঠার ঠাকুরঘরে খিল দিতেও দেখেছে এলাকাবাসী!

কিন্তু বীরভূমের বাঘের ভয়ে শ্যামলী প্রধান পালিয়ে গেছে বা লুকিয়ে পড়েছে কেউ বলতে পারবে না।

হ্যাঁ, তিনি আপস করেননি। তাই বিধায়ক হয়েও থেকে গেছেন রাস্তার ধারে ‘ঝুপড়িসম’ এক চিলতে ঘরে। একসময় সেই ঘরেই তাঁর সাথে তাঁর পোষা একটা ছাগলকে থাকতে দেখেছে এলাকাবাসী। এখনও সেটা আছে কি না আমরা জানতে পারিনি।

তবে যা জেনেছি তা হলো, দীর্ঘ পাঁচ বছর বিধায়ক থেকেও তিনি জেলা বা ব্লকের বড়-মেজো-সেজো তৃণমূল নেতাদের মত কয়লা-গরু-পাথর-বালি পাচার করে টাকা কামাননি আর তাই নিজের জন্য বানাতে পারেননি প্রাসাদোপম বসতবাড়ি। হননি রাশি রাশি চালকল আর গন্ডা খানেক ‘এসইউভি’র মালিক। পাচারের কালোটাকা সাদা করতে কাটেননি ডিয়ার লটারির টিকিট।

আর তাই আজ যখন আলিমুদ্দিন থেকে তাঁকে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বোলপুর কেন্দ্র থেকে লড়বার টিকিট দেওয়া হয়েছে তখন তিনি প্রচারে দলীয় পতাকা হাতে রাজপথে বের হতেই তাঁকে ঘিরে জড়ো হচ্ছেন হাজারো মানুষ। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহনে দীর্ঘ হচ্ছে প্রচার মিছিল।

তিনি প্রমাণ করে ছেড়েছেন ‘যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় রাবণ’ আপ্তবাক্যটা অন্তত তার ক্ষেত্রে খাটে না। বরং প্রমাণ করে ছেড়েছেন কেষ্ট মন্ডলের মত দুর্নীতিগ্রস্ত ‘বাহুবলীরা’ জেলে যাবেন আর সৎ লড়াকু শ্যামলী প্রধানরা থেকে যাবেন।

সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত ভোটের পরিসংখ্যান দেখলে অবশ্য মনে হবে এই বোলপুর কেন্দ্রের মূল লড়াইটা বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে। কিন্তু বিজেপির তরফে যাকে প্রার্থী করা হয়েছে সেই ‘প্রিয়া সাহা’কে রাজ্য ও জেলা বিজেপির অন্দরেই অনেকে চেনেন না। জনপরিচিতি প্রায় নেই বললেই চলে। সেখানে সিপিএমের শ্যামলী প্রধান জেলা রাজনীতিতে পরিচিত নাম। বাজারে গুজব, সেটিং এর শর্ত হিসেবে এই আসনটা নাকি বিজেপি তৃণমূলকে ছেড়ে দিয়েছে বলেই এমন দুর্বল প্রার্থী দেওয় হয়েছে। বিক্ষুব্ধ বিজেপি নেতা অনুপম হাজরা দুর্বল প্রার্থী নিয়ে সমাজমাধ্যমে তাঁর ক্ষোভও উগড়ে দিয়েছেন।

আর এসব দেখে জেলার রাজনৈতিক মহলের একাংশের অভিমত বোলপুর কেন্দ্রের আসল লড়াইটা তৃণমূল কংগ্রেসের বিদায়ী সাংসদ অসিত মাল বনাম সিপিআই(এম)র শ্যামলী প্রধানের মধ্যে হতে চলেছে। বিদায়ী সাংসদ আসিত মাল অবশ্য এখানে নগণ্য। জেলবন্দি কেষ্টর ছায়ার সাথেই মূলতঃ লড়াই এখানে বলে মনে করেন জেলার অভিজ্ঞ রাজনৈতিক মহল।

এমতাবস্থায় শ্যামলী প্রধান কি পারবেন তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করে বাম ভোট পুনরুদ্ধার করতে! পারলেও তা কতখানি! নাকি স্বল্প পরিচিত বিজেপির প্রিয়া সাহাই হবেন তৃণমূলের আসল প্রতিপক্ষ!

তার জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে ৪ঠা জুন পর্যন্ত।

শ্যামলী প্রধান অবশ্য এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে রাজি নন। তিনি হাঁটছেন। আর প্রথমদিন থেকেই দীর্ঘতর হচ্ছে তার সঙ্গে হাঁটতে থাকা মানুষের মিছিলটা।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস