গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল / The Stuntman Files

গ্রাম বাংলা জুড়ে এখন নবজোয়ার চলছে! অন্তত মিডিয়া সেরকমটাই দেখাচ্ছে!

কি সেই নবজোয়ার! এক প্রাইভেট নির্বাচন কমিশনারের উদ্যোগে আয়োজিত প্রাইভেট নির্বাচন। প্রাইভেট বলছি কারণ এটা কোন সরকারী ব্যাপার নয়, এ হলো আসন্ন ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে শাসক দলের অভ্যন্তরীণ ভোটাভুটির মাধ্যমে নিজস্ব প্রার্থী চয়ন প্রক্রিয়া।

কমিশনার সাহেব লিমুজিন বাসে চেপে জেলায় জেলায় ব্লকে ব্লকে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সার্কাসের মত তাঁবু পড়ছে। হচ্ছে ভোট। ফলাফল যদিও কবে জানা যাবে কেউ জানে না, কিন্তু তবুও পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হতে সবাই মরিয়া! ফলে চলছে ব্যালট বাক্স ছিনতাই, ছাপ্পা ভোট, হাতাহাতি, লাঠালাঠি! আর অদ্ভুত ভাবে শাসক দলের এই প্রাইভেট নির্বাচনে শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে সরকারি পুলিশ। এ প্রসঙ্গে জানিয়ে দিই, বহুকাল আগে বিজেপির রাজ্য সভাপতি নির্বাচনে র‍্যাফ নেমেছিল গিরিশ পার্ক অঞ্চলে। সেই স্মৃতি উস্কে গেছে আমাদের মত বহু মানুষের মনে।

তা যাইহোক খাঁকি উর্দি পরা পুলিশ যাথারীতি এই প্রাইভেট নির্বাচনেও আর পাঁচটা সাধারণ নির্বাচনের মত দেদার ভোট লুঠ আটকাতে পারছে না। ফলে অনেকেই আজ প্রশ্ন তুলছেন, নিজেদের লোকজন নিয়ে প্রাইভেট নির্বাচনে এমন বিশৃঙ্খলা হলে, অরিজিনাল পঞ্চায়েত নির্বাচনে হবে কি? কেউ কেউ আবার আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে বলে দিচ্ছেন, এসব হল আগামী পঞ্চায়েত নির্বাচনে ‘সন্ত্রাস’ প্র্যাক্টিস করার উদ্যোগ। আর সবচেয়ে মজার ব্যপার হল, এই প্রাইভেট নির্বাচন ও প্রাইভেট নির্বাচন কমিশনারের কর্মসূচি নিয়ে অত্যন্ত উৎফুল্ল রাজ্যের প্রথম সারির মিডিয়া হাউসগুলো। এ হলো সেই মিডিয়া, যারা কয়দিন আগে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত থেকে নিয়োগ দুর্নীতির সব মামলা সরে যাচ্ছে বলে প্রচার করেছিল। এরা হলেন তারা, যারা বেমালুম চেপে যান, বিজেপিপন্থী আইনজীবী মুকুল রোহতাগি সুপ্রিম কোর্টে দু-দুবার চাকরিহারা অযোগ্যদের হয়ে সওয়াল করতে গিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের মাননীয় বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে সওয়াল করেছেন। সেই মুকুলই সর্বপ্রথম সুপ্রিম কোর্টে গত মার্চ মাসের একদম শেষদিকে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের টিভিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গটি সুপ্রিম কোর্টের সামনে আনেন এবং কার্যত ওনার এজলাস থেকে যাতে নিয়োগ দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাগুলি সরিয়ে নেওয়া হয়, তার জন্যে সওয়াল করেন। প্রথম সারির মিডিয়া এসব দেখায় না। তারা দেখান, প্রাইভেট নির্বাচন কমিশনার কি খাচ্ছেন, কোথায় ঘুমোতে যাচ্ছেন?

যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের যন্ত্রনা নিয়ে খবর, গঙ্গা ভাঙন, আবাস দুর্নীতি, বেহাল রাস্তা, মুল্যবৃদ্ধি, ডলারের দামের পতন, আদানি স্ক্যাম, সত্যপালের পুলওয়ামা নিয়ে স্বীকারোক্তি, সোনম ওয়াংচুকের গৃহবন্দী হওয়ার ঘটনা, এই সব নিয়ে সংবাদমাধ্যমে কিছুই আপনাদের চোখে পড়বে না। এরা হলো সেই মিডিয়া যারা দিল্লি মসনদের নাকের ডগায় রামলীলা ময়দানে আয়োজিত বামেদের ডাকা কৃষক-মজদুরদের সুবিশাল সমাবেশ হাপিস করে দেন, অথচ ঘটা করে প্রচার করেন “হাভার্ড নয় , হার্ডওয়ার্ক”! দেশ গঠনে কৃষক-মজদুরদের থেকে বেশি হার্ডওয়ার্ক আর কজন করেন আমাদের জানা নেই। কিন্তু এইসব হা-ভাতে উলুখাগরাদের দিয়ে কি আর স্টান্টবাজি হয়? টিআরপি জোটে?

কাজেই কায়দা করে ঝাঁ চকচকে ফটোজেনিক ‘কুশীলব’ খুঁজতে হয়! তাদের পেছন পেছন বুম ক্যামেরা নিয়ে ঘুরতে হয়। তাদের দিয়ে স্টান্টবাজি করাতে হয়, ক্যাচ লাইন বলাতে হয়। তবে টিআরপি আসে। আর বাংলায় সেরকমই একজন হলেন এই নব জোয়ারের প্রাইভেট নির্বাচন কমিশনার। তিনি নিশ্চয়ই কারোর ‘পো’, আকাশ থেকে তো আর পড়েননি!

কিন্তু তাঁকে নিয়ে আমরা মাথা ঘামাতে চাই না। আমরা মাথা ঘামাতে চাই সংবাদমাধ্যমকে নিয়ে। কারণ আমরা আমাদের গাঁটের কড়ি খরচা করি খবর জানতে ও শুনতে! সেখানে এই ‘পলিটিকাল স্টান্টবাজি’ দেখে আমাদের সন্তুষ্ট থাকতে হবে কেন! এনাদের’ জানতে চায় বাংলা’, ‘জানতে চায় দেশ’ চিৎকার আদৌ কি আমাদের খবরের ক্ষিদে মেটায়। তাদের প্রাইম টাইম টক শো’র নামে রাজনৈতিক কাজিয়া আর মাতব্বরি কি আদৌ দেশ বা জাতি গঠনে কাজে লাগছে! নাকি গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ আজ ক্রমশ “গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল”-এ পর্যবসিত হচ্ছে।

প্রশ্নটা রইলো। ভালো থাকবেন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস