এ কোন ২৫শে বৈশাখ! / Tagore

গতকাল ২৫ শে বৈশাখ ছিল। বাঙালীর প্রধান সাংস্কৃতিক পার্বণ।

অথচ গতকাল এই প্রথম সারাদিন ধরে টিভির পর্দায় চোখ রেখে এবং ঘনঘন মোবাইলে আসা অ্যালার্ট হাতড়ে আমরা অনেকেই বুঝে উঠতে পারিনি যে এটা রবীন্দ্র জয়ন্তী। ফেসবুক, ট্যুইটার আর হোয়টসঅ্যাপে আসা কবিগুরুর ছবি সহ তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কিছু পোস্টার না পেলে হয়তো বুঝতেও পারতাম না।
না, এক ঝলকের জন্য হলেও সারাদিন কোথাও থেকে এক টুকরো রবীন্দ্র কবিতা আবৃত্তি বা রবীন্দ্রগানের কলি কানে আসেনি। এমনই এক তাজ্জব ২৫ শে বৈশাখ কাটিয়ে আমরা তো অবাক!

এর একটা কারণ যদি হয় রবীন্দ্র জয়ন্তীতে ‘দরজা বন্ধ’ শান্তিনিকেতন তবে অন্য কারণটি হলো নোবেল পুরস্কার ভূষিত গীতাঞ্জলীর রচয়িতার ছবি টাঙিয়ে, কথাঞ্জলীর লেখিকা তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর তথাকথিত প্রবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ইন্দ্রলুপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা! আর আরও দৃষ্টিকটু ছিল বাংলার সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা! তারা সারাদিন একদম খুল্লম খুল্লা চিল্লে চিল্লে প্রচার করে গেলো কবিগুরুকে সামনে রেখে বিজেপি-তৃণমূলের এই রাজনৈতিক দ্বৈরথ! কোথাও রবীন্দ্রজয়ন্তীর এমন নির্লজ্জ রাজনীতিকরণের এক টুকরো সমালোচনা দেখলাম না। বরং ‘টিআরপি’ পেতে বা ধরে রাখতে যতটা সম্ভব মুখরোচক করে কিভাবে রবি ঠাকুর কে হাতিয়ার করে ‘বাঙালী আবেগে’ রাজনৈতিক শান দেওয়া যায় তারই বেহায়া প্রদর্শনী চললো সারাদিন ধরে।

প্রথমে আসা যাক ‘দরজা বন্ধ’ শান্তিনিকেতনের কথায়। এই প্রথম দেখলাম ২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্র জয়ন্তীর দিন জনসাধারণের জন্য পর্যটকদের জন্য শান্তিনিকেতনের রবীন্দ্র ভবনের দরজা বন্ধ। বিদ্যুৎ খেলে গেলো সারা শরীরে, মাথায়। সৌজন্যে জমির লড়াই লড়া, পাঁচিল তোলা এক আরএসএস ঘনিষ্ঠ উপাচার্য। এনার অঙ্গুলিহেলনেই বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ রবীন্দ্র জয়ন্তীর দিন শান্তিনিকেতনের মূল আকর্ষন রবীন্দ্রভবনের দরজা বন্ধ রেখে একগুচ্ছ রবীন্দ্র অনুরাগী মানুষকে হতাশ করেছেন। এছাড়াও প্রচণ্ড গরমের অজুহাতে শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র জয়ন্তীর অনুষ্ঠান সূচিও কাটছাট করা হয়। বাতিল করা হয় সকালের বিশ্বভারতীর মাধবীবিতানের অনুষ্ঠান এবং সন্ধ‍্যার শাপমোচন নাট‍্যানুষ্ঠানটি। মানে এক কথায় ২৫ শে বৈশাখ রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন আদৌ ‘শান্তিনিকেতনী’ ছিল না। আর হবেই বা কি করে! পৌষমেলা করতে না দিয়ে পাঁচিল তোলা অথবা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের সাথে ১৩ ডেসিমেল জমি নিয়ে জমির লড়াই লড়ার মত গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কাজে সর্বশক্তি ব্যয় হয়ে গেলে ‘রবীন্দ্রচর্চা’র মত বৌদ্ধিক বিষয় আর আদৌ প্রাথমিকতা পাবে কি করে! কাজেই অন্যান্যবারের মত টিভির পর্দায় শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্র জয়ন্তীর যে সরাসরি সম্প্রচার হয়, তা এবার চোখে পড়েনি।

এবার শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় ফেরা যাক!

প্রথমে আসি রবীন্দ্রনাথের জন্মস্থান জোড়াসাঁকোর কথায়। কারণ এখান থেকেই রাজনীতির বল গড়ানো শুরু, যা সমস্ত টিভি চ্যানেলের পর্দা জুড়ে চললো সারাদিন। জোড়াসাঁকোতে রবীন্দ্র জয়ন্তীর প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি রবীন্দ্র মূর্তিতে মালা দিলেন। ঘুরে দেখলেন ঠাকুরবাড়ি। সঙ্গে বাংলার সমস্ত মিডিয়ার ক্যামেরা ও বুম। স্টুডিও থেকে সঞ্চালকের ধারাবিবরণী চলছে রবিগুরুকে নিয়ে বাঙালী আবেগ উস্কে দিতেই নাকি ইন্দ্রলুপ্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রবীন্দ্রজয়ন্তীর দিনে এই ‘বাংলা’ সফর। বিজেপিকে নাকি আরও বেশি বাঙ্গালিয়ানাতে মুড়ে ফেলতেই এমন শাহি সফর। উদ্দেশ্য বাঙালী ভোটব্যাঙ্ক!আর এমন ধামাকাদার মুখরোচক ফুটেজের সামনে জোড়াসাঁকোতে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিতান্তই জোলো! এমনকি রাজ্য সরকারের তরফে কোন প্রতিনিধিদেরও সেখানে দেখা মেলেনি। অন্যান্যবার কিন্তু জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতেই রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে রাজ্য সরকারের তরফে সরকারী কবি প্রণামের মূল অনুষ্ঠানটি করা হয়। কিন্তু এবার তা করা হলো না। সেটি করা হলো প্রথা ভেঙে রবীন্দ্র সদন-নন্দন চত্বরে নব উদ্ঘাটিত ‘ধনধান্য’ অডিটোরিয়ামে । অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে উঠেই মুখ্যমন্ত্রী প্রথমে নন্দন ও রবীন্দ্র সদন চত্বরে রাজ্য সরকার যে পক্ষকাল ধরে রবীন্দ্র পক্ষের আয়োজন করেছে তার ফিরিস্তি শোনান। মানে গাওনা গাওয়া হলো যাতে জনসাধারণের মনে হয় জোড়াসাঁকোটা বিজেপিকে ছেড়ে তৃণমূল চলে এলো রবীন্দ্রসদন চত্বরে।

কিন্তু এভাবে কি লুকানো যায়! রবীন্দ্র চর্চার নামে রাজনীতি করতে এলে মুখোশ খসবেই! ফলে দুই অনুষ্ঠানেই কোন প্রকৃত রবীন্দ্র অনুরাগী বা বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেখা পাওয়া গেলো না। তাদের ভাষণ, আবৃত্তি পাঠ, রবীন্দ্রগান কিছুই কানে এলো না। শুধু দেখতে পেলাম দুটি ভিন্ন দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের মঞ্চ জুড়ে উজ্জ্বল উপস্থিতি। রবীন্দ্র জয়ন্তীর মঞ্চ থেকে বক্তাদের গলায় বাঙালী এই প্রথম শুনতে পেল রাজনৈতিক কটু-কাটব্য, প্রস্তাবিত জাতীয় শিক্ষানীতিকে বিশ্বকবির ভাবনায় জারিত করে বৈধতা আদায়ের অপচেষ্টা! এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলের অবাঙালী নেতাদের সীমিত রবীন্দ্রজ্ঞানকে কটাক্ষ করতে গিয়ে বাঙালী মুখ্যমন্ত্রী বিকৃত বা ভুল রবীন্দ্র কবিতাও আওড়ে ফেললেন- ঝড়কে আমি করব মিতে, লড়ব না তার ভ্রুকুটিতে’! ‘ডরব’ টা ‘লড়ব’ হয়ে যাওয়ায় যে মানেটা উলটে গেলো খেয়াল করলেন না।

মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাঙালী নন, কাজেই তার থেকে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বিশদ তথ্য বা তাঁর গলায় নির্ভুল রবীন্দ্র গান-কবিতা আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস আশা করি না। কিন্তু তিনি কি জানাবেন তাঁদের মেন্টর আরএসএস কেন রবি ঠাকুরের লেখা জনগণমন- অধিনায়ক’কে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে মানতে চায় না। উনি কি জানেন রবি ঠাকুর ফ্যাসিস্ট শক্তি তথা হিটলার-মুসোলিনি-তোজোর ঘোর বিরোধী ছিলেন, যাদের আদর্শ মেনে আরএসএস তথা বিজেপির উৎপত্তি! কেনই বা তাঁদের দলের উত্তরপ্রদেশ সরকার স্কুলের পাঠ্যসূচী থেকে রবি ঠাকুরকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দিলেন নেই তারও সদুত্তর!

কিন্তু তবুও রবি ঠাকুরের জন্মদিনে সারাদিন টিভির পর্দায় বা খবরের পাতা জুড়ে এনারাই রইলেন। কোন প্রকৃত রবীন্দ্র অনুরাগীর দেখা পাওয়া গেলো না। দেখলাম মমতা-অমিত দ্বৈরথ! বিজেপি- তৃণমূলের লড়াই। কবিতা-গান-নৃত্যানুষ্ঠান-নাটকের জায়গায় সারাদিন ধরে যা হলো তা হলো বিশুদ্ধ রাজনৈতিক তরজা।

অবশেষে ২৫শে বৈশাখের রাজনীতিকরণ হয়ে গেল।

আপনাদের ভালো লেগেছে কি না জানি না, আমাদের ভালো লাগেনি।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

a) https://bengali.indianexpress.com/west-bengal/rabindra-bhavan-in-santiniketan-is-also-closed-on-rabindra-jayanti-597993/
b) https://www.madhyom.com/state/pm-modi-amit-shah-pays-homage-rabindra-jayanti-jorasanko-thakurbari-tagore-birthday-12088
c) https://bangla.hindustantimes.com/bengal/kolkata/mamata-banerjee-amit-shah-rabindra-jayanti-2023-31683631389055.html