মূল্যবৃদ্ধির অজানা দিক / The Unknown Side of Inflation

জিনিসপত্রের দাম কেনো বাড়ছে জানতে চান? আসুন একটু জেনে নেওয়া যাক।

মুদ্রাস্ফীতির সাথে খেলাপী ঋণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রথেমেই বুঝতে হবে মুদ্রাস্ফীতি জিনিস টা আসলে কি? খুব সহজভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।

মুদ্রাস্ফীতি কি?

কোন দেশে সর্বোপরি যতটুকু সম্পদ আছে তার মূল্য ওই দেশের বর্তমানের মোট মুদ্রামাণের (টাকা) সমান। মনে করুন, দেশে সর্বমোট ১৫ টাকা আছে এবং এই দেশের সম্পদ বলতে সাকুল্যে আছে ৫ টি কমলালেবু। আর কিছুই নেই। যেহেতু দেশের মোট সম্পদের মূল্য মোট মুদ্রামানের সমান, সেহেতু এই ৫ টি কমলালেবুর মূল্য ১৫ টাকা। অর্থাৎ, প্রতিটি কমলালেবুর মূল্য ৩ টাকা। এখন যদি আরো ৫ টা ছাপানো হয়, তাহলে মোট মুদ্রামান হয়ে যাবে ১৫+৫ = ২০ টাকা। কমলালেবু কিন্তু বাড়েনি। তারমানে এখন (নতুন করে ৫ টাকা ছাপানোর পর) ৫ টি কমলালেবুর মোট মূল্য হয়ে গেল ২০ টাকা। অর্থাৎ প্রতিটি কমলালেবুর বর্তমান মূল্য ৪ টাকা।

এই যে সম্পদ না বাড়িয়ে অতিরিক্ত টাকা ছাপানোর ফলে কমলালেবুর দাম ৩ টাকা থেকে ৪ টাকা হয়ে গেল, এইটাই সহজ ভাষায় “মুদ্রাস্ফীতি”। একই পণ্য আগের থেকে বেশি দামে ক্রয় করা মানেই মুদ্রাস্ফীতি হয়েছে।

অর্থাৎ, আমরা বলতে পারি “কোন দেশের সম্পদের পরিমাণ না বাড়িয়ে টাকা ছাপালে মুদ্রাস্ফীতি হবে।”

এইবার আসি খেলাপী ঋণের প্রসঙ্গে। সহজ ভাষায় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিশোধ না করলে সেই ঋণকে খেলাপী ঋণ বলা যায়। আবার সেই ১৫ টাকা এবং ৫ কমলালেবুতে ফিরে আসা যাক।

মনে করুন, এই ১৫ টাকা থেকে এক ব্যক্তি ৫ টাকা ঋণ নিল। যতক্ষণ পর্যন্ত ঋণের ৫ টাকা দেশের মধ্যেই থাকছে, ততক্ষন দেশের মোট মুদ্রামান ১৫ টাকাই থাকে। মানে প্রতিটি কমলালেবুর মূল্য ৩ টাকাই থাকে। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি এখন পর্যন্ত ঘটেনি।

এইবার ধরুন ওই ব্যক্তি ঋণের ৫ টাকা ডলারে কনভার্ট করে বিদেশে গিয়ে খরচ করে ফেলেছে এবং সে ঋণ পরিশোধ করতে অক্ষম। ডলারে কনভার্ট করার মানে হচ্ছে ওই ৫ টাকা এখন আর টাকা নাই। ধরুন ১ ডলার হয়ে গেছে (ধরি, ১ ডলার = ৫ টাকা)। এখন ওই ১ ডলার কিন্তু আর দেশে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। যে দেশের মুদ্রা শুধুমাত্র সে দেশেই ব্যবহার করা যায়। মানে ওই ৫ টাকা দেশের মধ্যে আর নেই! অথচ খাতা কলমের হিসাবে বাংলাদেশের মোট টাকার মান এখনো ১৫ ই আছে! কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আছে ১০ টাকা। ওই খেলাপী ৫ টাকার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে আবার ৫ টাকা অতিরিক্ত ছাপানো হয়। অর্থাৎ খাতাকলমে মোট মুদ্রামান হয়ে যায় ২০। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ১৫ টাকা থাকে।

এইখানে দুইটি ভয়কংর ঘটনা ঘটে :

১) যেহেতু টাকা ছাপানো হয় নতুন করে, সেহেতু মুদ্রাস্ফীতি হবে। অর্থাৎ একই কমলালেবুর দাম আগে ছিল ৩ টাকা। এখন হয়ে যাবে ৪ টা।

২) উপরের সমস্যাটাও খুব একটা প্রভাব ফেলত না, যদি সত্যি সত্যি দেশে ২০ টাকা থাকত। তাহলে পণ্যের দাম বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও বাড়ত। কিন্তু সেটা তো হচ্ছে না। কারন দেশে তো ২০ টাকা নেই। আছে ১৫ টাকা। ৫ টাকা গায়েব হয়ে গেছে। মানে আমাদের কাছে ১৫ টাকা। কিন্তু পণ্য কিনতে হচ্ছে এমন দামে যেন আমাদের ২০ টাকা আছে।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারির পর দেশের প্রথম ১০০ ডিফল্টারের মোট খেলাপী ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৪,৬৩,২০,০০,০০,০০০ কোটি টাকা (চুরাশি হাজার ছয়শো বত্রিশ কোটি টাকা)। এর অর্থ এই হিউজ পরিমাণ টাকা আমাদের দেশে নেই। অথচ আমাদের পণ্য ক্রয়ের সময় এমন দাম দিতে হচ্ছে যেন ওই এক লাখ এক হাজার একশ পঞ্চাশ কোটি টাকা আমাদের মুদ্রামাণে যুক্ত আছে। কি ভয়ংকর! এইসব হিসাবেই গ্যাসের সিলিন্ডার আজ ১,০২৬ টাকা, অথচ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা সেই ৭০০ টাকাই আছে।

ভয়ংকর ব্যাপার। আপনাকে টাকা না দিয়ে বলা হচ্ছে টাকা দিয়েছি, আছে তোমার পকেটে, বেশি দাম দিয়ে চাল, ডাল, তেল কিনবা। নাহলে না খেয়ে মরবে। এই ভাবে দিন আসবে, দিন যাবে আর মূল্যবৃদ্ধি মানুষের গা সওয়া হয়ে যাবে

তারপর একদিন কোন এক বিরাট জনসভায় একজন বলে উঠবেন, প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক একাউন্টে যে পনেরো লাখ করে দিয়েছিলাম, সেটাই তো খরচ করলেন। আব বতাও দিয়া কে নেহি দিয়া?