এগিয়ে বাংলা ও আচ্ছে দিন / Inflation

এই মুহুর্তে মূল্যবৃদ্ধির সূচকে এগিয়ে বাংলা। দেশের ২৮ টি রাজ্য ও ৮ টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মধ্যে বাংলায় এই মুহুর্তে মূল্যবৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ। এপ্রিল ও মে এই দুই মাসে মুল্যবৃদ্ধির হার ছিল যথাক্রমে ৮.৮৫% এবং ৯.১২%। এর মধ্যে আবার দেখা গেছে গ্রামাঞ্চলে মূল্যবৃদ্ধির হার শহরাঞ্চলের থেকে বেশি এবং সেটা ঘোরাফেরা করছে ১০% এর ওপরে।

অবশ্য দেশের হালও তথৈবচ। সমগ্র দেশে এপ্রিল মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭.৭৯% যা কি না গত আট বছরে সর্বোচ্চ। এমনকি পাইকারি মূল্যসূচক বৃদ্ধির হারও এপ্রিলে ১৫.০৮% যা মার্চ মাসে ছিল ১৪.৫৫%। যেখানে সাধারণভাবে ক্রেতামূল্যসূচকে মুদ্রাস্কীতির হার ৬% এর বেশি হওয়াকে উদ্বেগজনক হিসেবে ধরা হয় সেখানে বর্তমান হার যে যথেষ্ঠ উদ্বেগজনক কেউই অস্বীকার করতে পারছে না। যদিও কেন্দ্রীয়ভাবে তাজমহল-জ্ঞানবাপী ইত্যাদি ইস্যুকে ভাড়াটে মিডিয়া দিয়ে খুঁচিয়ে তুলে ধর্মীয় জিগিরের বাতাবরণ তৈরি করে সাধারণ মানুষের এসব থেকে নজর ঘোরানোর একটা আপ্রাণ চেষ্টা চলছে, কিন্তু তা দিয়ে সবটুকু ঢাকা যাচ্ছে না। কারণ বাজারে গেলেই খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে নাজেহাল হচ্ছে আমজনতা। তার ওপর গ্যাস সিলিন্ডার থেকে শুরু করে পেট্রোল-ডিজেল অথবা কেরোসিন তেল সব কিছুরই দাম গগনচুম্বী।

বাংলার হাল এসবের মধ্যে আরও খারাপ। কারণ একদিকে সরকার দুয়ারে দুয়ারে ক্যাম্প করে ফর্ম ফিলাপ করিয়ে পরিবার পিছু কোন না কোন খাতে বা প্রকল্পের নামে কিছু কাঁচাটাকা ধরিয়ে দিয়ে মানুষের মুখ বন্ধ করবার সস্তা রাস্তা নিয়েছে, বেশ কয়েক বছর চলছে যেটা। ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের চাহিদা কমবেশি একই রকম রয়ে গেছে। কিন্তু সেই অনুপাতে উৎপাদন বৃদ্ধিতে নজর দেওয়া হয়নি। বরং একদম তৃণমূল স্তরে দুর্নীতি এবং কালোবাজারি এখন এমন এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, যাতে উৎপাদন মার খাচ্ছে।

উদাহরণ হিসেবে চাষবাসের কথাই ধরা যাক। সরকারি হাট বা মাণ্ডিতে ফসল বিক্রি করে চাষিরা সঠিক দাম পাচ্ছেন না। সেখানে কুপন বিলি নিয়ে চলছে দুর্নীতি। আলুবন্ড নিয়ে চলছে লুঠ। ফলে চাষিরা বাধ্য হচ্ছেন কম দামে সেই ফসল রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী মজুতদারদের কাছে বিক্রি করতে। এই মজুতদারদের একটা বড় অংশ অভাবী ফসল বিক্রির সুযোগ নিয়ে কম দামে তা চাষিদের থেকে কিনে মজুত করেছে এবং বাজারে কৃত্রিম অভাব তৈরি করে দাম বাড়িয়ে ফায়দা লুঠছে অথচ চাষি তার ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। ফলে যত দিন যাচ্ছে চাষবাস গ্রামের মানুষের কাছে অলাভজনক হয়ে পড়ছে। এর পাশাপাশি রাজ্যজুড়ে সারের দেদার কালোবাজারিও চাষবাস অলাভজনক হয়ে পড়বার আরও একটা কারণ। কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া বিভিন্ন সারপিছু পুরো ভর্তুকিটাই প্রায় মেরে দিচ্ছে শাসক ঘনিষ্ঠ কালোবাজারিরা। ফলে চাষিরা চড়া দামে সার কিনতে বাধ্য হচ্ছেন এবং স্বভাবতই পরিমাণে কম কিনছেন। এর ফলে কম জমিতে চাষাবাদ করতে একরকম তারা বাধ্য হচ্ছেন, যার ফলে বাজারে ফসলের যোগানও কমছে। এভাবেই চাষের কাজে যুক্ত মানুষগুলোর মধ্যে তৈরি হচ্ছে চাষবাসে অনীহা। পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে তারা পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে ভিনদেশে।

ফলে যত দিন যাচ্ছে ফসল উৎপাদন কমছে আর আমরা তত বেশি করে আশপাশের প্রতিবেশী রাজ্য/দেশ গুলোর থেকে আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় আনাজপাতি শাকসব্জি আমদানী করতে শুরু করছি। এতে আমাদের বাজারের খরচ বা জিনিষপত্রের দাম স্বাভাবিক ভাবেই বেড়ে যাচ্ছে, কারণ জিনিসপত্রের উৎপাদন খরচের সাথে আমদানীর জন্য পরিবহনের অতিরিক্ত খরচ যুক্ত হচ্ছে। এমনকি সারের কালোবাজারির কারণে সেই অতিরিক্ত সারের দামটাও আমাদের মত ক্রেতাদেরকেই বাজার থেকে কৃষিজাত যেকোন খাদ্যদ্রব্য কিনতে গিয়ে মেটাতে হচ্ছে। ফলে বাজারে সব জিনিষের দামেই আগুন।

একই কথা প্রযোজ্য শিল্পের ক্ষেত্রে। বিগত একদশকে বাংলায় নতুন কোন শিল্প এসেছে বলে আমাদের জানা নেই। বরং শাসকের তোলাবাজিতে অতিষ্ঠ হয়ে যারা ছিলেন, তাদের অবস্থা অনেকটা ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচির মত।

ফলে সার্বিকভাবে আমাদের রাজ্যের দৈনন্দিন চাহিদার একটা বড় অংশের যোগান আসছে ভিনরাজ্য থেকে। ফলে না তৈরি হচ্ছে নতুন কর্মসংস্থান না হচ্ছে পর্যাপ্ত উৎপাদন। এদিকে চাহিদার কারণে জিনিষপত্রের দাম বাড়ছে হু-হু করে। ফলে তৈরি হয়েছে স্ট্যাগফ্লেশনের মত অভূতপূর্ব পরিস্থিতি।

দেশের অবস্থাও অনেকটা সেই রকম। স্ট্যান্ড আপ ইন্ডিয়া, স্টার্ট আপ ইন্ডিয়ার নামে ঢক্কা নিনাদ আর ঢ্যাঁড়া পেটানোর পরও, এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী চীন কিছুটা বেকায়দায় বা ব্যাকফুটে থাকলেও গত সাত আট বছরে উৎপাদন ক্ষেত্রে আমাদের দেশ যে এখনও তেমন কিছু সুবিধা করতে পারেনি, তার আভাস সাম্প্রতিক ডলারের নিরিখে ভারতীয় মুদ্রার অস্বাভাবিক পতনের মধ্যেই রয়েছে। বৃদ্ধির হার একদিকে যেমন আশানুরূপ নয় তেমনই মুদ্রাস্ফীতির হারও উর্ধ্বমুখী এবং এই মুহুর্তে বিগত দুই মাস তা বিপদ সীমার (ক্রেতামূল্যসূচকে ৬%) ওপর দিয়ে বইতে শুরু করেছে।

ফলে আমাদের দুহাতে কার্যত এখন সত্যি সত্যি লাড্ডু। মানে কিসসু নেই। আর তাই টিভির পর্দায় এখন তাজমহল, মথুরা, কাশী। জ্ঞানপাপীরা এখন আমাদের জ্ঞানবাপীর নতুন ইতিহাস শোনাতে ব্যস্ত।

পরিশেষে আপনাদের জানাতে চাই আমরা যে খাদ্যদ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সম্মুখীন হতে চলেছি এমনটা রাইজ অফ ভয়েসেস বেশ কিছুদিন আগে জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি বাংলার খুঁটিনাটির ২৫তম পর্বে “সার-কথা” শীর্ষক প্রতিবেদনে আগেই জানিয়েছিল।

https://riseofvoices.com/bengal-trifles/the-tale-of-fertilizers/

চাইলে একবার ওপরের লিঙ্কে ক্লিক করে পড়ে নিন। তাহলেই বুঝবেন এইযে শাকসব্জি-আনাজপাতির দামে আগুন লেগেছে তার সাথে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কোন সম্পর্ক নেই। এরজন্য দায়ী সরকার বাহাদুরদের দুর্নীতি ও অবিমিশ্রকারিতা এবং জনসাধারণের রাজনৈতিক ঔদাসীন্য।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্রঃ-
a) https://www.moneycontrol.com/news/business/economy/26-states-uts-faced-6-plus-cpi-inflation-in-april-8514921.html
b) https://www.moneycontrol.com/news/business/economy/wpi-inflation-rises-further-to-15-08-in-april-from-14-55-in-march-8515411.html
c) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-05-17/202205170015005.jpg&category=0&date=2022-05-17&button=
d) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-05-17/202205170022306.jpg&category=0&date=2022-05-17&button=