অপরাজিত’র পাঁচালী / The Ray

বাঙালি মানে রাজনীতি সচেতন। একসময় সেকথা খাটলেও আজ কোনোমতেই সেই বিষয় একমত হওয়া যায় না। রাজনীতি বিষয়টাই আজ শুধু বিনোদনের এবং অপসংস্কৃতির দ্বারা পরিচালিত। নীতিহীন রাজত্বই আজকের রাজনীতি। শিল্প সংস্কৃতি সবকিছুই আজ দলদাসত্ব এবং ব্যক্তিপুজায় নিয়জিত। আর তথাকথিত রাজনৈতিক সচেতন বাঙালী ভোটের দিন শাসক আশ্রিত দুষ্কৃতীদের দাপটে ভীত হয়ে, ভোট দিতে বুথে বুথে লাইন না দিয়ে, মাংসের দোকানে লাইন দিয়ে মাংস কিনে বাড়ি ফিরে দরজায় খিল তুলে এমন নৈরাজ্যেই “তা” দিয়ে আসছেন। যদিও তারপরেও এই বাঙালীই ফি বছর ১৫ই আগস্ট বা ২৬শে জানুয়ারি পাড়ায় পাড়ায় অলিতে গলিতে জাতীয় পতাকা তুলে গলা কাঁপিয়ে নিজেদেরকে নেতাজী সুভাষের বাংলার, ক্ষুদিরাম-মাস্টারদা-গণেশ ঘোষের বাংলার, প্রীতিলতা-মাতঙ্গিনী-কল্পনা দত্তের বাংলার, বিনয়-বাদল-দীনেশের বাংলার বাসিন্দা বলে কলার তুলতে লজ্জা পায় না।

ফলে এমন বেহায়া কপর্দকশূন্য বাঙালীর পূজ্য রবি ঠাকুর বা গর্বের সত্যজিৎকে নিয়ে রাজনীতিবিদ এবং তার পার্ষদবর্গ লোফালুফি খেলবেন না, এমনটা হতেই পারে না। বরং না হলেই আশ্চর্য্য হতাম। ঠিক যখন জনৈক শ্মশ্রুগুম্ফ সজ্জিত মুখে ‘রবি ঠাকুর নিজের হাতে “অং বং চং” কবিতার জন্য তেনাকে পুরস্কৃত করতেন’ শুনে দুকানে আঙ্গুল দিয়েছি, ঠিক তার অব্যবহিত পরেই দেখলাম, সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি পথের পাঁচালীর বায়োপিক “অপরাজিত” সরকারি তরফে রাজনীতির শিকার হল। মানে দুকানে আঙ্গুল দেওয়াই যথেষ্ঠ নয়, দু চোখ ঢেকে ফেলাও উচিৎ ছিল আমাদের।

সত্যজিৎ রায়।

হ্যাঁ, শুধু এই নামটাই যথেষ্ঠ। আপামর বাঙালীর আবেগ জড়িয়ে আছে এই নামটার সাথে। কারণ কান-মস্কো-বার্লিন-ভেনিস ইত্যাদি প্রায় সব চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্তি থেকে অস্কার অথবা দাদা সাহেব ফালকে, ম্যাগসাইসাই বা লিজিয়ন অফ অনার থেকে শুরু করে ভারত রত্ন, এমন অসংখ্য পুরস্কার ও খেতাব যার মুকুটে, সেই নামটি হল সত্যজিৎ রায়। আর তাঁর নির্মিত প্রথম ছবি “পথের পাঁচালী”র বায়োপিক “অপরাজিত” কিনা পরাজিত হল বাঙালির নির্বাচিত শাসকের সামনে। কারণ “অপরাজিত”র পরিচালক বামমনস্ক এবং শাসকদলের কঠোর সমালোচক। তাই তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্র সরকারি প্রেক্ষাগৃহ নন্দনে দেখানো হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে। অথচ এই নন্দনের নামকরণ থেকে লোগো নির্মাণ, এমনকি উদ্বোধক ছিলেন সত্যজিৎ রায় স্বয়ং নিজে।

না, তাতে অবশ্য “অপরাজিত”কে থামানো যাচ্ছে না। স্বয়ং সত্যজিৎপুত্র সন্দীপ সিনেমাটি দেখে উচ্ছ্বসিত। উচ্ছ্বসিত আপামর বাঙ্গালী। ইতিমধ্যেই এই ছবি নজরকাড়া রেটিং পেল আইএমডিবিতেও। ১০-এ ৯.৩ রেটিং পেয়ে ‘অপরাজিত’ এখন IMDb-র তালিকায় শীর্ষে। মুম্বইয়ে ছবি প্রদর্শনীর দুর্দান্ত সাফল্যের পর ‘অপরাজিত’ বিদেশেও পাড়ি দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের মর্যাদাপূর্ণ ‘লন্ডন ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’ ও ‘টরন্টো আন্তর্জাতিক ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল’-এ আমন্ত্রিত ‘অপরাজিত’। সেখানে বিশেষ প্রদর্শনী হবে এই ছবির।

“অপরাজিত”র পরিচালক অনীক দত্ত বামমনস্ক হলেও তাতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন শাসকদলের যুব সংগঠনের সভাপতি। না, দলীয় সংকীর্ণতায় বাধা আসেনি।

চরিত্রের প্রয়োজনে, পরিচালক নিজে রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে তাঁকে বেছে নিয়েছেন ওনার অভিনয় দক্ষতাকে মর্যাদা দিয়ে। কিন্তু শাসকদল সেই সংকীর্ণ রাজনীতির উর্ধ্বে উঠতে পারেলেন কই?

এই মুহুর্তে নন্দনে সগর্বে চলছে শাসকদলের টিকিটে জেতা সাংসদ-বিধায়কদের প্রযোজিত/অভিনীত তিন-তিনটি বাণিজ্যিক সিনেমা। তাই “অপরাজিত” নাকি স্লট পায়নি। কিন্তু আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন নন্দন প্রেক্ষাগৃহটি সরকারের তরফে বানানো হয়েছিল মূলতঃ নান্দনিক ‘অফবিট’ সিনেমা প্রদর্শনের জন্য। সেজন্যেই সত্যজিৎ-মৃণালদের মত কালজয়ী পরিচালকরা পেক্ষাগৃহটি নির্মাণের সময় থেকে এর সাথে বিভিন্নভাবে যুক্ত ছিলেন। মূলস্রোতের বাণিজ্যিক সিনেমা প্রদর্শনের জন্য এখনতো শহরে মল-মাল্টিপ্লেক্সের ছড়াছড়ি। সেখানের কোন একটিতে নন্দনে এই মুহুর্তে চলমান তিনটি বাণিজ্যিক ছবির কোন একটিকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে “অপরাজিত”কে জায়গা ছেড়ে দিলে, এমন অবাঞ্ছিত লজ্জাজনক বিতর্ক তৈরি হত না। কারণ “অপরাজিত”র নান্দনিক আবেদনের জন্যই “নন্দন”এর নির্মাণ। কাজেই যারা “স্লট খালি নেই”, “একসাথে অনেক গুলো বাংলা সিনেমা মুক্তি পেয়েছে” ইত্যাদি ছেঁদো যুক্তি দিচ্ছেন তাদের সাথে আমরা “রাইজ অফ ভয়েসেস”একমত নই।

চিত্রপরিচালক অনীক দত্তের রাজনৈতিক পরিচয়ের ধুয়ো তুলে যেভাবে পথের পাঁচালীর বায়োপিককে “নন্দন” অলিন্দে ব্রাত্য করার অভিযোগ উঠছে তা এক কথায় নজিরবিহীন। এর আগে সিনেমার বিষয় নিয়ে বাদ-বিচার করতে গিয়ে হার্বাট, আরেকটি প্রেমের গল্প, স্থানীয় সংবাদ বা কাগজের নৌকোর মত সিনেমাকে নন্দনে বাদ দেওয়া হয়েছিল এবং তা নিয়ে বিতর্কও কম হয় নি। কিন্তু বারবার কেন এমনটা হচ্ছে? কেন এমনটা হবে?

তা সে যে রাজনৈতিক দলের সরকারই হোক না কেন, সরকারকে বুঝতে হবে, শিল্প-সাহিত্য-সিনেমার উৎকর্ষতা আসে স্বাধীন চর্চার পরিসরে। কাজেই নন্দন খাতায় কলমে সরকারি প্রেক্ষাগৃহ হলেও তার সিনেমা নির্বাচনে নন্দন কর্তৃপক্ষের কিছু স্বাধীনতা থাকা জরুরি। তা নাহলে সরকারকে সামনে রেখে শাসকদলের মাতব্বরির যে অভিযোগ অতীতে উঠেছে এবং আজ উঠছে তা কোনদিন থামবে না। তারপর পদলেহনকারীদের ভিড়ে শাসকরা বারবার এভাবেই রাস্তা হারিয়ে ফেলবেন!

আর আমরাও সেই ভুলের ভুলভুলাইয়াতে ঘুরতে থাকব।
পরিশেষে, এ ছবির বিষয় আমাদের গর্বের সত্যজিৎ ও তার পথের পাঁচালী, যা ভারতীয় সিনেমাকে আন্তর্জাতিক আঙিনায় যাওয়ার রাস্তা দেখিয়েছিল। কাজেই দয়া করে ডাউনলোড করে মোবাইল বা ল্যাপটপ চালিয়ে ঘরে বসে না দেখে পরিবারের সাথে সকলকে নিয়ে প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে অপরাজিত দেখে আসুন। বাণিজ্যিক সাফল্যেও দশ গোল দিক এই সিনেমা। তবেই অনীক দত্তের মত চিত্র পরিচালকরা আরও বেশি করে এমন সাহসী সিনেমা নিয়ে এগিয়ে আসতে উৎসাহিত হবেন। পাশাপাশি সরকার বাহাদুর এবং নন্দন কর্তৃপক্ষও বুঝতে পারবেন ভালো সিনেমার কদর করতে হয়। সব কিছুকে রাজনৈতিক গুণিতকে গুণ করা ঠিক নয়।

পুনশচঃ কোন সিনেমাকে ট্যাক্স ফ্রি করে দেওয়ার বিরোধী আমরা। সরকারের ঘরে এক পয়সা ট্যাক্স না দেওয়া সিনেমার প্রযোজক পরিচালকদের “দেশপ্রেমী” ভাবতে আপত্তি আছে আমাদের।