অপরাজিত / Aparajito Film Review

দুদিন আগে রাইজ অফ ভয়েসেসের পাতায় “হামারে নেতা ক্যায়সা হো” প্রতিবেদনে বর্তমান নায়কদের “ঝুকেগা নেহী” টাইপ চরিত্র এবং সমাজের ওপর তার প্রভাব নিয়ে তুলোধোনা করা হয়েছিল। অনেকে তাতে যেমন সমর্থন জানিয়েছিলেন, অনেকে আবার ছুড়ে দিয়েছিলেন তীর্যক মন্তব্য। প্রতিটি মন্তব্যকেই স্বাগত এবং মন্তব্যকারীদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আজ আমরা রিভিউ করছি অনীক দত্তের “অপরাজিত” ছবির।

বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর ‘লোক রহস্যের বাবু বৃত্তান্ত’-এ এই আরোপ এনেছিলেন এবং নীরদ সি চৌধুরী ‘আত্মঘাতী বাঙালী’তে বাঙালী হল এক আত্মবিস্মৃত জাতি প্রতিপন্ন করে ছেড়েছিলেন। ইদানীং আর একদলের আবির্ভাব হয়েছে যারা বাঙালি অস্মিতাকে গুটখাবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করার প্রবল প্রচেষ্টা করছে। কিন্তু আমাদের স্ব-জাত্যাভিমানের যথেষ্ট কারণ আমাদের রাজনীতিবোধ, আমাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চা; আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাসে প্রদীপ্তমান। বাংলা সাহিত্য, বিশেষত বাংলা উপন্যাসের তুলনা বিশ্বসাহিত্যে মেলা ভার, কিন্তু তার যথাযথ স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক মঞ্চে মেলে না, তার কারণ ভালো ইংরেজি অনুবাদ না হওয়া। সাহিত্যে তবু রবিঠাকুর ছিলেন, নিজেই তিনি সেই বেড়া ডিঙিয়েছিলেন। চলচ্চিত্র একটা অসাধারণ শিল্পমাধ্যম যার এই ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা নেই, নিজস্ব ভাষায় ভর করে সে সহজেই আন্তর্জাতিক হয়ে উঠতে পারে। সম্প্রতি বাংলা চলচ্চিত্রের আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠার সেই উজ্জ্বল ইতিহাস লেখা হল। ডি.ডব্লিউ. গ্রিফিথের পরিচালিত ‘দ্য বার্থ অফ এ নেশন’ দেখে উডরো উইলসন বলেছিলেন, “আলো দিয়ে ইতিহাস লেখা হয়েছে”, অনীক দত্তের ‘অপরাজিত’ তেমনই আলো দিয়ে লেখা বাঙালির চলচিত্রচর্চার উজ্জ্বল ইতিহাস।

বিমল রায়ের ‘উদয়ের পথে’র (১৯৪৪) হাত ধরে বাংলা সিনেমা প্রথম হামাগুড়ি দিতে শুরু করলেও সত্যজিৎ রায় সেই পথে হাঁটতে চাননি। তিনি চলচ্চিত্রের ভাষাপাঠ নিয়েছিলেন জঁ রেনোয়া, ফ্রাঙ্ক ক্যাপ্রা, ভিত্তরিও দে সিকাদের কাছে।

১৯৪৯ সালে রেনোয়া হুগলি নদীর উপর একটি ফিল্ম বানাতে এসেছিলেন কলকাতায়। সত্যজিৎ রায় তাকে শুটিং লোকেশন খোঁজার কাজে সাহায্য করতে গিয়ে ফিল্মমেকার হওয়ার অনুপ্রেরণা পান। রেনোয়া’র কাছেই ফিল্মের পাঠ নেবার সৌভাগ্য হয় পথের পাঁচালীর চিত্রগ্রাহক সুব্রত মিত্রের। পেশাগত কারণে আম আঁটির ভেঁপুর প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করতে গিয়ে পথের পাঁচালী পড়া সত্যজিৎ রায়ের। আর পেশাগত কারণেই লণ্ডনে গিয়ে দে সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস্’ দেখা। ব্যাস্, সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম সেরা একটি চলচ্চিত্র নির্মাণে নেমে পড়া। সেই নির্মাণ যা দেখে আকিরা কুরোশাওয়া বলেছিলেন, ” সিনেমাটা না দেখা মানে চাঁদ সূর্য না দেখে এই গ্রহে বেঁচে থাকা।” সেই ইতিহাসের সাথে আমাদের মতো আম বাঙালির পরিচয় করানোর চেষ্টা অনীক দত্ত করেছেন।

অনীক দত্ত ছবিটা সাদাকালোয় বানিয়েছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না সেজন্য ছবির টেক্সচার, ডেপ্থ, কনট্রাস্ট যেমন বেড়েছে তেমনি সিনেমায় ডক্যুমেন্টারী সুলভ সিরিয়াসনেস এসেছে, যা দর্শকের চোখ প্রথম থেকেই পর্দায় টেনে রাখে। অনীকের গল্প বলার ধরণটিও চমৎকার। ফ্ল্যাশব্যাক নেই, নেই অতিকথন, একদম নির্মেদ ও সরলরৈখিক নিক্ষেপ। অনীক দত্তের এই সিনেমায় সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে জিতু কামাল চেহারায় যেমন মিলেছেন, তেমনই চন্দ্রাশীষ রায়ের ব্যারিটোনে দর্শকের তাকে সত্যজিৎ রায় ভাবতে অস্বস্তি হয় না। বিজয়ার চরিত্রে সায়নী খুব মানানসই অভিনয় করেছেন।

তবে একটি ছোট সমালোচনা আছে। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের চরিত্র চিত্রণটি আরেকটু ঋজুত্বের দাবী রাখে এবং তাতে সত্যজিৎ রায়ের উচ্চতা খর্ব হতো বলে আমার মনে হয়নি। তবে অপরাজিত একটি অপূর্ব সৃষ্টি, এমন একটি উপহারের জন্য পরিচালক অনীক দত্তের অনেক অনেক অভিনন্দন প্রাপ্য।

পরিশেষে এমন নান্দনিক সিনেমার “নন্দন-বঞ্চনা” বাঙ্গালীকে “আত্মঘাতী” “আত্মবিস্মৃত” বানাল কিনা সেটা সত্যি এবার ভাববার সময় এসে গেছে।

রাইজ অফ ভয়েসেসের রেটিং : ৪/৫

কেজিএফ-২, পুষ্পা: দ্য রাইজ ছবির নায়কের চরিত্রায়ন এবং সমাজে প্রভাব: https://riseofvoices.com/pentagony/what-kind-of-leader-do-you-want/