শিল্প যখন স্বপ্নে / Bengal Means Business
![শিল্প যখন স্বপ্নে / Bengal Means Business](https://riseofvoices.com/wp-content/uploads/2022/04/png_20220419_104650_0000-845x550.png)
“বেঙ্গল মিন্স বিজনেস।”
সক্কাল বেলা খবরের কাগজের পাতা খুলতেই সাদা-নীল প্রেক্ষাপটে বাংলার শিল্প সম্ভাবনাকে উসকে দিয়ে মাননীয়ার এমন পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন মন ভালো করে দেয়। কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে, এমন বিজ্ঞাপন বিগত এক দশকে কম দেখিনি। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়েছে কি!
যদি কাজের কাজ হত, তাহলে কি একটা স্কুল টিচারের চাকরির জন্য এসএসসি/টেট পরীক্ষা উত্তীর্ণ বাংলার শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা, সরকার আর পুলিশের থেকে দুনিয়ার লাথি ঝ্যাঁটা খেয়েও এভাবে দিনের পর দিন ফুটপাথে বসে থাকত! নাকি এমএ/বিএ/এমবিএ করা ছেলেমেয়েরা চা-চপের দোকান দিত অথবা ট্রেনে হকারি করত আর সরকারকে তার পেটোয়া সংবাদমাধ্যম আর ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে “কোন কাজই ছোট নয়”, “নিজের পায়ে দাঁড়ানোটাই আসল” এমন সব আপ্তবাক্য আওড়াতে হত! এমনকি পাড়ায় পাড়ায় লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের মাসিক পাঁচশ-হাজার টাকা ভাতার জন্য হাজার হাজার মানুষের যে লাইন পড়ছিল, সেটাও এই কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতার দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের অভিমত।
এর আগে প্রতিটা বিজনেস সামিটের শেষে হাজার-হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের যেসব গপ্পো রাজ্যের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীরা আমাদের শুনিয়েছিলেন তার বেশিরভাগই যে “জল” ছিল তা সরকারের দেওয়া পরিসংখ্যানেই স্পষ্ট। সরকারের দাবী মত বিগত পাঁচটি শিল্প সম্মেলনে ১২ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োয়াগের প্রস্তাব এলেও, এই সময় কালে কার্যক্ষেত্রে মাত্র ৩৭ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ বাস্তবায়িত হয়েছে। মানে এই যে শিল্প সম্মেলনের ঢ্যাঁড়া পেটানো হয় রাজ্য জুড়ে তার সাফল্যের হার মাত্র ৩%।
এর পাশাপাশি মাস পাঁচেক আগে নভেম্বরের প্রথমদিকে যে ‘স্টেট অফ এনভায়রনমেন্ট রিপোর্ট, ২০২১’ সামনে এসেছে তাতে দেখা যাচ্ছে ২০১৬ থেকে ২০২১ এই পাঁচ বছরে রাজ্যে ২১০০০ এরও বেশি বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্রশিল্পক্ষেত্র বন্ধ হয়ে গেছে। এর মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া বৃহৎ শিল্পের সংখ্যা ২৭১। সবথেকে বেশি কলকারখানা বন্ধ হয়েছে দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা, পূর্ব মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ এবং জলপাইগুড়িতে।
আর এসবের মধ্যেই মুখ লুকিয়ে রয়েছে বাংলার বেকারত্বের বেহাল দশার আসল কারণগুলি।
তারওপর ইদানীং গোদের ওপর বিশ ফোঁড়া হয়ে হাজির হয়েছে শিল্পক্ষেত্রেও স্থানীয় শাসক আশ্রিত দুষ্কৃতীদের কোম্পানিগুলির কাছ থেকে কাটমানি আদায়ের প্রবণতা। এমনকি নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে তোলাবাজিরও বিস্তর অভিযোগ ইদানীং সামনে চলে আসছে। এ প্রসঙ্গে হলদিয়ার ইন্দোরামা সার কারখানা, এক্সাইড ব্যাটারির কারখানা, কানোরিয়া গ্রুপের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র এবং ডায়মন্ডহারবারের আইএফবি এগ্রো’র মত প্রথম সারির কিছু কোম্পানিও রয়েছে। এদের কয়েকটির কথা এর আগে আমরা রাইজ অফ ভয়েসেসের অন্যান্য প্রতিবেদনে উল্লেখও করেছি। সময় সুযোগ পেলে তোলাবাজির দাপটে বিরক্ত এই সমস্ত শিল্পপতিরাও যে বাংলা থেকে পাত্তারি গোটাবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আর এভাবে শিল্প ও ব্যবসা বাণিজ্যের পরিসর যত কমতে থাকবে তা যে শুধু বেকারত্বের হার বাড়াবে তাই নয়, এরফলে সরকারী কোষাগারে এই সমস্ত শিল্পক্ষেত্র থেকে কর বাবদ রাজস্ব আদায়ের যে ঘাটতি তৈরি হবে, তাকে সামাল দিতে রাজ্যের ঘাড়ে বাড়তে থাকবে ঋণের বোঝাও। ইতিমধ্যেই বিগত এক দশকে রাজ্য সরকারের করা ঋণের পরিমাণ ২০০% বৃদ্ধি পেয়ে ২ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ৬ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। এই মুহুর্তে শিল্পায়ন ছাড়া এই পরিমাণ ঋণ আদৌ পরিশোধ করা সম্ভব কিনা, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে।
আর এই প্রেক্ষাপটে বিগত পাঁচ বছরে রাজ্যে শিল্পক্ষেত্রে নতুন বিনিয়োগের এমন লজ্জাজনক হারের পাশাপাশি ২১০০০ শিল্পসংস্থার বন্ধ হয়ে যাওয়া এক অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে আমাদেরকে ঠেলে দিচ্ছে। কাজেই শুধু বিজনেস সামিট করে বিনিয়োগের গল্প দিলেই হবে না, তার বাস্তবায়নের দিকে জোর দিতে হবে। আশা করব আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী এবার সেদিকটাতেও নজর দেবেন। আর সেইসঙ্গে যে শিল্প প্রতিষ্ঠান গুলি ইতিমধ্যেই রাজ্যে বিনিয়োগ করেছে বিগত পাঁচ বছরে তাদের মধ্যে এরকম হঠাৎ রাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার হিড়িক কেন পড়ল বা কেন তাদের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল তারও যথাযথ তদন্ত হওয়া উচিৎ বলে আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস মনে করি। পাশাপাশি কাটমানি-তোলাবাজির দাপট বাংলার শিল্প ও বিনিয়োগ মানচিত্রের বুকে যাতে কোন প্রশ্ন চিহ্ন এঁকে না দিতে পারে সে ব্যাপারেও মুখ্যমন্ত্রী ও তার প্রশাসনকে আরও যত্নবান হতে হবে এবং রাজনৈতিক রং না দেখে যথাযথ প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। আর শুধু “হরতাল, ধর্মঘট সমর্থন করি না” বলে যে শিল্পক্ষেত্রে রাজ্যের পশ্চাদসরণ আটকানো সম্ভব নয় এটাও বুঝতে হবে।
পরিশেষে, যারা একসময় ৩৪ বছরে রাজ্যের নানান শিল্পক্ষেত্র বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে গগণবিদারী চিৎকার করে আমাদেরকে সচেতন করতেন, সেই সংবাদমাধ্যমের বিগত পাঁচ বছরে রাজ্যজুড়ে ২১০০০ কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে এমন নীরবতা আমাদেরকে অবাক করেছে। সেকি কেবল “বেঙ্গল মিন্স বিজনেস” এর মত পাতাজোড়া/পর্দাজোড়া বিজ্ঞাপনের লোভে কিনা, বাংলার মানুষ জানতে চায়।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
তথ্যসূত্র
a) https://www.etvbharat.com/english/national/state/west-bengal/decline-of-west-bengal-industrial-units-raises-concern/na20211101204618280
b) https://banglahunt.com/in-west-bengal-more-than-21000-industries-closed-in-5-years/
c) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-04-19/202204182339251.jpg&category=0&date=2022-04-19&button=
Comments are closed.