বঙ্গ বেদুইন / Bengal Bedouins at Paniarchar

সরকারের জমি চাই। কেন চাই! তার উত্তর বিভিন্ন, নানা মুনির নানা মত। কেউ বলছেন শিল্পতালুক হবে, কেউ বলছেন পর্যটন কেন্দ্র হবে, কেউ বলছেন নারায়ণী সেনা ছাউনি হবে। আসলে হবেটা কি, সেটা অনেকেই ঠিক মত বলতে না পারলেও, বেশ কিছু মানুষের মতে পানিয়ারচরে শিল্পতালুক গড়ে ওঠার দাবি জোরদার। তবে স্থানীয় মানুষ বলছেন, “জীবন দেবো, জমি দেবো না।” কিন্তু কার তাতে কি বা আর আসে যায়।
রবি ঠাকুর লিখেছিলেন,
“ভদ্র মোরা, শান্ত বড়ো,
পোষ-মানা এ প্রাণ
বোতাম-আঁটা জামার নীচে
শান্তিতে শয়ান।
দেখা হলেই মিষ্ট অতি,
মুখের ভাব শিষ্ট অতি,
অলস দেহ ক্লিষ্টগতি,
গৃহের প্রতি টান—
তৈল-ঢালা স্নিগ্ধ তনু
নিদ্রারসে-ভরা,
মাথায় ছোটো বহরে বড়ো
বাঙালিসন্তান।”
তাই সরকারের আজ জমি চাই। সাংবাদিকরা প্রায় প্রতিদিন সেখানকার মানুষের সাথে কথা বললেও, প্রকাশ করতে পারছেন না মিডিয়ায়। “পজিটিভ নিউজ” করার দায়বদ্ধতা হয়তো।
জায়গার নাম পানিয়ারচর, কলকাতা থেকে ৬০০ কিলোমিটার দূরে তিস্তা নদীর বুকে মুসলিম অধ্যুষিত এক ছোট্ট নদীর চর। যেখানে বাস করে প্রায় ৩৭০ টি পরিবার, প্রায় ১২০০ এর ওপরে মানুষ। হলদিবাড়ি আর মেখলিগঞ্জ ব্লকের সংযোগকারী পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘতম, “জয়ী সেতু” মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এই চরের পাশেই। নিস্তরব গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ১০০০ একরের পানিয়ারচরে বাম আমলে তৈরি একটি শিশু শিক্ষা কেন্দ্র (এসএসকে) এবং দুটি আইসিডিএস কেন্দ্র থাকলেও, গ্রামে অষ্টম শ্রেণী উত্তীর্ণ মানুষের সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। চরের মানুষদের জীবিকা প্রধানত কৃষিকাজ। ভুট্টা, ধান, পাটের ওপরেই এদের জীবন-জীবিকা। বিদ্যুৎ থেকে সেচের ব্যবস্থা, সবই আছে, চরের বাসিন্দারাও নিয়মিত খাজনা দেন। কিন্তু এদের বসবাস পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ পাঁচজনের মতন না, অনেকটাই আলাদা।
যেহেতু তাদের বাস তিস্তা নদীর চরে, তাই বছরের বিভিন্ন সময়ে তিস্তার উত্তাল জলের আক্রমণ তাদের নিত্যসঙ্গী। প্রতি বর্ষায় তাদের বাসায় যখন জল ঢোকে, তখন তারা চরের অপেক্ষাকৃত উচু জায়গায় তাদের বাসা বাঁধেন। আবার জল সরে গেলে ফিরে আসেন আগের জায়গায়, অনেকটা “আরব বেদুইন”দের মতন, আজ এখানে, কাল সেখানে। হাসি মুখেই মেনে নিয়েছেন তারা এই জীবন, প্রায় একশ বছর ধরে। কিন্তু প্রশাসনের সৌজন্যে আরো কিছু দুর্ভোগ যুক্ত হয়েছে এদের জীবনে। “আজ এখানে, কাল সেখানে” জীবনে অভ্যস্ত মানুষগুলোর ভিটে-মাটি চিরতরে ছাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
শিল্পতালুক হবে, নাকি পর্যটন কেন্দ্র হবে, নাকি নারায়ণী সেনা ছাউনি হবে, তা জানা না থাকলেও জমি লাগবে শাসকের। তিস্তা নদীর বুকে পানিয়ারচর ২৫ পয়স্তিতে প্রায় ৩৭০ পরিবারকে উচ্ছেদ করে দিতে মেখলিগঞ্জ মাহকুমা প্রশাসন হঠাৎই তৎপর হয়ে উঠেছে। প্রসঙ্গত সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘতম, “জয়ী সেতু” তৈরি হওয়ার পর, সরকার নতুন করে বাঁধ দেওয়ায় প্রায় ৩০০ একর নতুন জমির সন্ধান পাওয়া গেছে এই অঞ্চলে। তাই আজ আন্তর্জাতিক সীমানার কাছাকাছি পানিয়ারচরের জমির মোট আয়তন, পশ্চিমবঙ্গের বাতিল শিল্পতালুক সিঙ্গুরের মতন, প্রায় ১০০০ একর।
গত ৭ এপ্রিল, প্রশাসন উচ্ছেদের অভিমুখ নিয়ে কোন আলোচনা ছাড়াই হঠাৎই জমি জড়িপের কাজ শুরু করে। ফলশ্রুতিতে চরের বাসিন্দারা গর্জে ওঠেন এবং প্রত্যাশা মত পুলিশ বাধা দেয় গ্রামবাসীদের। এরই মধ্যে ঘটনাস্থলে আসেন অল ইন্ডিয়া কিসান সভার একটি প্রতিনিধি দল। তারপর প্রশাসন এবং গ্রামবাসী-এআইকেএস প্রতিনিধিদের প্রবল বাক-বিতন্ডার মধ্যে প্রশাসন আপাতত পিছু হটে।
তারপর গত ১৪ এপ্রিল, আমরা রাইজ অফ ভয়েসেসের প্রতিনিধিরা পৌঁছেছিলাম পানিয়ারচর। কথা হল গ্রামের মানুষের সাথে। সবার মনেই একটা চাপা উত্তেজনা, ভিটে-মাটি হারানোর ভয়।
“চর থেকে সরকার আমাদের সরে যেতে বলেছে। কিন্তু, আমরা যাব কোথায়?” আমাদের জানালেন পানিয়ারচরের এক বাসিন্দা। বাসিন্দাদের দাবি, তারা সরে যেতে পারেন, তবে তার আগে চরের বাসিন্দাদের উপযুক্ত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা সরকারকে করতে হবে। নয়তো তারা আন্দোলনে নামারও কথা ভাবছেন বলে আমাদের জানিয়েছেন। যদিও মেখলিগঞ্জের মহকুমাশাসক রাম তামাং এক প্রথমসারির সংবাদপত্রের কাছে জানিয়েছেন, চর এলাকার বিষয়টি নিয়ে বাসিন্দাদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সমস্ত বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
এই কথা জানার পর, স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, “যদি জেলাশাসক বাসিন্দাদের সাথে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেন, তবে বাসিন্দাদের সাথে কথা না বলে কেন জমি জরিপের জন্যে লোক পাঠালেন?”
এলাকার বাসিন্দাদের একটি অংশ অবশ্য সরকারের কাছে তাদের জমি হস্তান্তর করতে রাজি আছেন। যদিও তারা সরকারের কাছে শর্ত রেখেছেন, প্রতিটি পরিবারকে, বসবাস এবং চাষের জন্যে অন্তত এক একর জমিসহ স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করা হলেই, তারা চর থেকে সরে যাবেন। আর তা না হলে, তারা অমরণ অনশনে বসবেন।
এর মধ্যেই পানিয়ারচরে পৌঁছলেন তমসের আলী, বিপিন শীল, অনন্ত রায়, আকিক হাসান সহ এআইকেএস প্রতিনিধি দল। দুপুর রোদেই চলল গ্রামবাসীদের সাথে এআইকেএস প্রতিনিধি দলের দীর্ঘ আলোচনা।
আমাদের ফেরার সময় স্থানীয় এক বাসিন্দা বললেন “জান থাকতে হারবো না, জন্মভিটা ছেড়ে যাব না বাবু।”
আবারও মনে পড়ল রবি ঠাকুরের “দুরন্ত আশা” কবিতার বাকি অংশ,
“ইহার চেয়ে হতেম যদি
আরব বেদুইন!
চরণ-তলে বিশাল মরু
দিগন্তে বিলীন।
ছুটেছে ঘোড়া, উড়েছে বালি,
জীবন-স্রোত আকাশে ঢালি
হৃদয়-তলে বহ্নি জ্বালি
চলেছি নিশিদিন—
বর্শা হাতে, ভর্সা প্রাণে,
সদাই নিরুদ্দেশ
মরুর ঝড় যেমন বহে
সকল-বাধা-হীন।”
ফেরার সময় ট্রেনের কামরায় বসে, ভাবছিলাম, আমরা শহুরে “বাবু”রা কি বা আর করতে পারি? হয় মেনে নিতে, অথবা কলম ধরতে পারি, খুব বেশি হলে পাড়ার চায়ের দোকানে বসে তুফান তুলতে পারি। এর থেকে বেশি কিছু করা কি সম্ভব সাধারণ শহুরে “বাবু”দের? জানান আমাদেরকে।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
তথ্যসুত্র :
a) https://bartamanpatrika.com/home?cid=16&id=346035
b) https://bengali.abplive.com/district/cooch-behar-local-people-of-mekliganj-demand-more-compensation-for-giving-away-land-for-factory-879516
c) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-04-15/202204142210545.jpg&category=0&date=2022-04-15&button=
Comments are closed.