পেঁয়াজি না, পেঁয়াজের ন্যায্য দাম দিন / The Onion Files

এ দিগরে শুধু মাঠ আর মাঠ। মাঠের শেষে চাষিদের গাঁ। গাঁ শেষে আবার মাঠ। মুর্শিদাবাদের বাগড়ী। কোন মাঠে সোনা ফলে বলে গাঁয়ের নাম, সোনাটিকুরী। কেউ বলে, জমি তো নয় দুধের সর, তাই গাঁয়ের নাম দুধসর। গাঙ্গেয় বদ্বীপের উপরের দিকের এই ভূখণ্ড পৃথিবীর সেরা উর্বর মৃত্তিকাগুলির অন্যতম।

পৃথিবীর খুব কম মাটিতেই কাঁঠাল আর কাঁঠালী কলা পাশাপাশি হয়। এখানে মাঠের পর মাঠ এখন পেঁয়াজের আবাদ। পাটের চাষ এখন আর তেমন লাভজনক নয়, তাই চাষি তাকিয়ে থাকে পেঁয়াজের দিকে। এখন পেঁয়াজ ওঠার সময়। গাঁয়ের জোয়ান-মরদ, বো-ঝিয়েরা সবাই পেঁয়াজ তোলার কাজে ব্যস্ত। কথা বলার ফুরসত নেই কারো।

লুঙির কোঁচোর থেকে লাইটার বা’র করতে করতে রাইহান বলছিল, “এ ভুঁইটা কানাই মোড়লের। আমার বাপের বারো কাঠা খাসপাট্টা আছে। আর এই এক বিঘি বছরে পনেরো হাজার টাকার কন্টাকে করি।”

এখানে শুধু পেঁয়াজ আবাদের জন্যও জমি পাওয়া যায়। এক আবাদে কম করে বিঘায় দশ হাজার টাকা। কেমন খরচ চাষে ? রাইহান বলে, “অতো হিসিব নাই। হিসিব জানলি কি মাঠে চাষ করি?” কথার মাঝে নেপাল, মুনতাজরা এসে যোগ দিল আমাদের সাথে। মুনতাজ বলে, “বিঘি ভুঁইয়ে পুনেরো হাজার ধরেন।” নেপাল বলল, “পুনেরো হাজারে হাত পাবে না, কম করি’ কুড়ি ধরেন।”

ওদের তর্কের মাঝে আমি মোবাইলের ক্যালকুলেটার খুলে করে যোগ দিতে থাকলাম। নেপাল একনাগাড়ে বলে চলেছে, “শুরুতে তিনটি চাষ ৬০০ টাকা, এক বস্তা ডিএপি ২০৮০ টাকা, একটা মই ৩০০ টাকা, ভিলি করতে একটা মুনিষ ৩০০ টাকা, পেঁয়াজের চারা ৩০০০ টাকা, চারা জমিতে বসানোর জন্য আটটা মুনিষ ২৮০০ টাকা, কম করে দুটো সেচ ৭০০ টাকা, পাঁচ-সাত দিনের মাথায় ১০০ টাকার ইউরিয়া, তার দশ দিন পর ৪০০০ টাকার চাপান সার (পটাশ , সালফেট, ইউরিয়া, জিঙ্ক, ম্যাগনেসিয়াম), মাঝে দুবার নিড়ানী দিতে আটটা মুনিষ ২৪০০ টাকা। তিনবার বিষ দিতে ১৮০০ টাকা। আশি-নব্বই দিনের মাথায় পেঁয়াজ ওঠে। এক বিঘা জমির পেঁয়াজ তুলতে আটটা মুনিষের খরচ ২৪০০ টাকা, ট্রাক্টরের ট্রলিতে করে মাঠ থেকে চাষির উঠানে পেঁয়াজ বইতে খরচ ১২০০ টাকা তো বটেই।”

রাইহান বলল,” এ সবের সাথে জমির ভাড়া ১০০০০ টাকা যোগ করে মোট খরচা কতো হলো?”

আমি মোবাইল ক্যালক্যুলেটারে তাকিয়ে বললাম,” ২৭৬৮০ টাকা।”

হিসেবে শুনে ওদের তো সবার মাথায় হাত। এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজের ফলন কতো? এবছর অতিবৃষ্টিতে ফলন খুবই কম। সবাই যা বলল তাতে একটা গড় দাঁড়াল ২৫ কুইন্টাল। ষাট কেজির বস্তায় প্যাকিং করলে ঐ পেঁয়াজ ৪২ টি বস্তায় প্যাক করার খরচও চাষির। এক বস্তা পেঁয়াজের গাছ কেটে বাদ দেবার জন্য মুনিষ খরচ ২০ টাকা, বস্তার দাম ১২ টাকা, বস্তা সেলাই ও বস্তা গাদা দেবার মুনিষ খরচ ১০ টাকা। মোট ৪২ টাকা বস্তা পিছু খরচ। ৪৫ বস্তায় খরচ ১৮৯০ টাকা। সবাই একসাথে বলল, “এবার যোগ দেন।”

যোগ দাঁড়ালো ২৯৫৭০ টাকা। হিসেব শুনে ওদেরও চোখ কপালে। আমি তখনও ক্যালকুলেটারে হিসেব চালিয়ে যাচ্ছি। বললাম, “এক কেজি পেঁয়াজের উৎপাদন খরচ হলো ১১ টাকা ৮০ পয়সা। কি দাম পাচ্ছেন আপনারা?”

রাইহানের বিড়িটা শেষ। প্রখর হয়েছে রৌদ্র। বাতাসে কাঁচা পেঁয়াজের গন্ধ যেন হাহাকার করছে। ২০০৬ সালে ড. স্বামীনাথন কমিশন উৎপাদন খরচের দেড় গুণ দাম ন্যুনতম সহায়ক মূল্য হিসেবে কৃষকের রক্ষাকবজ দাবি করেছে। দশক পেরিয়ে সেই দাবিতেই রাজধানী সহ উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজপথ উত্তাল হয়েছে কৃষকের মিছিল আর লঙমার্চে। ২০১৪-র আচ্ছে দিনের প্রতিশ্রুতিতে একথা ছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন তিনি এরাজ্যে কৃষকের আয় তিনগুণ করেছেন। এদিকে নেপাল-রাইহানরা ১১.৮০ টাকায় পেঁয়াজ উৎপাদন করে ৬ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৯ টাকায় বেচতে বাধ্য হচ্ছেন। স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ মতো কমপক্ষে যেটুকু দাম কৃষকের অবশ্যই পাওনা তা হল কেজিতে ১৭.৭০ টাকা। এটা কৃষকের হক। দয়ার দান নয়, হকের দাবিতে রাইহান, নেপালরা কবে জোট বাঁধবেন সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।

প্রতিবেদনে ব্যবহৃত কিছু গ্রামীণ শব্দের অর্থ

আবাদ = চাষ
ভুঁই = জমি
খাসপাট্টা = ভেস্ট ল্যান্ড কারো দখলিকৃত থাকলে সরকার তার নামে পাট্টা বিলি করে
বিঘি = বিঘা
কন্টাক = টাকার বিনিময়ে জমি ভাড়া দেওয়া
ডিএপি = সার
মই = লাঙল দেবার পর জমির মাটি সমান করার জন্য মই দেওয়া হয়
ভিলি = ভিলি আলু চাষের ক্ষেত্রে লাগে
মুনিষ = জমির লেবার / ক্ষেতমজুর
সেচ = জল দেওয়া
চাপান = জমিতে সার প্রয়োগের আরেক নাম। দু’বার সার দিলে দু চাপান এরকম বলা হয়
নিড়ানী = আগাছা পরিষ্কার
বিষ = পেস্টিসাইড
বস্তা গাদা = বস্তা বন্দি করে একজায়গায় জমিয়ে রাখা (গাদা মারা)