“ব” আসছে বুকে / The Badge

সম্প্রতি মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, সমস্ত সরকারি স্কুলের ইউনিফর্মের রং হবে নীল-সাদা এবং ছাত্রছাত্রীদের ইউনিফর্মে জ্বলজ্বল করবে মুখ্যমন্ত্রীর নিজের হাতে আঁকা “বিশ্ববাংলা”র ব্যাজ। এই রকম ব্যাজ ছাত্রছাত্রীদের পোশাকে ব্যবহার হওয়া উচিৎ কি উচিৎ নয়, তা নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে বিস্তর লেখালেখি হচ্ছে। তাই নিয়ে আমরা আলোচনায় যাচ্ছি না। কিন্তু কেন “ব” আসছে বুকে, এর ঐতিহাসিক এবং আন্তর্জাতিক গুরুত্ব কতখানি, তাই নিয়েই বরং আলোচনা করা যাক।

পশ্চিমবঙ্গের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, শ্রী ব্রাত্য বসু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, “বিশ্ব বাংলার লোগোর মাধ্যমে মুখ্যমন্ত্রী বলতে চাইছেন, বাংলা কেবলমাত্র একটা স্থানিক আবেগ নয়। এর সঙ্গে একটা আন্তর্জাতিকতাবাদ জড়িয়ে আছে। এই লোগো উপনিবেশবাদের স্মৃতি সরিয়ে বাংলার অস্মিতাকে আবার আগের মতো সর্বোচ্চে নিয়ে যেতে চাওয়ার প্রথম ধাপ। মানে স্বপ্ন এবং বাস্তবের মিশেল হচ্ছে এই লোগো।” তিনি আরও বলেন, বিজেপি শাসিত তিন রাজ্য গুজরাট, উত্তরপ্রদেশ এবং অসমেও সরকারি স্কুলে পড়ুয়াদের জন্য নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম চালু করা হয়েছে। আর মুখ্যমন্ত্রী একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন,”সরকারি স্কুলের পড়ুয়াদের জামা-জুতো সবই তো সরকার দেয়, সেখানে বাংলার নিজস্ব ছাপ থাকলে ক্ষতি কোথায়?”

ছাত্রছাত্রীদের ইউনিফর্মে “বিশ্ববাংলা”র লোগো বা ব্যাজ থাকলে কি লাভ বা ক্ষতি হবে, তা আমরা নির্ধারন করতে পারব না। তবে, শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রয়োজনীয়তা কতটা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আপাতত সেই বিতর্কেও আমরা যাচ্ছি না। আমরা আজ বোঝার চেষ্টা করব ব্যাজের “আন্তর্জাতিকতাবাদ”, যা কিনা রাজ্যের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যে উঠে এসেছে।

সাধারণ ভাবে “ব্যাজ” হল একধরণের প্রতীক যা একজন ব্যক্তির কোনো এক বিশেষ সত্তার দিকে প্রত্যক্ষ ইশারা করে। সেই সত্তা হতে পারে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধার্মিক , রাজনৈতিক ইত্যাদি অনেককিছুই।

ইংরাজী সিম্বল শব্দটির বাংলায় আভিধানিক প্রতিশব্দ হলো প্রতীক। ইংরেজি শব্দটি এসেছে গ্রিক ক্রিয়াপদ ‘সিম্বালেঈন’ (অর্থ: একত্রে ছুঁড়ে মারা) এবং বিশেষ্য ‘সিম্বলোন’ (অর্থ: চিহ্ন; প্রতীক; টোকেন বা নিদর্শন) থেকে। এছাড়া বাংলায় ‘প্রতীক’ শব্দটির অর্থ চিহ্ন; নিদর্শন; সংকেত। বাংলা প্রতীক শব্দটি সংস্কৃত ‘প্রতি+√ই+ঈক’ যোগে গঠিত। বস্তুত এই যে লেখ্য ভাষা , তারও উৎপত্তি হয়েছে সিম্বল থেকে। সভ্যতার আদিযুগে মানুষ কথা বলার সময় মুখের পেশিতে যে পরিবর্তন হয়, বা যে পরিবর্তন সাধনের মাধ্যমে মানুষ তার মুখের ভাষাকে বোধগম্য করে তুলে ধরে, তা হলো সেই ভাষার প্রাথমিক প্রতীক। যেজন্যে মুখের ভাবভঙ্গি আকার ইঙ্গিত দিয়ে বা সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ দিয়ে আদিম মানুষ একে অপরের সাথে প্রথম কথা বলা শুরু করেছিল। আর সেই “কথা বলা” থেকে “কথা লেখা” পর্যন্ত যাত্রাপথটাও ছিল মূলতঃ প্রতীক , সাইন বা সিম্বলের হাতধরে। আর সেখান থেকেই প্রথম দিকে ছবির মাধ্যমে এবং পরবর্তীতে ক্রমশঃ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকের লেখ্য ভাষার জন্ম। কাজেই প্রতীকের ব্যবহারটি কেবলমাত্র “আন্তর্জাতিক” নয়। বলা যায় মানব সভ্যতার শুরুর দিন থেকেই এর চল ছিল।

কিন্তু আজ মানুষ নিজের নিজের আঞ্চলিক বা মাতৃভাষা খুঁজে পেয়েছে। ফলে ভাষাতত্ত্বে লিপি (বর্ণ, অক্ষর) ইত্যাদির সীমানা পেরিয়ে এগিয়ে গেছে প্রতীকের ব্যবহার। ব্যবসার জন্য ট্রেডমার্ক; সংগঠনের ক্ষেত্রে লোগো (ক্ষেত্রবিশেষে মনোগ্রাম); রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পতাকা; ধর্মে নির্দিষ্ট কোন সিম্বল; এরকম আরো কত কী। প্রতীক কতো রকম যে হতে পারে, তার ইয়ত্তা নেই। আর সেরকমই একটি ব্যবহারিক দিক হল আজকের “ব্যাজ”। স্কুল বা বিভিন্ন সামাজিক অথবা রাজনৈতিক সংগঠনের ক্ষেত্রে এই ব্যাজ মুলতঃ ব্যবহার করা হয়। কিন্তু কোন একটি বিশেষ জাতির অস্মিতাকে উস্কে দিতে বা তুলে ধরতে এই “ব্যাজ” ব্যবহারের ভাবনাটি বেশ অভিনবই বলা চলে। যদিও এমন ব্যবহার বিশ্বে পশ্চিমবঙ্গের হাত ধরে প্রথম নয়, এর আগেও এর ব্যবহার হয়েছে অন্য দেশে। আর সেটা হয়েছে ইউরোপে। যার প্রবক্তা ছিলেন একদা টাইম ম্যাগাজিনের “পারসন অফ দ্য ইয়ার” অ্যাডল্ফ হিটলার।

হিটলার এবং দ্য ডয়েচে জংভোল্কের (ডিজে) কিশোর সদস্যরা

জার্মান যুব সমাজকে জাতীয়তাবাদে আকৃষ্ট করতে ১০ থেকে ১৪ বছরের ছেলেদের জন্য তৈরি হয়েছিল ডার হিটলারজুগেন্ডে দ্য ডয়েচে জংভোল্ক বা সংক্ষেপে ডিজে। এটি “হিটলার ইয়ুথ” এর একটি শাখা সংগঠন ছিল। তা এই “ডিজে”র একটি ইউনিফর্ম ছিল। এটাই ছিল খুব সম্ভবত কোন একটি বিশেষ জাতির জন্য তৈরি প্রথম ইউনিফর্ম। যার বাম হাতাতে সেলাই করা থাকত নাৎসি প্রতীক বা ব্যাজ। বহিরাঙ্গন ক্রিয়াকলাপ, প্যারেড এবং খেলাধুলার মাধ্যমে ছাত্রদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশ ছিল এই সংগঠনের অন্যতম উদ্দেশ্য। আর এর লক্ষ্য ছিল কিশোর সদস্যদের নাৎসি মতাদর্শে দীক্ষিত করা। ১৯৩৯ সালে জার্মান ছাত্রদের জন্য এর সদস্যপদ সম্পূর্ণ বাধ্যতামূলক হয়ে ওঠে। এই সংগঠনের মধ্যে থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে, কেউ কেউ শিশু সৈনিকও হয়ে উঠেছিল। ১৯৪৫ সালে হিটলারের মৃত্যু এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, অবশ্য ডয়েচে জংভোল্ক এবং এর মূল সংগঠন হিটলার ইয়ুথ উভয়েরই অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়ে যায়।

অর্থাৎ, ব্রাত্যবাবু সঠিক। আন্তর্জাতিকভাবে কোন একটি জাতির সমস্ত ছাত্রছাত্রীদের পোশাকে সরকারি প্রতীক বা ব্যাজের ব্যবহার আগেও হয়েছে। হিটলার করেছেন। কাজেই আশাকরি যারা প্রতীকের আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তারা এবার নীরব হবেন।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র

a) https://www.indiatoday.in/india/story/west-bengal-government-schools-blue-white-uniforms-biswa-bangla-logo-1927407-2022-03-21
b) https://www.anandabazar.com/west-bengal/bratya-basu-explained-the-reason-behind-new-color-of-school-uniforms/cid/1335003
c) https://books.google.co.in/books?id=3XbU1HEyfFkC&pg=PA34&redir_esc=y#v=onepage&q&f=false
d) https://www.thoughtco.com/hitler-youth-and-indoctrination-1221066