“পাহাড় চুরি” / Tilaboni Hill

আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস এর আগে পাড়ায় পাড়ায় পুকুর চুরি, গাছ চুরি বা খেলার মাঠ চুরি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিলাম।

অবশ্য মাঠের ক্ষেত্রে “চুরি” শব্দটা ব্যবহার করিনি আমরা সচেতন ভাবেই। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রীতিমত স্থানীয়স্তরে সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরগুলি থেকে নোটিস ঝুলিয়ে খেলার মাঠগুলি হাপিস করে দেওয়ার কাজগুলি করতেন স্থানীয় শাসক দলের নেতারা। তাই আমরা লিখেছিলাম মাঠ পালাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কি এই মাঠচুরি নিয়ে আমরা একটি নয়, দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছি। প্রথমটি হাওড়ার ডুমুরজলার মাঠ ধ্বংস করে ক্রীড়াপ্রশিক্ষন কেন্দ্র তৈরির নামে রিয়েল এস্টেট বানানোর অপচেষ্টার বিরুদ্ধে এবং দ্বিতীয়টি রামপুরহাট ইরিগেশন কলোনীর মাঠ ধ্বংস করে পর্যটন নিবাস নির্মাণের বিরুদ্ধে। মজার ব্যাপার হল এই দুক্ষেত্রেই অভিযোগের আঙ্গুল উঠেছিল সরকারের বিরুদ্ধে। আর আমরা সেই প্রতিবেদনগুলিতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে প্রতিবাদে সামিল হওয়ার জন্য আবেদন রেখেছিলাম, কারণ জানতাম এগুলো কোন বিচ্ছিন্ন হাওড়া বা রামপুরহাটের ঘটনা নয়। এগুলো হল সরকারী বদান্যতায় শাসকদলের মদতপুষ্ট স্থানীয় নেতাদের রুটি-রুজির প্রশ্ন। এতে সরকারের যতটা না আয় তার থেকে অনেক বেশি কাঁচা টাকা ঢোকে স্থানীয় নেতা-বিধায়ক-মন্ত্রীদের পকেটে।

কাজেই স্থানীয় বাসিন্দা না হওয়ায় হাওড়া ডুমুরজলার মাঠ বা রামপুরহাটের ইরিগেশন কলোনীর “মাঠ হাতানোর” সরকারী উদ্যোগের প্রতিবাদ না করে, আমরা যারা গা-বাঁচিয়েছিলাম তাদের জানিয়ে রাখি, এবার সরকারের বিরুদ্ধে একটা আস্ত পাহাড়-হাতানোর অভিযোগ উঠেছে। সম্প্রতি গ্রানাইট উত্তোলনের জন্য রাজ্য সরকার পুরুলিয়ার তিলাবনী পাহাড়কে একটি বেসরকারী সংস্থার হাতে বেচে দিয়েছে। অথচ মুলস্রোতের সংবাদমাধ্যমগুলোতে এনিয়ে তেমন কোন খবর বা লেখালেখি দেখছি না। আসলে এখন কোন ঘটনা ঘটলেই হয় না, তাকে খবর হতে হলে “পজিটিভ” হতে হয়, এমনটাই নিয়ম ধার্য হয়েছে সর্বোচ্চমহল থেকে। তার ওপর ঘটনাটি প্রত্যন্ত পাড়াগাঁয়ের হলে চেপে দেওয়া আরও সহজ। আর এক্ষেত্রে বোধহয় দুটো উল্লেখিত কারণই যুগপৎ কাজ করেছে।

তিলাবনী পাহাড়, পুরুলিয়া

কারণ পুরুলিয়া জেলার হুড়া ব্লকের অন্তর্গত কলাবনী পঞ্চায়েত এলাকার তিলাবনী, লেদাবনা, পড়শিবনা এবং মাধবপুর, এই চারটি আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের মাঝে অবস্থিত তিলাবনী কলকাতা কেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যমের কাছে কি আদৌ কোন খবর হল! তার ওপর সরকারের বিরুদ্ধে একটা আস্ত পাহাড় বেচে দেওয়ার অভিযোগ যার মধ্যে বিন্দুমাত্র ইতিবাচকতা বা পজিটিভিটি নেই। আর অনেকটা এজন্যেই রাইজ অফ ভয়েসেস কে ভয়েস তুলতে হল। পরিবেশবিদ ও ভৌগলিকদের দাবী তিলাবনী পাহাড় শুধুমাত্র একটা বিচ্ছিন্ন পাথরের টিলা নয়, এটা আশপাশের এলাকার পরিবেশ ও অর্থনীতির ভরকেন্দ্র। তাই স্থানীয় আদিবাসী সমাজ পাহাড়টিকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করে। প্রকৃতিপ্রেমী ও পর্বতারোহীর দল এখানে পর্বতারোহনের হাতেকলমে পাঠ নিতে ভিড় করেন। ফলে রাজ্যের পর্যটন মানচিত্রেও এই তিলাবনী পাহাড়ের উজ্জ্বল উপস্থিতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। বেকারী আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে পর্যটন কেন্দ্রিক অর্থনীতিতে হাতেখড়িও হচ্ছিল এলাকার মানুষজনের। আর এমন সময় সামনে এল সরকারী “বেচুবৃত্তি”র ফরমান। স্বভাবতই এলাকার মানুষজন একত্রিত হয়ে গড়ে তুলেছেন ‘পাহাড় বাঁচাও গণআন্দোলন’ মঞ্চ। ইতিমধ্যে তারা মিটিং-মিছিল করে প্রতিবাদ জানিয়ে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করছেন। চাইছেন সেই প্রতিবাদে বাংলার সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ।

কিন্তু এতটা পড়ে যারা পজিটিভিটির আতস কাঁচের তলায় ফেলে তিলাবনী বিক্রিকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখতে চাইছেন তাদেরকে জানাতে চাই, বাঘ যখন বেরিয়েছে “পাহাড়” শিকার করতে, তখন নিজের নিজের গোয়াল ঘরে তালা ঝোলালেই হয় না, বরং বাঘ তাড়াতে নিজের নিজের গোয়াল থেকে বেরিয়ে দলবদ্ধভাবে ক্যানেস্তারা পেটানো অনেক বেশি কার্যকরী।

কাজেই সবাই মিলে একসাথে মুখ খুলুন।

পাহাড় চোরের দল শুধু “তিলাবনী”কে টার্গেট করেছে ভাবলে ভুল ভাবছেন। কারণ বিগত এক পক্ষকালে বাঁকুড়া-পুরুলিয়া এই দুইজেলার একের পর এক পাহাড়ের গায়ে গজানো গাছ-গাছালিতে আগুন ধরছে। বসন্তের শুকনো পাতা আর ডালপালার মাঝে আগুন ধরে যাচ্ছে। প্রথম খবর আসে বাঁকুড়ার শুশুনিয়া পাহাড়ে আগুন ধরেছে। সেটা মার্চ মাসের মাঝামাঝি। তারপর একে একে আগুন লেগেছে পুরুলিয়ার গড়পঞ্চকোট, অযোধ্যা এবং জয়চন্ডী পাহাড়ে।

প্রতিক্ষেত্রেই স্থানীয় কতৃপক্ষের দাবী পর্যটকের দল উনুন নিয়ে রান্না-বান্না করতে গিয়ে বা অসতর্ক ভাবে ধূমপান করতে গিয়েই বিপত্তি ঘটাচ্ছেন। যদিও এই অঞ্চল গুলোতে উনুন নিয়ে রান্না-বান্না করা বা ধূমপান এই দুই-ই নিষিদ্ধ। তবে কি কর্তৃপক্ষের তরফে নজরদারির অভাব! নাকি তাঁদেরই কেউ কেউ চান আগুন লাগুক! তাই নজরদারীতে ঢিলেমি! কোন সদুত্তর পাওয়া যায় না।

স্থানীয় মানুষদের সন্দেহ, এর পেছনেও রয়েছে জঙ্গল চোরাকারবারীদের হাত। কারণ প্রতিবার আগুন লাগে এই বসন্তের সময়ই যদিও সারাবছর পর্যটকদের যাওয়া আসা লেগে থাকে এই পাহাড়গুলোতে । আর আগুন লাগছেও সন্ধ্যের দিকে এবং পাহাড়ের চূড়ার আশপাশে যাতে উঠে গিয়ে আগুন নিভিয়ে ফেলবার আগে বেশ বড় অংশের গাছপালা পুড়ে যায়। সাধারণত পর্যটকদের কেউ ওই সময়টাতে চূড়ার মত দুর্গম অংশের আশপাশে থাকেন না। স্থানীয় অসাধু কিছু নেতা-ব্যবসায়ী প্রশাসনের সাথে হাত মিলিয়ে এই কান্ড ঘটাচ্ছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। এরাই আগুন লাগাচ্ছে। উদ্দেশ্য প্রথমে পুড়ে যাওয়া অংশের গাছ কেটে কাঠ বিক্রি এবং তারপর পাহাড়ের সেই ন্যাড়া অংশের পাথর কেটে বিক্রি।

কাজেই সংবাদ মাধ্যমকে আরও সক্রিয়ভাবে এই পাহাড় হাতিয়ে নেওয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ খবর ভেতরের পাতার এককোণে না ফেলে রেখে সামনের পাতায় তুলে আনতে হবে।

আর তার পাশাপাশি আমাদেরকেও পাহাড়ের পাহারাদার হতে হবে। না হলে আইনি বা বেআইনি পথে পাহাড় চুরি চলতেই থাকবে। আর এভাবেই “বিচ্ছিন্ন” ঘটনার ঘনঘটায় পুকুর-মাঠ-পাহাড়-জঙ্গল সবকিছুই একদিন চুরি হয়ে যাবে শুধুমাত্র আমাদের এমন নিরবিচ্ছিন্ন নীরবতার কারণে।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

পুনশ্চঃ পাহাড় মানেই দার্জিলিং বা গ্যাংটক নয়।

তথ্যসূত্র
a) https://eisamay.com/west-bengal-news/others/susunia-hill-on-fire-forest-department-officials-police-firefighters-rushed/articleshow/90327996.cms
b) https://www.anandabazar.com/west-bengal/purulia-birbhum-bankura/fire-caught-in-the-forest-of-joychandi-pahar-of-purulia-dgtld/cid/1335868#.YkHODgrPxA8.whatsapp
c) https://www.anandabazar.com/west-bengal/purulia-birbhum-bankura/wild-fire-in-some-parts-of-the-jungle-of-purulia-dgtld/cid/1335760
d) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-20/202203192157551.jpg&category=0&date=2022-03-20&button=