বনধ Vs. ছুটি / Strike Vs. Holiday

আজকের পঞ্চব্যঞ্জন এই সপ্তাহের প্রথম তিনদিনের গপ্পো যার প্রথম দুদিন বনধ এবং তৃতীয়দিন সরকারী ছুটি।

তবে কথা দিচ্ছি ফালতু হেজাবো না। কারণ আমাকে পইপই করে বলে দেওয়া হয়েছে “ডিজিটাল” মানুষ বড় লেখা পছন্দ করে না। পড়েও না। তাই ‘স্যাট’ করে কাজের কথাটা বলে চলে যাব।

সাধারণভাবে মানুষ বনধ, হরতাল ইত্যাদি পছন্দ করে না। কিন্তু ছুটি ভালোবাসেন। এটাই বাস্তব। আর সেজন্যেই সরকার বাহাদুর সপ্তাহের প্রথম দুদিন (মানে সোমবার আর মঙ্গলবার) কর্মসংস্কৃতির ধ্বজা উড়িয়ে বামেদের ডাকা বনধের তীব্র বিরোধিতা করে অফিসে আসা বাধ্যতামূলক এমন ফরমান জারি করলেও, গতকাল মানে বুধবার শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের ২১১তম আবির্ভাব দিবস এবং মতুয়া ধর্মমেলা উপলক্ষে একটা আলটপকা অতিরিক্ত ছুটি দিয়ে দিয়েছেন। এই উপলক্ষে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়াল পর্দায় ভাষণও দিয়েছেন। ছুটি থাকায় সরকারী কর্মচারীরা বাড়িতে বসে সেই ভাষণ শোনবার সুযোগও পেয়েছেন।

কাজেই সে আপনি মতুয়া হোন বা না হোন, মতুয়া ধর্মমেলা উপলক্ষে ছুটির আমেজটা আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না। তাই কর্তৃপক্ষকে বত্রিশপাটি বিকশিত ধন্যবাদ জ্ঞাপনেও কোন কুন্ঠা থাকবে না। এমনকি স্কুল কলেজের মত একটানা পূজোর ছুটি, জামাইষষ্ঠী কিম্বা ভাইফোঁটার ছুটি, ছট পূজার ছুটি ইত্যাদি নানাবিধ অতিরিক্ত ছুটিতে সরকারী কর্মচারীরা এখন অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।

কিন্তু বনধের দিন সরকারের ফতোয়া মেনে অফিসে যাওয়াটা মাস্ট। নাহলে সার্ভিস ব্রেক।

এখন বনধের দিনগুলোতে যে আমরা অফিসে গিয়ে ভীষন কাজ করি তাও নয়। কিন্তু আমাদেরকে বোঝানো হয়েছে কর্মসংস্কৃতি মানে “নো বনধ”, “নো হরতাল”! তাই বনধের দিন সরকারী অফিসে কাজকর্ম চালু রাখতে আগেরদিন রাতে সরকারী অফিস গুলোতে কর্মচারীদের অফিসে থেকে যাওয়ার রেওয়াজও রয়েছে। তবে তা কতটা কর্মসংস্কৃতির তাগিদে আর কতটা “সার্ভিস ব্রেক” এড়াতে তা নিয়ে একটা বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু আগের দিন অফিসের সময় পেরোতেই টেবিল-বেঞ্চি জুড়ে যেরকম পিকনিকের মেজাজে তাস পেটানো চলে তাতে সেসব বিতর্ক ফুৎকারে উড়ে যায়।

তাছাড়া বনধ বা হরতালের দিনগুলোতে বাস-ট্রাম, দোকান -পাট ইত্যাদি সব বন্ধ থাকায় নিপাট ছুটির দিন হিসেবে সপরিবারে ঘুরে-বেড়ানো যায় না বা কোথাও যাওয়া যায় না। এমন কি ছোট-মাঝারি ব্যবসায়ীদেরও দোকান খুলতে না পারায় ক্ষতি হয়। বহু মানুষের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম আটকে যায়। সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে যাতায়াত করতে অসুবিধায় পড়তে হয়। আর বেসরকারী সংস্থার কর্মীদের অবস্থা অনেকটা অন্ধের কি বা দিন কি বা রাত্রির মত। তাদের বনধের দিন অফিস না গেলে সার্ভিস ব্রেক হয়ত হয় না, কিন্তু ছুটি কাটা যায়। আর যারা ক্যাজুয়াল স্টাফ তাদের কাটা যায় একদিনের মাইনে। তাই বনধ বা হরতাল হলে তাদেরকে অফিস যাওয়ার ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয়। উপরন্তু সরকার বাহাদুরের মর্জিমাফিক যে সমস্ত ছুটি-ছাটা ঘোষণা হয় তা বেসরকারী সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

এর পাশাপাশি যে যে ইস্যু নিয়ে বনধ ডাকা হয়েছে বনধ সফল হলেই সেই ইস্যুগুলোর সমাধান হয়েছে এমন উদাহরণও আমাদের হাতের সামনে খুব একটা নেই।

মানে সোজা কথায় ছুটির দিনগুলোতে আমেজ-আলসেমি যতটা দৃশ্যমান, সপরিবারে একসাথে বাড়িতে বসে বা ঘুরে বেড়িয়ে ছুটি কাটানোর আনন্দ যতখানি নিশ্চিত, এক দুদিনের বনধের ফলে জনজীবনে তৈরি হওয়া অসুবিধাগুলোও ঠিক ততটাই প্রকট, অথচ সফল বনধের মাধ্যমে যে ইস্যুগুলোকে সামনে রেখে বনধ ডাকা হয় তার কোন আশু সমাধান হবে এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

আর তাই সরকারী ব্যাঙ্ক বীমা বা অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেলাগাম বেসরকারীকরণ, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি ইত্যাদি সব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে বনধ ডাকা হলেও আমরা অনেকেই খুব একটা সাড়া দেওয়ার তাগিদ অনুভব করি না। কিন্তু মতুয়া ধর্মমেলা উপলক্ষে একটা দিন ছুটি উপভোগ করতে দারুণ লাগে।

কাজেই বনধ বা হরতাল যতটা না কর্মসংস্কৃতির বিরোধী, তার থেকে অনেকবেশি মনস্তাত্ত্বিক ভাবে নেতিবাচক। যতটা প্রতিবাদের ভাষা ঠিক ততটাই মানুষের স্বাধীন চলাফেরায় অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ। আর তাই শাসকরা যেভাবে “কর্মনাশা বনধ” কথাটা উচ্চারণ করেন, সেভাবে “কর্মনাশা ছুটি” কথাটা উচ্চারণ করেন না। বরং কর্মসংস্কৃতির ধুঁয়ো তুলে বনধের বিরোধীতা করে যেমন সরকার বিরোধী আন্দোলনের মুখ বন্ধ করেন তেমনই দেদার ছুটি বিলিয়ে সরকারী কর্মচারীদের মনোরঞ্জনও করেন।

আর এজন্যেই আমাদের মনে হয়েছে বনধের বিকল্প পথ খুঁজে দেখবার সময় হয়েছে। সেইসঙ্গে নিয়মকরে বনধের বাৎসরিক ব্যবহারও বন্ধ হওয়া জরুরি। পাশাপাশি সরকার বাহাদুরকেও মনে রাখতে হবে কারণে অকারণে ছুটির সার্কুলার জারি করে জনমানসকে তুষ্ট করবার এমন খিড়কি পথটাও কর্মসংস্কৃতির পরিপন্থী।