“নীল-সাদা” খাঁকি / Blue White And…
রামপুরহাট গণহত্যার ঘটনাক্রম আবার পুলিশি ব্যর্থতার নগ্ন চেহারাটা সামনে আনল।
অভিযোগ ভাদু শেখ খুনের বদলা নিতে যখন ২০-৩০ জনের লুম্পেন বাহিনী বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতাদের বাড়ি বাড়ি ঢুকে পরিবার-পরিজনদের পিটিয়ে কুপিয়ে খুন করে ঘরবাড়ি গুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়, তখন চার-পাঁচ গাড়ি পুলিশ গ্রামের মুখটাতে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু অসহায় মহিলা ও শিশুদের আর্ত চিৎকার শুনেও বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি। কেন আসেনি? কারণ তৃণমূল উপপ্রধান ভাদুশেখের খুনের বদলা চলছে। তার ওপর ভাদুর ছিল গাড়ির ব্যবসা। থানার দারোগা থেকে উচ্চপদস্থ পুলিশকর্মীদের ব্যবহারের জন্য নিত্যনতুন দামী গাড়ির যোগান দিত ভাদু। এছাড়াও স্থানীয় পাথর ও বালি খাদানের একচেটিয়া মাফিয়া ছিল ভাদু শেখ। সেখানকার তোলাবাজির একটা বড় ভাগ যেত পুলিশের টেবিলে। কাজেই ভাদু শেখের খুনের বদলা নেওয়া লোকাল পুলিশের একরকম নৈতিক দায়িত্বর মধ্যে পড়ে। আর সেজন্যই পুলিশ গ্রামের মুখটাতে দাঁড়িয়ে পথ আগলাতে থাকে যাতে কেউ পালাতে না পারে। আবার বাইরে থেকে কোন উটকো লোক সেসময় গ্রামে ঢুকে পড়লেও বিপত্তি। বদলা নেওয়ার খবর পাঁচকান হয়য়ে যেতে পারে। কারণ তার আগেই শর্টসার্কিট হয়য়ে টিভি সেট বাস্ট হয়য়ে যাওয়ার স্ক্রিপ্ট রেডি। তাই পুলিশ বেশ সতর্ক হয়েই “গণহত্যা” পাহারা দিচ্ছিল। এমনকি পরিকল্পনা মাফিক রাতের অন্ধকারে কোন রকম ময়নাতদন্ত বা ফরেন্সিক এক্সপার্ট রিপোর্টের ধার কাছ দিয়ে না গিয়ে, জনৈক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিকে আত্মীয় সাজিয়ে লাশ গুলিকে প্রথমে সনাক্ত করানো হয় এবং পুলিশ আধিকারিকদের উপস্থিতিতে সেগুলিকে সমাধিস্থও করে দেওয়া হয়। কিন্তু আট-দশটা লাশ। তাও আবার বেশিরভাগই মহিলা এবং শিশু। তাই শেষ রক্ষা হয়নি। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই কানাকানি জানাজানি হয়ে যায়। তাই কেষ্ট মণ্ডল যখন প্ল্যান মাফিক শটসার্কিট, টিভি ফেটে যাওয়ার গপ্পো ফাঁদছে সাংবাদিকদের সামনে, ততক্ষনে খবর চাউর হয়ে গেছে সারা রাজ্যে। ফলে কেষ্টর গপ্পো অক্সিজেন বা গুড়বাতাসা কিছুই পেল না। ববিকে চপার উড়িয়ে ছুটে আসতে হল পরিস্থিতি সামলাতে। আর আজকে মুখ্যমন্ত্রী নিজে যা বললেন, তাতে মনে হল লোকাল থানা স্থানীয় তৃণমূল ব্লক সভাপতির অধীনে কাজ করে। থানার ওসি’রা নন, ব্লক সভাপতিরা ঠিক করেন পুলিশ কোথায় যাবে আর কোথায় যাবে না।
অবশ্য এর আগে আনিস হত্যাকান্ডেও আমরা পুলিশের ভ্যানকে গ্রামের মুখে দাঁড়িয়ে এরকমই পাহারা দিতে দেখেছি। আনিসের খুনীদের গ্রামে ঢোকানো এবং বের করে আনবার মূল কারিগর ছিল এরা। শুধু তফাৎ হল আনিস হত্যাকান্ডে পুলিশই ছিল খুনী। আর রামপুরহাট গণহত্যায় পুলিশ ছিল খুনীদের সঙ্গী। যদিও মুখ্যমন্ত্রীর তৈরি অপদার্থ “সিট” এখনও দোষী পুলিশ কর্মীদের এক মাস পেরিয়ে গেলেও খুঁজে বার করতে পারেনি। এমনকি আনিসের ক্ষেত্রেও নাম কা ওয়াস্তে ময়না তদন্ত করে দেহ সমাধিস্থ করে দেওয়ার জন্য চাপ দেওয়া হয় পরিবারকে। আর এজন্যই আদালতের নির্দেশে কবর খুঁড়ে আনিসের দেহের দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করতে হয়। এর থেকেই পরিষ্কার শাসকের অঙ্গুলিহেলনে শাসক ঘনিষ্ঠ প্রকৃত দোষীদের আড়াল করতে পুলিশ কতটা মরিয়া হতে পারে।
আবার ঝালদায় কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু খুনের ঘটনাতেও সরাসরি অভিযোগের আঙ্গুল উঠছে ঝালদা থানার আইসি সঞ্জীব ঘোষের দিকে। কারণ ত্রিশঙ্কু ঝালদা পুরসভায় বোর্ড গঠনের জন্য শাসক দলের হয়ে স্বয়ং থানার আইসি নেমেছিলেন বিরোধী শিবিরের কাউন্সিলরদের সাথে দরদাম কষতে। নিয়মিত ফোন করে চাপাচাপি চলত। ভাইরাল হওয়া বেশ কিছু ফোনের কথোপকথনের রেকর্ড ক্লিপ তেমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। কিন্তু তপন কান্দু শেষ পর্যন্ত রাজি না হওয়ায় গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে, নিহতের পরিবারের তরফে এমনটাই অভিযোগ রয়েছে। আর স্থানীয়দের অভিযোগ এক্ষেত্রেও নাকি পুলিশের গাড়ি হত্যাকান্ডের সময় অকুস্থলের আশপাশে ছিল।
আর সবশেষে দেখে নেওয়া যাক বর্ধমান শহরের বুকে তুহিনা খাতুনের আত্মহত্যার ঘটনা। এক্ষত্রেও সেই এক শাসকের স্বপক্ষে পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ। তুহিনা খাতুনের বাবা জুনাই শেখ এলাকার সক্রিয় তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী। কিন্তু স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর বসিরুদ্দিন শেখ ওরফে বাদশার বিরুদ্ধ গোষ্ঠী। এদিকে এই বাদশার যতটা না রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা, “এলাকার ত্রাস” হিসেবে পরিচিতি তার থেকে ঢের বেশি! তার বিরুদ্ধে তোলাবাজি, কাটমানি, গুন্ডামি, পথেঘাটে এলাকার মেয়ে-মহিলাদের উত্যক্ত করা ইত্যাদি একগুচ্ছ অভিযোগ রয়েছে এলাকাবাসীর। আর এমনই একজনকে সদ্য অনুষ্ঠিত পুরসভা নির্বাচনে ফের একবার তৃণমুল কংগ্রেস মনোনয়ন দেওয়ায় জুনাই শেখদের মত স্থানীয় কিছু তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আর সেই থেকেই দুই গোষ্ঠীর বিবাদ চরমে ওঠে। তুহিনা এবং তার দুই দিদিকে রাস্তাঘাটে হেনস্থা করতে থাকে বাদশাদের দলবল। ধর্ষনের হুমকি দিতে থাকে। বারবার পুলিশে জানানো হলেও পুলিশ কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ বাদশা স্থানীয় তৃণমুল বিধায়ক খোকন দাসের ঘনিষ্ঠ। এমনকি তুহিনাদের বাড়ির দেওয়ালে তাদের তিন বোনকে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়ার অশ্লীল ছবিও এঁকে দিয়ে যায় বাদশার দলবল। লোকাল থানার আইসি বাদশার দলবলকে নিদান দেন দেওয়ালে আঁকা ছবিটা মুছে দিতে হবে। ব্যস। ঐ পর্যন্তই। মানে পুলিশি মধ্যস্থ্যতায় সালিশি সভা বা ক্যাঙ্গারু কোর্ট! এরা উর্দিধারী পুলিশ নাকি শাসকের হয়ে সালিশি করে বেড়ানো দলদাস ঠিক বোঝা যায় না। যদিও পুলিশের সেই নির্দেশ আদৌ মানে নি “বাদশা” বাহিনী। আর পুলিশও এরপর কোন ব্যবস্থা নেয় নি। আর এরপর পুরসভা ভোটের ফলপ্রকাশ হতেই তার কয়েক ঘন্টার মধ্যে বাদশার দলবল চড়াও হয় তুহিনাদের বাড়ি। অভিযোগ তিন বোনকে চুলের মুঠি ধরে টেনে এনে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়। সেসময়ও কোন পুলিশের লোকজনকে দেখা যায় নি এগিয়ে আসতে। আর এই অপমান অত্যাচার সহ্য করতে না পেরেই ছোট বোন তুহিনা খাতুন নিগৃহীত হওয়ার পরপরই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে গলায় দড়ি দেয়। এরপর হইচই হতেই ফের পুলিশ আসে। কিছু লোকদেখানো মুখ বাঁচানো ধরপাকড় হয়। কিন্তু বাদশা বেপাত্তা থেকে যায়। যদিও জানলে অবাক হবেন পুলিশের খাতায় “ফেরার” বাদশা নির্বিঘ্নে কাউন্সিলর হিসাবে আলাদা ভাবে গোপনে এসডিও অফিসে মহকুমা শাসক তীর্থঙ্কর বিশ্বাসের সামনে শপথ নিয়ে ফেলেছেন।
আর এসব দেখে আমাদের মনে হয়েছে স্কুলের ইউনিফর্ম নয়, পুলিশের খাঁকি ইউনিফর্ম বদলে নীল সাদা করে দেওয়া উচিৎ। জনসাধারণের কথা ভুলে পুলিশ যখন মাননীয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের সেবাদাসে পরিণত হয়েছে তখন তাদের গায়ে খাঁকি উর্দির পরিবর্তে নীল-সাদা পোশাক অনেক বেশি মানানসই হবে। পুলিশ হয় উর্দি পড়ে প্রকৃত অপরাধীদের ধরুক অথবা উর্দি খুলে নীল-সাদা জার্সি পরুক।
Comments are closed.