আলুবন্ড : নতুন লুঠের ক্ষেত্র / Potato Bond

ঈশ্বর পাটনীর “দুধে ভাতে” থাকা বাঙালী নাকি এখন “মাছে-ভাতে” হয়েছে। এমনই একটা ধারণা প্রচলিত আছে। সারা দেশজুড়ে সব্বাই জানে এবং মানে, যে মাছ থেকে বাঙালীকে আলাদা করা মুশকিল।

কিন্তু আজকের দিনে দাঁড়িয়ে, কজন বাঙালীর দুধ বা মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার সামর্থ আছে, যেখানে আমাদের বাংলায় দারিদ্রতার হার ২১.৪৩%; প্রায় ৩৩% মানুষ ঠিক মতন দু’বেলা খেতে পায় না, অপুষ্টির শিকার; প্রায় ৪৭ শতাংশ পরিবারের পাকা বাড়ি নেই; আর ৩২ শতাংশ পরিবারের নিজস্ব শৌচাগার নেই; এসব তথ্য উঠে এসেছে নীতি আয়োগের সর্বশেষ দারিদ্র-সূচক নির্ণায়ক রাজ্যওয়ারী সমীক্ষা রিপোর্টে।

আর এই প্রেক্ষাপটেই রাইজ অফ ভয়েসেস এর মনে হয়েছে দুধ বা মাছ নয়, খাদ্যপ্রিয় বাঙালীর সব থেকে বেশি সখ্যতা আলুর সাথে। তা সে আলুভাতে হোক বা আলুরদম, আলুপোস্ত হোক বা আলু-ভাজা। বাঙালীর কোন তরকারি আলু ছাড়া হয় না। সিঙ্গাড়াতেও আলু মাস্ট। এমনকি বিরিয়ানিতেও এক পিস আলু না থাকলে বাঙ্গালীর চলে না।

আর তাই রাইজ অফ ভয়েসেস টিমের মনে হল, এই মুহুর্তে “আলু-সর্বস্ব” বাঙালীকে আলুচাষীদের দুঃখ-দুর্দশার কথাটা জানানো জরুরি।

এখন তো সরকারী “সাপোর্টে” চলা মিডিয়ায় “পজিটিভ” যুগ চলছে। তাই এসব খবর এদের কাছে পাবেন না। কিম্বা সে খবর এমনভাবে ভেতরের পাতার এককোণে ঠেলে দেবে, যে আপনার চোখেও পড়বে না। টিভিতেও তাই। সারাদিন প্রাইম টাইমগুলোতে কাজিয়া চালিয়ে রাখবে। আর দুপুরের দিকে যখন কেউ টিভিতে বিশেষ খবর-টবর দেখে না, ঠিক সেই সময় দু-তিন মিনিটে বিশ-তিরিশটা খবর, ঝড়ের গতিতে গড়গড় করে পড়ে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলবে। সেখানেও এই সমস্ত কাজের খবরগুলিকে এনারা ইচ্ছাকৃতভাবে রাখেন শেষের দিকে, যাতে বেশিরভাগ দর্শক চ্যানেল ঘুরিয়ে অন্যত্র চলে যায়। আর ঠিক যখন আপনি টিভি খুলে বসবেন সারাদিনের খবরে চোখ বুলিয়ে নেওয়ার জন্য, তখন দেখবেন টিভিতে চলছে কোন দাপুটে নেতা দল বদলালেন, সিবিআই নোটিস খেয়ে “অসুস্থ” হয়ে কে হাসপাতালে ভর্তি হলেন, হিজাব পরা বাধ্যতামূলক কি না, মহঃ সেলিম মুসলমান ইত্যাদি। ইদানীং আবার রাশিয়া-ইউক্রেন, পুতিন- বাইডেনদের-জেলেন্সকিদের উপস্থিতি নজর কাড়ছে।

কিন্তু কদ্দিন আর এদের মুখের ঝাল খেয়ে নিজেকে ভুলিয়ে রাখবেন! আসল খবর কাজের খবর জানাটা জরুরি।

আর তাই আজ রোববারের বারবেলায় পাঁঠার মাংসের ঝোলে “আলু খুঁজে খাওয়া” আমাদের জানা জরুরি, এই মুহুর্তে রাজ্যের আলুচাষীরা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছেন। আলু চাষিরা হিমঘরে আলু মজুতের জন্য জায়গা পাচ্ছেন না। কারণ হিমঘরগুলিতে আলু মজুতের জন্য যে “আলুবন্ড” দরকার তার বিলি-বন্টন নিয়ে চলছে ব্যাপক দুর্নীতি। শাসক-ঘনিষ্ঠ দালাল ফড়েদের হাতে চলে গেছে আলুবন্ডের একটা বড় অংশ। তাই আলু চাষীরা গুদামের অভাবে উৎপাদিত আলু বাধ্য হচ্ছেন কম দামে বা জলের দরে এই সমস্ত মিডল ম্যানদের বেচে দিতে, যাকে বলে “অভাবী বিক্রি”। ফলে আপনি আমি গাদাগাদা দাম দিয়ে খুচরো বাজারে আলু কিনলেও পাইকারী বাজারে আলুচাষীদের কপালে জুটছে লবডংকা। দালাল-ফড়ের দল ক্ষীরটা খাচ্ছে। শাসকের অনুপ্রেরণায় বীজ ও সারের দেদার কালোবাজারির কারণে* অনেক ক্ষেত্রেই আলুচাষীরা অভাবী বিক্রি থেকে চাষের খরচটুকুও তুলতে পারছেন না। বিঘা প্রতি আলুচাষে যেখানে বীজ, সার বা রাসায়নিকের পিছনে খরচা হয়েছে ২৫ হাজার টাকা, সেখানে অভাবী বিক্রি থেকে দাম পাওয়া যাচ্ছে ১৪-১৫ হাজার টাকা। ফলে আগামী মরশুমে এদের অনেকের হাতেই চাষবাস করবার পয়সা থাকবে না। এদের একটা বড় অংশ আলুর পাশাপাশি ধান চাষও করেন। ফলে আগামী মরশুমে শুধু আলু নয়, ধানের যোগানও কম হবে। বাড়বে আলুভাতে-ভাত খাওয়ার খরচও। আর মাথায় রাখতে হবে, চাল-ডাল, তেল-নুন , আলু-পিঁয়াজ , চা-চিনি ইত্যাদি কয়েকটি পণ্য, অনেকটা পেট্রোল-ডিজেলের মত। এগুলোর দাম বাড়লে বাকি সবকিছুর দাম বাড়ে। কারণ, প্রত্যেক মানুষকেই এই পণ্যগুলোর বর্ধিত খরচ মেটাতে হয়। বেড়ে যায় শ্রমমুল্য বা লেবারের দাম। কাজেই “আলুবন্ড” কেলেঙ্কারি আগামী দিনগুলোতে আমার আপনার পকেটে টান ফেলবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

যে কোচবিহার জেলার দোর্দন্ডপ্রতাপ নেতা “দুয়ারে প্রহার” প্রকল্পের জনক, যিনি সম্প্রতি তাঁর নিজের জন্মদিনে ৫০ ভরির রুপোর মুকুট পেরেছেন, সেই তাঁর জেলাতেই আলুবন্ড বিলি-বন্টনে চরম অব্যবস্থার খবর সবথেকে বেশি করে সামনে এসেছে। ধূপগুড়ি, মাথাভাঙ্গার মত এলাকায় আলুচাষীরা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন। পাশের জেলা আলিপুরদুয়ারেও চলছে একই অবস্থা। সেখানকার ফালাকাটায় চাষিরাও মিছিল- ধর্নার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

যদিও এসব নিয়ে “রুপোশ্রী” নেতা আদৌ চিন্তিত কি না আমরা জানতে পারি নি। অবশ্য খোদ কলকাতার বুকে “বৈভব ছেড়ে সাধারণের মত জীবন যাপন করার” পরামর্শ দেওয়া সর্বময় নেত্রীর বাড়িতেই যদি কোটিপতি ভাই-ভাইপোর ছড়াছড়ি হয়, তাহলে সুদুর উত্তরবঙ্গের দিনহাটায় তাঁর দলেরই কোন “দীনদয়াল” ৫০ ভরির রুপোর মুকুট পড়বেন, এতে অবাক হওয়ার মত কিছু নেই। আর সেই “রুপোর মুকুট” পরা তিনি, আলুবন্ডের বিলি বন্টনে দুর্নীতির প্রতিবাদ করে গরীব-গুরবো আলু চাষীদের হয়ে কথা বলবেন, এমন আলুলায়িত আগোছালো ভাবনা প্রশ্রয় দেওয়াকে বলে পাগলামো।

অন্যদিকে খাতায়-কলমে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল বিজেপি যার অধিকাংশ জন প্রতিনিধি উত্তরবঙ্গ থেকে, তারা এখন সবাই লাক্সারি বাসে চেপে দলবেঁধে সিনেমা দেখতে ব্যাস্ত। বিধানসভায় এদের দলনেতা আলুবন্ড কেলেঙ্কারির কথা যদি বলেও ফেলেন, তাহলে শাসকের বেঞ্চ থেকে ওনার কুকীর্তির অজস্র ফাইলস খুলে যায়। তাই কাশ্মীর ফাইলস বেটার অপশন। কাজেই ওনার কাছে এসব ভাতে-ভাত খাওয়া বাঙালীর থেকে কাশ্মীরী পন্ডিত অনেক বেশি নিরাপদ।

এছাড়া আরও একটা জিনিষ আমাদের মাথায় রাখা প্রয়োজন। বাংলার বিধানসভায়ও এখন কোটিপতিদের ভিড়। কি তৃণমূল, কি বিজেপি! এঁদের মাথাপিছু গড় সম্পত্তির পরিমাণ এখন ২.৫০ কোটি টাকার ওপরে। এর অর্থ বাংলার কোটিপতিরা মানে যারা আর্থিক মাপকাঠিতে মোট জনসংখ্যার ১%-২% এর প্রতিনিধি, তারা এখন বিধানসভার মধ্যে মেলা করে বসে আছেন। ২৯২ জন নির্বাচিত বিধায়কদের মধ্যে ১৫৮ জন নাকি কোটিপতি। এর মধ্যে ৩৭ জন বিধায়কের সম্পত্তির পরিমাণ ৫ কোটি টাকার বেশি। তৃনমূলের বিজয়ী প্রার্থীদের মধ্যে ৬২% বিধায়ক কোটিপতি। আর বিজেপির ক্ষেত্রে সেই সংখ্যাটা ৩৩ শতাংশ। তৃণমূলের ২১৩জন বিজয়ী প্রার্থীর একেকজনের গড় সম্পদের পরিমাণ প্রায় ৩ কোটি টাকা। বিজেপি’র বিধায়করা নতুন এসেও খুব পিছিয়ে নেই, ৭৭ জন বিজেপি বিধায়কের একেকজনের গড় সম্পত্তির পরিমাণ ১.১৩ কোটি টাকার। মানে সোজাকথায় এখন রাজ্যের বিধানসভায় বাংলার বড়লোকদের সমাহার। এরা আপনার আমার মত আলুসেদ্ধ-ভাত খাওয়া গরীব মধ্যবিত্ত বাঙালীর কথা ভাববে, এটা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য? তারচেয়ে বরং মাছে-ভাতে বাঙালীকে নানা রকমের গরম গরম বাতেলার উত্তেজনায় ফুটিয়ে তাদেরই পকেট ও ভোট কাটবে সেটাই অনেক বেশি স্বাভাবিক। আর গত দু-তিন বছর ধরে সেটাই এরা করে চলেছে।

কাজেই আপনাকে আমাকে মুখ খুলতে হবে। আর মুখ খোলবার আগে জানতে হবে। আর কাজের কথা জানতে খবরের কাগজ বা টিভির পাশাপাশি চোখ থাকুক “রাইজ অফ ভয়েসেস” এর মত অনাম্নী ফেসবুক পেজ বা ট্যুইটার হ্যান্ডেলগুলোতে।

আপনারা ছাড়া আমাদের কোন “সাপোর্ট” নেই। তাই “পজিটভিটি” ছড়িয়ে নয়, চোখ এড়িয়ে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ খবর আপনাদেরকে দেওয়ার মধ্যেই আমাদের সার্থকতা।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

*এখানেও সেই একই শাসক ঘনিষ্ঠ দালাল-ফড়েদের দাপট যা নিয়ে আমাদের প্রতিবেদন” সারকথা” আপনারা পড়ে দেখতে পারেন।

তথ্যসূত্র
a) https://uttarbangasambad.com/deogaon-farmers-are-not-getting-potato-bonds-in-cold-storage/
b) https://www.uttarbangasambad.com/administrative-meeting-on-smooth-distribution-of-potato-bonds/
c) https://www.anandabazar.com/west-bengal/tmc-councilor-of-dinhata-awarded-udayan-guha-with-silver-crown/cid/1334500
d) https://www.anandabazar.com/west-bengal/north-bengal/%E0%A6%86%E0%A6%B2-%E0%A6%B0-%E0%A6%A6-%E0%A6%AE-%E0%A6%A4%E0%A6%B2-%E0%A6%A8-%E0%A6%A4-%E0%A6%95-%E0%A6%B7%E0%A6%A4-%E0%A6%B0-%E0%A6%AE-%E0%A6%96-%E0%A6%9A-%E0%A6%B7-1.111746
e) https://adrindia.org/content/west-bengal-assembly-election-2021-analysis-criminal-background-financial-education-gender
f) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-12/202203112310591.jpg&category=0&date=2022-03-12&button=
g) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-11/202203102156202.jpg&category=0&date=2022-03-11&button=
h) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-08/202203072211107.jpg&category=0&date=2022-03-08&button=