উপরাষ্ট্রপতি উবাচ / National Education Policy
![উপরাষ্ট্রপতি উবাচ / National Education Policy](https://riseofvoices.com/wp-content/uploads/2022/03/png_20220322_122711_0000-845x550.png)
বিজেপি নেতা ও তাঁদের ভক্তকূল ভুলভাল বকেন, গুল মারেন এটা আমরা এখন সবাই কমবেশি জানি।
কেউ মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট ও স্যাটেলাইট ব্যবস্থার অস্তিত্ত্ব খুঁজে পান। কেউ কেউ আবার দুরারোগ্য ক্যান্সার বা করোনা সারিয়ে ফেলেন গোবর-গোমূত্রে। গরুর গায়ে হালকা হাত বুলিয়ে ছু-মন্তর করে ফেলেন হাইপার টেনশন। পুষ্পক রথের উদাহরণ দিয়ে দাবী করে বসেন প্রাচীন পৌরাণিক কালে ভারত অত্যধুনিক উড়োজাহাজ ওড়ানোর বৈজ্ঞানিক কৌশল-পদ্ধতি জানত। গণেশের মাথার উদাহরণ টেনে চোখে আঙ্গুল দিয়ে আমাদের বোঝাতে চান শল্য চিকিৎসায় প্রাচীন ভারতের অগ্রগতির কথা। এমনকি গরুর দুধে সোনা আবিষ্কারের ধৃষ্টতাও কেউ কেউ দেখিয়ে ফেলেন।
এইসব নিয়ে জনপরিসরে হাসি-ঠাট্টা বিতর্ক-বিতণ্ডা চলতেই থাকে। আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস এসবের মধ্যে ঢুকি না।
কিন্তু যখন প্রশাসনের বা নেতৃত্বের সর্বোচ্চ স্তর থেকে শিক্ষা ব্যবস্থার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ডাহা মিথ্যে ভাসিয়ে দেওয়া হয় তখন প্রতিবাদ জানাতেই হয়। আর এমনই একটি কাজ করে বসেছেন দেশের বর্তমান উপরাষ্ট্রপতি তথা বিজেপির প্রাক্তন সর্বভারতীয় সভাপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু। হরিদ্বারের দেব সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গয়ে হঠাৎই বলে বসেছেন শিক্ষার গেরুয়াকরণ হলে ক্ষতি কি! আসলে গেরুয়াকরণের যে অভিযোগ উঠছে তা আদতে নাকি শিক্ষার ভারতীয়করণ। এদ্দিন ধরে চলে আসা ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা ইংরাজীর মত বিদেশী ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মেনে নেওয়াতেই নাকি ভারতের একটা বিরাট অংশের মানুষ শিক্ষালাভ থেকে বঞ্চিত রয়ে গেছেন। এমনকি ঠারে ঠারে উনি যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হল প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত দেশবাসীর একটা বড় অংশ ঠিক ততটা নিজের দেশ নিয়ে বা নিজেকে ভারতীয় ভাবতে গর্ববোধ করে না। ঊনি আরও বলেছেন প্রত্যেক ভারতবাসীর নিজের নিজের মাতৃভাষাকে সম্মান জানানো উচিৎ এবং এর পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষাও জানা উচিৎ যাতে তারা পৌরাণিক বেদ-উপনিশদ প্রভৃতি গ্রন্থ অধ্যয়ন করতে পারেন।
এখন প্রথম কথা হল আমাদের দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থা এখনও মূলতঃ মাতৃভাষাতেই দেওয়া হয় এবং এই ব্যবস্থা চলে আসছে বহুকাল ধরে। যদিও ইংরাজী মাধ্যমেও এই ব্যবস্থা সমান্তরাল ভাবে চালু হয়েছে তবে সেটা সম্প্রতি কিন্তু বাধ্যতামূলক নয়। আমরা চাইলেই আমাদের সন্তানদের নিজের নিজের মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহনের ব্যবস্থা করতে পারি। কাজেই ইংরাজীর মত ঔপনিবেশিক ভাষা শিক্ষার মাধ্যম হওয়ায় সমাজের একটা বিরাট অংশের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এমনটা বলে সত্যের অপলাপ করা হচ্ছে।
উনি দেশের উপরাষ্ট্রপতি। কাজেই ওনার জানা উচিৎ আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের স্কুল ড্রপ আউট বা স্কুল-কলেজ না যাওয়ার মূল কারণ দারিদ্র, শিশুশ্রম বা বালিকা বিবাহের মত সামাজিক ব্যধিগুলি। সেইসঙ্গে আমাদের দেশে জনসংখ্যার নিরিখে স্কুল কলেজের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের নিরিখে মোটেই আশানুরূপ নয়। অনেক প্রত্যন্ত এলাকা আছে যেখানে পাঁচ-সাত বা দশ কিলো মিটারের মধ্যে কোন স্কুলই নেই। আবার স্কুল থাকলে সব বিষয়ের শিক্ষক নেই। ন্যুনতম পরিকাঠামো নেই। শৌচাগার নেই।
উনি কি জানেন ইউনেস্কোর ২০২১ সালের সমীক্ষায় কি তথ্য উঠে এসেছে!
দেশজুড়ে এগারো লক্ষেরও বেশি শিক্ষক পদ খালি পড়ে রয়েছে। সবথেকে বেশি শূন্য শিক্ষক পদ রয়েছে উত্তরপ্রদেশে। ৩ লক্ষের ওপর। শাসন ক্ষমতায় বিজেপি। ২লক্ষ ১০ হাজারের কাছাকাছি শূন্যপদ নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে বিহার। সেখানেও বিজেপি সমর্থিত সরকার। ১লক্ষ ১০ হাজার শিক্ষক শূন্য পদ নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে বাংলা। শাসন ক্ষমতায় মমতা ব্যানার্জ্জীর তৃণমূল কংগ্রেস। এই মমতাদেবীও এককালে বেঙ্কাইয়া নাইডুদের ফেবারিট ছিলেন।
এছাড়াও ইউনেস্কোর সমীক্ষায় উঠে এসেছে একজন মাত্র শিক্ষক বা শিক্ষিকা রয়েছে দেশজুড়ে এমন স্কুলের সংখ্যাও প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার। মানে এগুলোকে আর যাইহোক ঠিক স্কুল বলা চলে না। তারমধ্যে ২১ হাজার এমন স্কুল রয়েছে মধ্যপ্রদেশে যেখানে সরকার চালাচ্ছে বিজেপি।
আর এত কিছুর পরেও জাতীয় বাজেটের মাত্র ২ শতাংশ বরাদ্দ হয় শিক্ষাখাতে যেখানে হওয়ার কথা ৬ শতাংশ।
কাজেই ঔপনিবেশিকতার দোহাই দিয়ে নিজেদের ব্যর্থতা ঢেকে দেওয়ার অপচেষ্টা বন্ধ হোক। এই যে সমাজের একটা বড় অংশ এখনও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তার আসল কারণ শিক্ষার প্রসারে রাজনৈতিক “অনিচ্ছা”। কোন ঔপনিবেশিক ভাষা বা মানসিকতা নয়। এখানে বলে রাখি “সদিচ্ছার অভাব” কথাটা সচেতন ভাবে ব্যবহার না করে “অনিচ্ছা” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
পরিশেষে আমরা যারা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত তারা ঠিক ততটা নিজেদেরকে ভারতীয় ভেবে গর্ববোধ করি না বা নিজের দেশ ও তার সভ্যতা-সংস্কৃতি সম্পর্কে সচেতন ও গর্বিত নই এমনটা ভাববার একচেটিয়া ধৃষ্টতা উপরাষ্ট্রপতি মহাশয় না দেখালেই ভালো করতেন! এমনকি আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে সম্মান করি না বা তার যথাযত চর্চা করি না এমন তথ্যই বা উনি পেলেন কোথা থেকে আমাদের জানা নেই। আর ওনার এটাও স্মরণে থাকা দরকার, স্বাধীনতাপূর্ব ভারতবর্ষে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে লড়েছিলেন তাঁদেরকে যে শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল তা আজকের তুলনায় অনেকবেশি ঔপনিবেশিক ছিল। তবুও সেই শিক্ষা তাঁদের দেশমাতৃকা বন্দনায় কোন বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। কাজেই এভাবে আপামর দেশবাসীর প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় অর্জিত শিক্ষাকে “খাটো” করে উনি ঠিক কি বোঝাতে চাইলেন আমাদের বোধগম্য হল না।
আমরা আশা রাখব জাতীয় শিক্ষানীতির ঢেঁড়া পিটতে গিয়ে এসব মনগড়া গল্প ভবিষ্যতে উনি আর বলে বেড়াবেন না এবং নিজের পদমর্যাদা সম্পর্কে যত্নবান হবেন।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
তথ্যসূত্র
a) https://epaper.anandabazar.com/imageview_62217_33559521_4_71_20-03-2022_8_i_1_sf.html
b) https://thewire.in/government/whats-wrong-with-saffronisation-of-education-vice-president-venkaiah-naidu
c) https://www.tribuneindia.com/news/nation/naidu-whats-wrong-with-saffronisation-of-education-379002
d) https://www.indiatoday.in/india/story/accused-of-saffronising-education-what-is-wrong-with-saffron-venkaiah-naidu-1927057-2022-03-19
e) https://timesofindia.indiatimes.com/india/1-lakh-schools-in-india-run-with-just-1-teacher-each-unesco-report/articleshow/86798798.cms
f) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-20/202203200029042.jpg&category=0&date=2022-03-20&button=
Comments are closed.