খুলে দাও জানালা / Open The Window

এই সময়, এই অন্ধকার,
চারিদিকে শুধু বন্ধ দ্বার…

এখন সময়টা ঠিক এইরকমই। অন্ধকার এবং ভয়ংকর।

এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে এই রাজ্যে এবং গোটা দেশে। খুব সুপরিকল্পিতভাবে সর্বত্র অসহিষ্ণুতা আর ঘৃণা ছড়িয়ে দিচ্ছে একদল স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদ। সিনেমার পর্দা থেকে টিভির টক শো, কিম্বা খবরের কাগজ থেকে পাড়ার চায়ের ঠেক, সর্বত্র এক ছবি। প্রতিষ্ঠানের মাথায় বসে এইসব ঘৃণার কারবারিরা চটুল অর্ধসত্যকে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার চেষ্টা করছে। যুক্তিবাদী বা প্রতিবাদীদের পজিটিভিটির নামে সংবাদমাধ্যম গুলিতে “সেন্সর” করা হচ্ছে। “তব তুম কাঁহা থে” আওড়ে প্রতিবাদী স্বরকে দমিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। মানুষের মৌলিক অধিকারকে দেশভক্তি বা জাতীয়তাবাদের নামে খর্ব করা হচ্ছে। ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে ধর্মসহিষ্ণুতার ন্যুনতম আবরণটুকু। ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষজনকে কাপুরুষ বলে দেগে দিয়ে নিজ নিজ ধর্মীয় ছাতার তলায় একজোট হতে বলা হচ্ছে। ভাবটা এমন যেন ধর্মযুদ্ধ শুরু হল বলে! আর এসব কিছুকে জিইয়ে রাখতে ওড়ানো হচ্ছে দেদার পয়সা। কিন্তু এইসব একদিনে শুরু হয়নি, ধীরে ধীরে মানুষ যত আত্মসুখের খোঁজে একা হয়েছে, এই ঘৃণার কারবারীরা তত সংগঠিত হয়েছে, অনেকটা কুখ্যাত নাৎসি বাহিনীর মত।

মানুষের সংগঠিত প্রতিবাদ যেমন একদিন টুপ করে চলে আসে না, তেমন টুপ করে কোনো একদিন রাতে ফ্যাসিবাদও আপনার দরজায় কড়া নাড়ে না।

প্রথমে অপরাধীদের কন্ট্রোল করার কথা বলে অপরাধীদের মনোবল বাড়ানো হয়। তারপর একদিন রাজ্যের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বা কর্ত্রী জেল থেকে অপরাধী ছাড়িয়ে আনেন আর তার দলের কোন নেতা শিক্ষিকাকে জগ ছুড়ে মারলে অতীতের উদাহরণ টেনে, স্বাভাবিক ছোট ঘটনা বলে পাশ কাটানো হয়। এরপর শহরের রাস্তায় ধর্ষণ হলে ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয় আর ধর্ষকের প্রেমিকা সাংসদ হয়ে যায়। এখানেই শেষ নয়, সাথে সঠিক তদন্ত করার জন্যে দক্ষ পুলিশ অফিসারদের ছুটিতে পাঠানো হয় আর সংবাদমাধ্যমে মাস্টারস্ট্রোক বলে শাসকস্তুতি করা হয়। তারপরে সিনেমার প্রদর্শন বন্ধ হয়, বিরোধীদের পার্টি অফিস ভাঙা হয়, বিরোধী নেতাদের কান ধরে উঠবোস করানো হয়, গ্রামছাড়া করা হয়, বিরোধী প্রার্থীকে সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে হাতের পাঞ্জা কেটে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। মহিলাকর্মীকে রাস্তার মধ্যেই বিবস্ত্র করে পেটানো হয়। কিন্তু কেউ কিচ্ছু বলে না। কারণ এর বিপ্রতীপে চলছে ধর্মান্ধতার দাপাদাপি। “ঘুঁষকে মারেঙ্গে” রব তুলে উগ্র জাতীয়তাবাদের হুঙ্কার। কে কি খাবে, কে কি পরবে, কে কি বলবে ইত্যাদি সব কিছুকেই আতসকাঁচের তলায় ফেলে চালানো হচ্ছে নজরদারি। না-পসন্দ হলেই “দেশদ্রোহী” তকমা। ইউএপিএ খাইয়ে দেওয়া। পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেওয়া।

ফলে “সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্র জাতীয়তাবাদ” এবং তার বিপ্রতীপে “লুম্পেনবাদ” পাশাপাশি চলতে থাকে। আমরা “ফ্যাসিবাদ” খুঁজে পাই না।

আর সেই সুযোগে বাড়িতে বিশেষ মাংস রাখার অপরাধে খুন করে দেওয়া হয়। বাড়ির উঠোনে নভেম্বর বিপ্লবের দিনে লাল পতাকা তোলার “অপরাধে” বিরোধী দলের কর্মীকে পিটিয়ে মারা হয়। পুলিশকে দিয়ে ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয় প্রতিবাদী যুবককে। চাকরি চাইতে গেলে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয় শহরের রাজপথে। আর এসব দেখে মন্ত্রীমশাইরা বলেন, “গুলি না চললে তো পুলিশ-আদালত উঠে যাবে” অথবা “গোলি মারো শালোকো”। সব শুনেও বুদ্ধিজীবীকূল মুখে “রা” কাটেন না। বরং গুলি-বন্দুকের সমর্থনেই নিজের নিজের দলের হয়ে যুক্তি সাজান, কখনো আবার কেউ কেউ কোন নির্দিষ্ট বিরোধী দলের মানুষের লাশের অপেক্ষায় থাকেন। দাবীমত প্রতিদিন পাঁচটা লাশ না পেলেও, লাশ পেতে থাকেন নিয়মিত। আর তারপর একটা গ্রামে তার নিজের দলের লোকেদেরই রাতের অন্ধকারে পুড়িয়ে মারা হয় ! “শটসার্কিট” শুনবেন নাকি লাশ গুনবেন ভেবে পান না।

শ্রদ্ধেয় মুজতবা আলীর বলেছিলেন” রান্না খারাপ বা বিস্বাদ হলে বেশি করে ঝাল দিয়ে দিন। যিনি খাবেন ‘একটু ঝাল বেশি হয়েছে’ ছাড়া আর কোন বদনাম করতে পারবেন না।”

দেশে এবং রাজ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান ইত্যাদি মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রগুলি এখন যে প্রকারে বিস্বাদ হয়ে পড়েছে, তাতে এই শাসকদের মানুষের সমস্যাতে ঝাল না মেশালে খুব মুশকিল। আর তাই আমার আপনার “ঝাল” লাগবেই। আর ঝালে শুধু কি জিভ জ্বলে! চোখের জলও পড়ে! এক্ষেত্রেও তাই পড়ছে। সঙ্গে তৈরি হচ্ছে ঝালের ভয়। কোন লঙ্কায় ঝাল বেশি! সাম্প্রদায়িকতা ও উগ্রজাতীয়তাবাদ নাকি লুম্পেনবাদ।

কিন্তু এই পৃথিবীতে ভয় কোনদিনও চিরস্থায়ী হয়নি। ১৯৩৯ এ নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্যে মনোনীত হওয়া “হলোকস্ট”-এর প্রবক্তা হিটলারকেও শেষে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল। মানুষই এইভাবে বারে বারে ছুড়ে ফেলেছে শাসককে। যুগ যুগান্তর ধরে।

এটাই পৃথিবীর নিয়ম, তাই মানুষই সংগঠিত হয়ে বারে বারে, জিতে যায় আর ইতিহাস লেখে। শাসক হেরে যায়। শাসক হারবেই।

অতএব
খুলে দাও জানালা আলোরই ছোঁয়াতে,
চলে এসো বন্ধু হতে…

ধন্যবাদান্তে,
রাইস অফ ভয়েসেস