রামপুরহাট গণহত্যা : একটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক হত্যালীলা / Rampurhat Genocide

দক্ষিণ কলকাতার কালীঘাট অঞ্চলে টালির চালার পাশে তিরিশটার বেশি প্লটের মালিক মাননীয়ার পরিবার। কোটিপতি ভাই-ভাইপো। অদূরেই গজিয়ে ওঠা ভাইপোর প্রাসোদপম “শান্তিনিকেতন”। এসবেরই মূলে “পরিবর্তন চাই” দাবির সাথে তাল মিলিয়ে গত এক দশকের পরিবর্তিত জামানা। তবে এটা কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

প্রাক্তন তৃণমূল ও বর্তমানে বিজেপি বনে যাওয়া অধিকারীদের “শান্তিকুঞ্জ” র গপ্পোটাও একইরকম। “পরিবর্তন চাই” পালার আগে গ্যারাজে একসময় শুধু সাইকেল আর মূলতঃ দু-চাকার গাড়ি রাখা থাকত। সেখানে আজ চার-চাকার সারি। সঙ্গে গুণোত্তর অনুপাতে বেড়েছে পরিবারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ও বৈভব। এখন ভূতের মুখে “রাম” নাম হলেও তাতে অতীত ঢাকা যায় না। একই গপ্পো শেখ সুফিয়ানের। “পরিবর্তন চাই” ব্যবস্থাপনায় গত এক দশকে তার কুঁড়েঘর থেকে “জাহাজবাড়ি” যাত্রা তো মেদিনীপুর জেলার এপিক স্টোরিগুলোর মধ্যে একটা।

এমনকি নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে গত এক দশকে বারে বারে নির্বাচিত হয়ে আসা জনপ্রতিনিধিদের (পুরসভা, বিধানসভা অথবা লোকসভা যে কোন স্তরেই) হলফনামায় চোখ বোলালেই বেশ বুঝতে পারা যায় রাজ্যের প্রায় সর্বত্রই গত এক দশকে গড়পড়তা সমস্ত তৃণমূল নেতাদের উঠোনেই “আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ” গজিয়েছে।

আর এরই সাম্প্রতিক উদাহরণ রামপুরহাটের অখ্যাত বগটুই গ্রামের ভাদু শেখ। এক সময় মুরগীর মাংসের দোকানে মুরগীর পালক ছাড়াতো। তার আগে করত দিনমজুরি। ট্র্যাক্টরও চালিয়েছে কিছুদিন। কিন্তু পরিবর্তনের জামানায় সেই ভাদু শেখ তৃণমূলের টিকিটে জিতে গ্রামের উপপ্রধান হতেই কপাল খুলে গেল তার। কিভাবে খুলল তা ভাদু শেখের সদ্যবিধবা স্ত্রী নিজেই জানিয়েছেন। টেলিভিশনের ক্যামেরা-বুমের সামনে তার আর্তনাদ “ভাদু একা খেত না, সবাইকে দিয়ে থুয়ে ভাগ করে খেত” স্পষ্ট জানান দেয় লুম্পেনদের নেতৃত্বে তোলাবাজি আর কাটমানির ব্যবসা ছাড়া এরাজ্যে এই মুহুর্তে আর তেমন কোন শিল্প নেই। গ্রামের বুকে গজিয়ে ওঠা ভাদু শেখের চারতলা পেল্লায় প্রাসাদ এবং তার গ্যারেজে মজুত থাকা খান চারেক এসইউভি জানান দেয় কাঁচা টাকার পরিমাণ ঠিক কতটা!

এলাকার বালি আর পাথর খাদানের এক চেটিয়া মাফিয়া ছিল এই ভাদু শেখ। নেতা-পুলিশ সবাই “ভাগ” খেত। কিন্তু সেই ভাগের “বখরা” নিয়ে গন্ডগোল বেঁধে যায় ভাদু শেখের নিজের দলের মধ্যে। সোনা শেখ, ফটিক শেখ, লিটন শেখ , নিউটন শেখদের মত কয়েকজন দল থেকে বেরিয়ে যায়। আর সেই শত্রুতার জেরেই গত মঙ্গলবার সন্ধ্যের দিকে পাড়ারই চায়ের দোকানের সামনে প্রথমে বোম মেরে ভাদু শেখ কে খুন করা হয়। আর তার বদলা নিতেই ভাদু শেখের ঘনিষ্ঠরা কয়েক ঘন্টার মধ্যেই গ্রামে ঢুকে বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর সোনা শেখ-ফটিক শেখদের পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠদের ওপর হামলা চালায়। অভিযোগ প্রথমে পিটিয়ে কুপিয়ে খুন করে বা আধমরা করে বাড়িতে ফেলে রেখে তারপর তাদের বাড়িগুলোতে দাহ্যপদার্থ ছড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পুড়ে কাঠ হয়ে যায় মানুষগুলো।

ঠিক কতজনকে হত্যা করা হয়েছে সেই সংখ্যাটা এখনও পরিষ্কার নয়। কারণ আগুন নেভাতে আসা দমকল কর্তাদের হিসেব অনুযায়ী সংখ্যাটা দশ। পুলিশের ডিজির হিসেব অনুযায়ী আট। আর হাসপাতাল ও পুলিশ সুপারের হিসেব অনুযায়ী সাত। এর পাশাপাশি বেশ কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। কিছু স্থানীয় মানুষদের দাবি বেশ কিছু মৃতদেহ রাতের অন্ধকারে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। যদিও এখনও পর্যন্ত হিসেব অনুযায়ী মৃতদের অধিকাংশ মহিলা এবং শিশু।

এখন স্বভাবতই এই গণহত্যা নিয়ে শাসক-বিরোধী দুপক্ষই সক্রিয়তা দেখাবেন এবং তরজায় জড়াবেন। আমি সেসবের মধ্যে ঢুকতে চাই না।

আমি শুধু পরিষ্কার করে বলতে চাই এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক হত্যাকান্ড। শাসকদলের রাজনীতিটাই যখন লুঠ-তোলাবাজির ওপর দাঁড়িয়ে, সেই কাঁচা টাকার বানানো প্রাসাদেই যখন শাসকদলের শীর্ষ নেতা থেকে চায়ের দোকানের ভোলা-ভাদুদের বাস, তখন লুঠের মালের বখরা নিয়ে ঝামেলা-মারামারিতে খুন বা গণহত্যা কখনও অরাজনৈতিক হতে পারে না। বর্তমানের একগুচ্ছ বিজেপির নেতা তৃণমূলে থাকাকালীন শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে বখরা ভাগাভাগি নিয়ে গন্ডগোলের জেরেই দলবদলে বিজেপিতে এসেছিলেন বলে মনে করেন রাজনৈতিক মহলের একটা বড় অংশ। আবার কেউ কেউ দলবদলে ছিলেন সেই কাঁচা টাকা খাওয়া-খাওয়ি নিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার সক্রিয়তা থেকে বাঁচতে।

কাজেই কি বিজেপি কি তৃণমূল, বাংলার রাজনীতিটাই যখন লুঠ-লুম্পেনবাজির মুক্তমঞ্চ হয়ে উঠেছে, যখন রাজনৈতিক কুশীলবরা কাটমানি-তোলাবাজির আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন এবং সেই মত রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করছেন, তখন সেইসূত্রে লুম্পেনদের অন্তর্দন্দ্ব, গোলাগুলি, খুন বা গণহত্যা সবই রাজনৈতিক।

“বিচ্ছিন্ন” ঘটনার ঘনঘটায় ছিন্নভিন্ন বাংলা নিজে নিজেই সেটা বুঝতে পারছে। তারজন্য শাসকদলের জেলখাটা মুখপাত্র অথবা ভাড়াটে বুদ্ধিজীবীদের কোন শংসাপত্রের প্রয়োজন নেই। শান্তিনিকেতন-শান্তিকুঞ্জের প্রতিটা ইঁট-চুনসুরকি তার সাক্ষী। গাড়ী-আসবাব-বৈভব তার প্রমাণ।

“শর্টসার্কিট” বা “টিভি বাস্ট” করে যাওয়ার গপ্পো যেমন অক্সিজেন না পেয়ে মরে গেল, “অরাজনৈতিক বিচ্ছিন্ন সমাজবিরোধীদের দাপাদাপি”র গপ্পোও ধোপে টিকবে না।