ধান নিয়ে “চালবাজি” / Black Market of Paddy

“বাংলার খুঁটিনাটি” ক্যাচলাইন চালিয়ে কোলকাতার নিরাপদ চৌহদ্দিতে ঘুরঘুর করে হাতধুয়ে ফেলব এতটা স্মার্ট এখনও হতে পারি নি আমরা। তাই জানি না কিভাবে অজুহাত দিয়ে কথার মারপ্যাঁচে “গা” বাঁচাতে হয়। কাজেই এবারের লেখাটা সেইসব “আমাদের” জন্য যারা কৃষক আন্দোলন মানে সিঙ্ঘু বর্ডার বুঝি। অথবা লেখাটা সেই সব “আমাদের” জন্য যারা কেন্দ্রীয় সরকার তিন কৃষি কালা আইন প্রত্যাহার করতেই ট্যুইটের বন্যা বইয়ে দিয়ে গত এক বছর ধরে চলা কৃষক আন্দোলনের সাফল্যের মধ্যে নিজেদেরকে “কৃষকবন্ধু” হিসেবে জাহির করতে নামছি। এর মধ্যে লেখক নিজেও আছেন কাজেই লজ্জার কিছু নেই! কিন্তু জানবার আছে! কারণ সব কথা টিভি দেখে বা খবরের কাগজের প্রথম পাতার হেড লাইন পড়ে অথবা মোবাইলে নিউজ ফিডের অ্যালার্টে চোখ বুলিয়ে জানা যায় না।

আর তাই এইসব “আমাদেরকে” রাইজ অফ ভয়েসেস” এর পক্ষ থেকে আমরা জানাতে চাইছি যে এই মুহুর্তে আমাদের রাজ্যে চলছে সরকারের তরফে সহায়ক মূল্যে ধান কেনার মরশুম। আর সেই ধান কেনা নিয়ে বাংলা জুড়ে যে “চাল” বাজিটা চলছে সেটাই লিখতে বসে জানলাম শিখলাম অনেক কিছু। বুঝলাম “কৃষিশিক্ষিত” হতে আমাদের মত তথাকথিত শিক্ষিত শহুরে ট্যুইটারাট্টি-ফেসবুকওয়ালাদের অনেকটা পথ যেতে হবে।

প্রথমেই জানিয়ে রাখি রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এবছর ধানের সহায়ক মূল্য ধার্য হয়েছে কুইন্টাল প্রতি ১৯৪০ টাকা। কিন্তু ধান বেচতে চাইলেই “গেলাম-ধান বেচলাম-পয়সা পেলাম” ব্যাপারটা ঠিক তেমন সোজাসাপ্টা নয়। প্রথমে একদিন কৃষককে সংশ্লিষ্ট কৃষি আধিকারিকের অফিসে গিয়ে লাইন দিয়ে নাম নথিভুক্ত করে কুপন নিয়ে আসতে হয়। সেই সময় কৃষককে জানিয়ে দেওয়া হয় কবে কোথায় কত পরিমাণ ধান সে বেচতে পারবে। এরপর নির্দিষ্ট দিনে কৃষককে সেই নির্দিষ্ট অফিসে গিয়ে আবার লাইনে দাঁড়িয়ে কুপন দেখিয়ে ওজন করে সেই ধান বেচতে হয়। প্রতিদিন এভাবে গড়পড়তা কুড়ি-পঁচিশজন চাষীর থেকে ধান কেনা হয়। ফলে, অনেক্ষেত্রেই কুপন নিয়ে লাইনে দাঁড়ালেও চাষীদের অনেকেই ধান বেচার সুযোগ পান না। পরের কোন নির্দিষ্ট দিন আবার আসতে হয়। কিন্তু ধান বেচলেও চাষী তক্ষুনি হাতেনাতে নগদ টাকা পান না। এরজন্য আরেকদিন চাষীকে গিয়ে আবার লাইন দিয়ে পেমেন্টের চেক নিয়ে আসতে হয় । এই হল মোটামুটিভাবে ধান বেচবার সামগ্রিক পদ্ধতি। স্বভাবতই এই যে “তিনদিনের গপ্পো” সেটা যে তিনদিনেই শেষ হবে তার তেমন কোন নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া সরকারী মান্ডির অসাধু কর্মীরাও নানা অছিলায় চাষীদের ঘোরায় যাতে তারা বাধ্য হন দালাল বা ফড়েদের কাছে ধান বেচে দিতে এমন অভিযোগও রয়েছে!

আবার এটাও সত্যি যে বহু ক্ষেত্রেই চাষীর গোলায় যে পরিমাণ ধান হয় তার মাত্র অর্ধেক পরিমাণই সরকারী মাণ্ডিতে সহায়ক মুল্যে সে বেচতে পারে কারণ প্রত্যেক চাষীর থেকে ধান কেনার পরিমাণের একটা উর্ধসীমা বেঁধে দেওয়া থাকে সরকারের তরফে। বাকি ধান তাকে কম দামে সরকারি মান্ডির বাইরে দালাল/ফড়েদেরকেই বিক্রি করতে হয়। তাই বহু চাষী ধান বিক্রি করতে আর সরাকারি মান্ডিতে এসে এই সমস্ত হয়রানির স্বীকার হতে চান না। এসবের থেকে বাঁচতে গ্রামেই শাসক ঘনিষ্ঠ দালালদের হাতে সহায়ক মূল্যের থেকে বেশ কিছুটা কম দামে ধান বিক্রি করে দেন। এতে তাদের এই বারবার মান্ডিতে যাতায়াতের খরচ বাঁচে। দিনের মজুরিটাও মার যায় না। আর একদল শাসক ঘনিষ্ঠ মধ্যস্বত্ব ভোগী ন্যুনতম পরিশ্রমে সহায়ক মুল্যের ক্ষীরটা মেরে দেন। আর এখানেই সহায়ক মূল্যের আইনি রক্ষা কবচ/স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা যার জন্য এখনও দিল্লীর উপকন্ঠে লড়াই চলছে।

এবছর আবার শোনা যাচ্ছে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। সরকার যে পরিমাণ ধান জেলায় জেলায় কিনবে বলে সিদ্ধান্ত করেছে তার থেকে বেশ খানিকটা বেশিই ধান উঠেছে এবার । ফলে দাম না পাওয়ার ভয়ে শুরু হয়েছে কুপন সংগ্রহের হিরিক। কৃষকেরা কুপন জোগার করতে রাতভোর লাইন দিচ্ছে। হত্যে দিচ্ছে সংশ্লিষ্ট সরকারী দপ্তরের দরজায়। আর এরমধ্যেই অভিযোগ আসতে শুরু করেছে শাসক ঘনিষ্ঠ ফড়ে-দালালেরা আগে থেকে কুপন তুলে নিচ্ছে। যার ফলে চাষীরা রাতভর লাইন দিয়েও কুপন পাচ্ছে না। শেষে বাধ্য হচ্ছে সেই ফড়েদের কাছে সহায়কমূল্যের থেকেও কম দামে ধান বেচতে। অভিযোগ এসেছে ধান বিক্রির সময় উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জায়াগায় শীষ ভাঙ্গা ধানের অজুহাতে কুইন্টাল প্রতি ৮ থেকে ১০ কেজি ধান বাদ দেওয়া হচ্ছে যাকে চালু ভাষায় বলে “ধলতা” যা কৃষকেরা দিতে নারাজ। কারণ সারের দাম ও কালোবাজারির সাথে জুঝে পেট্রোপনের অস্বাভাবিক মুল্যবৃদ্ধির জন্য ধান বিক্রি করতে এই বারবার গ্রাম থেকে মান্ডিতে যাতায়াতের খরচ মিটিয়ে এতটা ধলতা দেওয়া সম্ভব নয়।

আবার অন্য একটি খবরও আমাদের নজরে এসেছে যেখানে কুপন বিলিতে অনিয়ম চলছে খোদ পঞ্চায়েত অফিসের তত্বাবধানে। এমনিতে কুপন বিলি হওয়ার কথা সেন্ট্রাল প্রোকিওরমেন্ট সেন্টার থেকে। কিন্তু বর্ধমানের গলসি ব্লকে তৃণমূল পরিচালিত মসজিদপুর গ্রাম পঞ্চায়েত অফিস থেকে বিলি হচ্ছে কুপন। আর সেই কুপন চাইতে গেলে চাষীকে বলা হচ্ছে আগে পঞ্চায়েতের বকেয়া কর মেটাতে যা কি না সরকারী নির্দেশিকাতে নেই। খবরের প্রকাশ রাজ্য সরকারের নেক নজরে থাকা “দুয়ারে সরকার” প্রকল্প চালাতে গিয়ে পঞ্চায়েত গুলির অনেক টাকা খরচা হয়ে যাওয়ায় পঞ্চায়েত স্তরে কর আদায়ে এমন ঘুরপথে “কড়াকড়ি” শুরু হয়েছে অনেক জায়গায়।

স্বভাবতই ক্ষোভ বাড়ছে রাজ্যের ধান চাষিদের মধ্যে। কোথাও স্থানীয়ভাবে তারা রুখে দাঁড়াচ্ছেন! কোথাও মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন লোকবলের অভাবে।

এই সংক্রান্ত খবরের লিঙ্ক গুলো দেওয়া হল । পড়ুন, জানুন এবং বুঝুন কৃষক আন্দোলনের মাঠটা অনেক বড়।
অন্নদাতাদের পাশে দাঁড়াতে শুধু সিংঘু বর্ডার নয় বাংলার গ্রামেগঞ্জে গেলেও হবে।

তথ্যসূত্রঃ-
a) https://www.anandabazar.com/west-bengal/bardhaman/villagers-of-majidpur-panchayat-staged-agitation-against-their-panchayat-head/cid/1315469#.
b) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-01/202111302200502.jpg&category=0&date=2021-12-01&button=
c) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-01/202111302200519.jpg&category=0&date=2021-12-01&button=