গিনিপিগ / Guineapig

সময়টা ১৯৯৭, দিনটা মনে নেই। মাধ্যমিক পরীক্ষা চলছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাবার কাছে শুনলাম অঙ্ক পরীক্ষা দিতে যেতে হবে না। কি মুশকিল! কেন? কারণ, আগের দিন রাতে নাকি অঙ্ক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গেছে, তাই অঙ্ক পরীক্ষা বাতিল। নতুন প্রশ্নপত্রে সেই পরীক্ষা নেওয়া হবে, যেদিন সূচীমত মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার কথা ছিল, তারও ৭-৮ দিন পর।

অঙ্কে আমি বরাবরই কাঁচা। ফলে উৎকন্ঠা ও ভয় দুইই ছিল। ভেবেছিলাম পরীক্ষা দিয়ে হাঁফছেড়ে বাঁচবো। কিন্তু এভাবে পরীক্ষা পিছিয়ে যাওয়ায় আরও ৭-৮ দিন অতিরিক্ত সেই দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। সেই সময় টিভি চ্যানেলের ঘন্টাবাবুরা না থাকলেও, ভয় দেখানোর জন্য পাড়ার দাদা-দিদিরা ছিল। তাদের একটাই কথা, এবার অঙ্ক প্রশ্ন এমন কঠিন হবে যে, বুঝবি ঠ্যালা। সত্যিই ঠ্যালা বুঝেছিলাম সেই ৭-৮ দিন !

খুব রাগ হয়েছিল সেই লোকটার ওপরে, যাকে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার পুলিশ মারফত গ্রেফতার করেছিল প্রশ্নপত্র ফাঁসের দায়ে। ওই ব্যাটার জন্যেই আমাকে শুধু যে আরও ৭-৮ দিন এক্সট্রা টেনশন নিয়ে বাঁচতে হয়েছিল তাই নয়, পরীক্ষার পরে আমার ঘুরতে যাওয়াও বানচাল হয়েছিল। আমায় দাদু ঠাকুমার কাছে অঙ্ক কষতে বসিয়ে রেখে বাবা, মা আর ভাই ১০ দিনের জন্যে উটি বেড়াতে গিয়েছিল তখন। আমার যাওয়া হয়নি ওই ‘প্রশ্ন ফাঁস করা’ লোকটার জন্যে। তবে লোকটার জেল হয়েছিল, এটাই শান্তি। যাই হোক, দেরিতে অঙ্ক পরীক্ষা হলেও, সেবারে অঙ্ক প্রশ্ন সহজই ছিল, পেয়েছিলাম ৭৭। কিন্তু সেই লোকটার যতোই শাস্তি হোক, সেই ৭-৮ দিনের ভয় পাওয়াটা, ঘুরতে না যেতে পারাটা আজও ভুলতে পারি না।

এখন অবশ্য দিন পাল্টেছে। ‘পরিবর্তন’ বলে কথা। ইদানিং প্রশ্ন ফাঁস হলে কেউ ধরাও পড়ে না, পরীক্ষাও বাতিল হয় না। শেষ কোন মাধ্যমিক বা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, স্বয়ং রাজ্য সরকারের কর্তাব্যক্তিরাও মনে করতে পারবেন না। বরং এখন প্রশ্নফাঁস না হওয়াটাই খবর। পরীক্ষা হবে অথচ প্রশ্নফাঁস হবে না, এ আবার কেমন কথা ! ইউটোপিয়া নাকি!

উল্টে সরকারের কাছ থেকে প্রস্তাব আসে, যেখানে যেখানে পরীক্ষা হবে সেই অঞ্চলের ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রাখা হবে। যদিও হাইকোর্টের নির্দেশে তা হয়নি। মানে যা দাঁড়াছে তা হল, ইন্টারনেট বন্ধ না হলে প্রশ্নফাঁস আটকাতে সরকারের তেমন কিছু করণীয় নেই। আর প্রশ্নফাঁসের কারণে পরীক্ষা পেছোতে থাকলে মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা কোনদিন শেষ হবে না।

কিন্ত এবারে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা যে কারণে পিছোতে চলেছে, তার কারণটা অত্যন্ত অনভিপ্রেত। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন কতকটা একতরফা ভাবে রাজ্য সরকারের সাথে পরামর্শ না করেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সূচী মাঝেই, আসানসোল লোকসভা এবং বালিগঞ্জ বিধানসভা উপনির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করে দিলেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গের ৪২ টি লোকসভার মধ্যে ১টি লোকসভা আর ২৯৪ টি বিধানসভার মধ্যে ১টি বিধানসভার উপনির্বাচনের কারণে, রাজ্যজুড়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা পিছিয়ে গেলো প্রায় ৯ দিন। রাজ্য সরকারের তরফে যথেষ্ট পরিমাণ প্রতিবাদও দেখলাম না।

এমনকি প্রধান বিরোধীদল বিজেপির তরফেও কোন উচ্যবাচ্য নেই। এঁদের বাড়ির ছেলেমেয়েরা কি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিচ্ছে না ! এটাকে কি বলবো? চরম উদাসীনতা না ঔদ্ধত্য! নাকি নেহাতই রাজনৈতিক লাভ ক্ষতির অঙ্ক কষা হল!

শাসক ভাবলেন রাজ্যজুরে সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত পুরোভোটে ব্যপক একচেটিয়া সাফল্যের রেশ থাকতে থাকতেই উপনির্বাচনগুলো হয়ে যাক। আর বিজেপি ভাবলো সাম্প্রতিক চার রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য ও বহুচর্চিত সিনেমা “কাশ্মীর ফাইলস” এর গরম হাওয়ায় ভোট হলে যদি নিজেদের ভোট শতাংশ কিছুটা হলেও ধরে রাখা যায়! কারণ এবারও থার্ড হলে অস্তিত্ত্ব বিপন্ন!

এই ভোট সর্বস্ব রাজনীতির শেষ কোথায় আমি জানি না। তবে নিজে একজন ভুক্তভোগী হিসেবে বুঝতে পারি, ওই ৯টা দিন কত দুর্বিসহ হতে চলেছে এবারের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের জন্যে। তার ওপর শেষ কয়েক বছর এরা সকলেই মহামারীর কারণে কম বেশি গৃহবন্দি, অনেকের পরীক্ষা দেওয়ার অভ্যেসও ক্ষতিগ্রস্ত। ফলে সেই দমবন্ধ পরিস্থিতি ও উৎকন্ঠা থেকে বেরিয়ে আসবার অপেক্ষা আরও ন’দিন বেড়ে গেল।

কিন্তু কর্তৃপক্ষ সেটা বুঝলো কই ? তারা তো সবাই নিজের নিজের ভোট আর নোট গুনলো। এমনকি যখন বুথে বুথে ভোট লুঠ হবে তখন এই অপদার্থ কর্তৃপক্ষের টিকিরও দেখা পাওয়া যাবে না। এটা আগাম বলে দেওয়া যায় অবাধ নির্বাচন পরিচালনার পরীক্ষায় এরা ডাহা ফেল করবেন। কাজেই সবকিছু জেনে বুঝে এমন এক “ভোটলুঠ” উৎসবের জন্য উচ্চমাধ্যমিকের মত একটা গুরুত্ত্বপূর্ণ পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া কি আদৌ যুক্তিযুক্ত!

১৯৯৭ সালে আমাদের সময় প্রশ্নপত্র ফাঁসে তাও দোষীব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছিল বলে স্বস্তি পেয়েছিলাম! কিন্তু এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কর্তৃপক্ষকে কে শাস্তি দেবে? মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ভোটার লিস্টে নাম নেই বলে কি তারা আজ “গিনিপিগ”! মনে রাখবেন একদিন কিন্তু ভোটার লিস্টে এদের নাম উঠবে।

তবে এরপরেও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের বলছি, একটুও ভয় পেয়ো না, ভালো করে পরীক্ষা দাও।

রাইজ অফ ভয়েসেসের তরফ থেকে অনেক শুভেচ্ছা রইল।