মুখ নেই, পতাকা নেই…হাতে রইল পেন্সিল / Pencil In hand

আত্মানুসন্ধান বা আত্মসমালোচনা যখন খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে বারবার করতে হয়, তখন বুঝে নিতে হবে সেই আত্মানুসন্ধান বা আত্মসমালোচনাতে কিছু পদ্ধতিগত ত্রুটি রয়ে গেছে। মানে ‘গলদ’টা গোড়ায়। যদি এই মন্থন প্রক্রিয়াটি শুরুর আগেই অংশগ্রহণকারী ব্যক্তি বিশেষ বা দল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে ‘তাদের নীতিগত বা কৌশলগত অবস্থান সব ঠিকই আছে, শুধুমাত্র তার বাস্তব ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু খামতি থাকায় কাঙ্খিত সাফল্য আসছে না’, তাহলে আর সেই আত্মানুসন্ধান বা আত্মসমালোচনার কোন প্রয়োজন দেখি না। কারণ এই ধরনের অনুশীলন তখনই কাজে আসে, যখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা দল, সময় ও পরিস্থিতির সাথে নিজেকে বদলাবার ইতিবাচক মানসিকতা ধরে রাখে। ‘সময়োপযোগীতা মানেই ধান্দাবাজি বা আপসকামী শক্তির সাথে হাত মিলিয়ে ফেলা’, যাকে কেউ কেউ ‘শোধনবাদ’ বলে দেগে দেন, বাস্তবে এমনটা নাও হতে পারে।

এই মুহুর্তে দেশব্যাপী যে কটি বামপন্থী দল আছে তারা সবাই কম বেশি এই দোষে দুষ্ট। “শোধনবাদ” যে একটি কটু শ্লেষাত্মক শব্দও হতে পারে তা এনারা না থাকলে আমাদের অজানা থাকত। সময়ের সাথে সাথে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতায় জারিত হতে হতে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবহারিক জীবনের সংশোধন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই যে এককালের গুহাবাসী মানব সভ্যতা আজকের শহরবাসী হয়েছে, তার মূলেও যে “শোধনবাদ” বা নিজেকে সংশোধন বা শুদ্ধ করবার ইচ্ছে, সেটা আমরা কেউই অস্বীকার করতে পারি না। যাইহোক, ভারতীয় রাজনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে বামেদের শক্তি ক্রমশঃ সীমিত ও স্তিমিত হয়ে আসায় রাইজ অফ ভয়েসেসের তরফে এই নিয়ে কোন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। কিন্তু কংগ্রেসের মত একটি সর্বভারতীয় দক্ষিণপন্থী দল সাম্প্রতিক অতীতে বা মূলতঃ গত এক দশকে ঐ একই রোগের স্বীকার হয়ে পড়ায় জাতীয় স্তরে একটি বিকল্পহীন একদলীয় শাসণ ব্যবস্থা জাঁকিয়ে বসছে, যা দেশের গণতান্ত্রিক পরিসরকে সংকুচিত করছে। আর অনেকটা এই কারণেই বর্তমান প্রতিবেদনটির প্রস্তাবনা।

এমন বল্গাহীন একদলীয় শাসন ব্যবস্থা ভারতবর্ষে যে এই প্রথম এমনটাও নয়। স্বাধীনোত্তর ভারতের শুরুর দিকের প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল এইরকম একটি ব্যবস্থাই চালু ছিল। ঘটনাচক্রে সেই সময় এই একদলীয় দলটির নাম ছিল কংগ্রেস। আর এখন যে একদলীয় ব্যবস্থা জাঁকিয়ে বসেছে সেই একদলীয় দলটির নাম বিজেপি। মতাদর্শের নিরিখে দুটি দলই দক্ষিণপন্থী। যদিও মজার বিষয় হল এই দুটি দলই চীন ও উত্তর কোরিয়ার উদাহরণ তুলে রটিয়ে বেড়ায়, বামপন্থীরা নাকি একদলীয় অনুগত্যপ্রধান শাসন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী। কিন্তু ভারতবর্ষে যেখানে বামপন্থীরা নিজেরাই বহু দলে বিভক্ত তারা কিভাবে একদলীয় শাসনব্যবস্থার জন্ম দেবে মাথায় ঢোকে না। যাইহোক, এই প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু অন্য। কাজেই আমরা আমাদের আলোচনা, কেন এই মুহুর্তে দেশজোড়া এমন একটি একদলীয় আনুগত্য প্রধান ও বিকল্পহীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হল, তার আত্মানুসন্ধানেই সীমাবদ্ধ রাখব। বিশেষতঃ সাম্প্রতিক পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলাফল সামনে আসতেই এমনই একটা বিরোধীহীন শাসক অনুগত গণতন্ত্রের ছবি সামনে এসেছে যা আদতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারই পরিপন্থী। আর এর পিছনে রয়েছে বিরোধীদের বা মুলতঃ কংগ্রেস এবং বামপন্থী দল গুলির এই ‘আত্মরোগ’। আত্মরোগ বলছি, কারণ এ হল আত্মার পরিবর্তন না ঘটিয়ে, মানে নিজেকে যতটা পারা যায় সংশোধন না করে, অবিকৃত রেখে ঘন ঘন আত্মানুসন্ধানের মধ্য দিয়ে সমস্যার বা নির্বাচনী বিপর্যয়ের কারণ ও সমাধান খুঁজতে চাওয়া।

আঞ্চলিক দল গুলিকে এর মধ্যে আনছি না, কারণ এই দলগুলি তৈরিই হয়েছে কংগ্রেস ও বামদল গুলির স্থবিরতা এবং ব্যর্থতার জন্যে। আমাদের বহুমাত্রিক দেশের বহুমুখী আঞ্চলিক আশা-আকাঙ্খা না মেটার জন্য। এরা মুলতঃ যার যার হোমস্টেট-এ সীমাবদ্ধ। তার ওপর এরা কখন কার সাথে জোট করে ক্ষমতা ভোগ করে, তার যেমন কোন ঠিক থাকে না, ঠিক তেমনই এগুলির বেশিরভাগই পরিবার বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল হওয়ায় মূলত চালিত হয় গুটিকয় ব্যক্তির রাজনৈতিক অবস্থান ও সমীকরণের ওপর। ফলে এদের কারোর পক্ষেই একজোট হয়ে নীতি বা মতাদর্শের ভিত্তিতে বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদলের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সভায় কয়েকটি মন্ত্রক ছেড়ে দিলেই, এরা যে কোন দলকে সমর্থন দিয়ে দেবে এবং সাম্প্রতিক অতীতে এমন বহু অভিজ্ঞতার আমরা সাক্ষী আছি। লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল এবং কিছুটা হলেও মুলায়ম সিং যাদবের এর সমাজবাদী পার্টি ছাড়া কারোরই এব্যাপারে তেমন খুব একটা বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। কাজেই এদের মত “বন-মোরগের” পিছনে ছুটে আপাতত আমরা সময় নষ্ট করতে চাই না।

ফিরে আসি সাম্প্রতিক নির্বাচনী ফলাফলের আত্মানুসন্ধানে। কংগ্রেস এবং সপা নেতৃত্ব ভেবেছিলেন এই নির্বাচনে তিন “কালো” কৃষি আইন প্রত্যাহৃত হলেও, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপির অনড় মনোভাব এবং ছলচাতুরীর প্রভাব পড়বে ইভিএম মেশিনে। সেইসঙ্গে উন্নাও বা হাতরাসের মত নারী নিগ্রহের ঘটনা, সংখ্যালঘু ও দলিতদের উপর যোগী-মোদী শাসনে রাজনৈতিক ও সামাজিক আগ্রাসন, দেশজোড়া বেকারী সমস্যা, গ্যাস বা পেট্রোল ডিজেলের অগ্নিমূল্য ইত্যাদি অনেক কিছুরই নেতিবাচক প্রভাব প্রতিফলিত হবে ভোটবাক্সে। এমনকি আমাদের রাইজ অফ ভয়েসেস টিমের অনেকেই এরকমটা আশা করেছিলেন। কিন্তু লেখক প্রথম থেকেই এতটা আশাবাদী ছিলেন না। এর পিছনে মুলতঃ দুটি কারণ রয়েছে।

প্রথম কারণ হল বিরোধী দলগুলির তরফে এখনও তেমন কোন সর্বজনগ্রাহ্য এবং গ্রহণযোগ্য নেতা/মুখ গত এক দশকে সামনে না আনতে পারা। আর এর মূল দায় কংগ্রেসের এবং কিছুটা হলেও বামপন্থী দলগুলোর। কারণ কংগ্রেস এই দুর্দিনেও বিরোধী জোটের একমাত্র সর্বভারতীয় দল এবং জনপ্রতিনিধিত্বের নিরিখে সর্ববৃহৎও বটে। কাজেই তাদের নেতাই যে বিরোধী জোটের নেতা হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে সেইসঙ্গে জোটের বাকি দলগুলির কাছেও গ্রহণযোগ্য হতে হয়। আর বাম দলগুলির নেতা বা মুখদের কাজ থাকে মূলতঃ বাকি আঞ্চলিক দলগুলোর সাথে কংগ্রেসের ইস্যু ভিত্তিক মেলবন্ধন ঘটানো। কিন্তু এসবই হল নির্বাচনোত্তর প্রক্রিয়া। তার আগে নির্বাচনে কংগ্রেস ও বামদল গুলিকে যথেষ্ট পরিমাণ জনপ্রতিনিধিকে জিতিয়ে আনতে হবে, এই প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখবার জন্য। আর এই কাজটা সেই নেতাদেরকেই করতে হবে যারা নির্বাচনের পর জোট গঠনে অগ্রণী ভূমিকা নেবেন।

কিন্তু সেখানেই খামতি দেখা যাচ্ছে। কারণ কংগ্রেস বা বাম দলগুলোতে সেই “ভোট জিতিয়ে” আনা নেতার খুবই অভাব। মনে রাখতে হবে হাজার ইস্যু থাকলেও সেটাকে মানুষের মাঝে নিয়ে যেতে এবং সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে একজন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বস্ত নেতা দরকার, যিনি বেকারী, মূল্যবৃদ্ধি, দলিত হত্যা, সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার বা কৃষিবিল, বল্গাহীন বেসরকারীকরণ ইত্যাদি ইস্যুগুলোকে মানুষের সামনে বার বার তুলে ধরে একটা প্রতিবাদী বিকল্প অবয়ব দেন।

এটা অনেকটা ডাক্তার দেখানোর মত। আমাদের জ্বরজ্বালা-পেটব্যাথা ইত্যাদি কম জটিল রোগ অসুখ হলেও যদি সামর্থ থাকে তো আমরা একজন ডাক্তারকে দেখিয়ে তার পরমার্শ মত ওষুধ কিনে খাই। যদিও জানি, ওষুধের দোকানে বসা কম্পাউন্ডার বা ফার্মাসিস্টরা অথবা কোন জানাশোনা মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভও হয়ত ঐ একই ওষুধ খেতে বলতেন, তাও ডাক্তারের কাছে যাওয়ার একটা চেষ্টা থাকে আমাদের মধ্যে। কারণ একজন এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার আমাদের একটা নির্ভরতা দেন। হাতের কাছে কোন ডাক্তার না পেলে তবেই বিক্ষিপ্তভাবে এর ওর পরামর্শ মত ওষুধ কিনে সাময়িক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করি। কেউ ফোন করি মেডিক্যাল রিপ্রেসেন্টেটিভ বন্ধু বা আত্মীয়দের। কেউ আবার পরামর্শ নিই পাড়ার ওষুধের দোকানদারের। কিন্তু রোগীর লাইন পড়ে পাড়ার মোড়ের ডাক্তারবাবুর চেম্বারেই। অন্য কোথাও পড়ে না। এটাই স্বাভাবিক।

সেই একই স্বাভাবিক নিয়মে জনমানসও একজন পরীক্ষিত অভিজ্ঞ নেতা খোঁজে। যাকে নির্ভর করা যায়। কিন্তু সেই “মুখ” বা “নেতা” যদি না থাকে তাহলে বিরোধী পরিসর জোটবদ্ধ হতে পারে না। সেই ভোট বিক্ষিপ্তভাবে ভাগ হয়ে যায় বিভিন্ন দল ও উপদলে। আর তারই প্রতিফলন ঘটেছে উত্তরপ্রদেশ ও গোয়ায়। পাঞ্জাব আর উত্তরাখন্ডে তো রাজ্যস্তরে কে নেতা তা নিয়েই দীর্ঘ আকচা আকচি চলেছে, খোদ কংগ্রেস দলের মধ্যেই। এমনকি হাইকম্যান্ড বা গান্ধী পরিবারের হস্তক্ষেপেও তা মেটেনি বা মিটলেও তা মানুষকে ভরসা জোগাতে পারেনি। মানে “হাইকম্যান্ড” এর কম্যান্ড মানতে চাইছে না রাজ্যস্তরের নেতারা মায় ভোটারদের একটা বড় অংশ। কাজেই সময় এসেছে হাইকম্যান্ডের মুখ বদলের। কিন্তু কংগ্রেস যদি মুখ না বদল করে আত্মানুসন্ধান চালিয়ে যায়, তাহলে বারবার সেকাজ করলেও এই সমস্যার সমাধান হবে না। ফলাফল একই থাকবে বা ক্রমশঃ আরও খারাপ হতে থাকবে। কংগ্রেস নেতাদের একাংশের বক্তব্য, গান্ধী পরিবারের কাউকে সামনে না রাখলে দল ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। এমনকি কংগ্রেস দলের মধ্যেই যে জি-২৩ গ্রুপ সংস্কারের দাবি তুলে আন্দোলন চালাচ্ছে, তারাও কতটা ঐক্যবদ্ধ তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। হয়ত তাদের মধ্যেথেকেই চার-পাঁচজন কংগ্রেস সভাপতি পদের জন্য মনোনয়ন পেশ করে দেবে। তারপর শুরু করে দেবে লবিবাজি। কাজেই সাম্প্রতিক অতীতে বারবার পরীক্ষিত এবং প্রত্যাখ্যাত গান্ধী পরিবারের প্রতিনিধিদের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে, তার বাইরে থেকে নতুন নেতা নির্বাচিত করে এনে নিজেদের ঐক্যবদ্ধ রাখবার মত দুরূহ কাজটাই কংগ্রেসকে করতে হবে।

আর বাম দলগুলি আবার জন্মকাল কাল থেকে বলে আসছে “নেতা নয়, নীতি।” মানে তারা নেতা হিসেবে কাউকে সামনে তুলে ধরতেই আগ্রহী নয়। রাজনৈতিক মতাদর্শ ও নীতি আওড়াতে এবং বিকল্প প্রশাসনিক অবয়ব মানুষের সামনে তৈরি করতে যে একটা মুখ দরকার, সেই প্রয়োজনীয়তাটাই এরা স্বীকার করতে চান না। তাদের মতে এসবই নাকি ব্যক্তিপূজা। লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে উঠে আসা একজন পরীক্ষিত ও বিচক্ষণ মানুষকে সামনে রেখে আন্দোলন সংগঠিত করা, খামোখা ব্যক্তিপুজো হতে যাবে কেন তা আমাদের বোধগম্য হয় না। লেনিন বা মাও জে দং রা কি নেতা ছিলেন না! জ্যোতিবাবু বা ইএমএস কারা!

এমনকি পাঞ্জাবে আম আদমি পার্টি যে সাফল্য পেয়েছে বা সমাজবাদী পার্টি উত্তরপ্রদেশে যেটুকু প্রতিরোধ করতে পেরেছে, বা তামিলনাড়ু, অন্ধ্র অথবা তেলেঙ্গানাতে এমনকি আমাদের বাংলাতেও যে আঞ্চলিক দলগুলি ক্ষমতায় রয়েছে তা কিন্তু অনেকটাই তাদের নেতাদের হাতযশে। এই বাস্তব অস্বীকার করবার মত মুর্খামি আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস করতে পারব না।

কাজেই কংগ্রেসের “আমি নেতা বদলাবো না” আর বামেদের “আমি নেতা খুঁজবো না” এই যুগপৎ সিদ্ধান্ত যদি আত্মানুসন্ধানের আগেই নেওয়া হয়ে যায়, তাহলে প্রতিবার নির্বাচনী বিপর্যয়ের পর, এই ঢাকঢোল পিটিয়ে “ফলাফল থেকে শিক্ষা নিতে হবে” বা “আত্মানুসন্ধান বা আত্মবিশ্লেষন করা হবে” এইসব আপ্তবাক্য না আওড়ানোই বোধহয় সমীচীন হবে।

এবার আসি দ্বিতীয় কারণটাতে। বিরোধীদল গুলির সব নেতাই এক প্রকার নিশ্চিত ছিলেন, এবারের ভোটে কৃষিআইন নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের টাল-বাহানা ও অনড় মনোভাবের ফায়দা তোলা যাবে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী সেই বিতর্কিত তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করবার পরও। কিন্তু আমরা দেখেছি প্রথম দিন থেকে এই কৃষক আন্দোলনের নেতারা আন্দোলনটিকে অরাজনৈতিক তকমা দিতে ব্যস্ত ছিলেন। সরকার বিরোধী একটি আন্দোলনকে কেন অরাজনৈতিক হতে হবে, আমাদের মাথায় ঢোকে না। যেখানে সরকার নিজেই নির্বাচনের মত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়, সরকার চালায় এক বা একাধিক রাজনৈতিক দলের জোট সেখানে প্রতিবাদ আন্দোলনের অরাজনৈতিক হওয়ার কোন দায় থাকে না। পাছে সরকার “বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির চক্রান্ত” বলে দেগে দেয় তাই দলের পতাকা লুকিয়ে ফেলে আন্দোলন করলে, ভোট বাক্সে হতাশা ছাড়া তার বেশি কিছু জোটে না, এই সারসত্যটা বিরোধী দলগুলিকে স্বীকার করতে হবে। রাজনৈতিক পতাকাবিহীন আন্দোলন আদৌ যে কোন রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড দেয় না, তা এবারের পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট ! যে আম আদমি পার্টি পাঞ্জাবে এই আন্দোলনের ফায়দা তুলল বলে মনে করছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একটি বড় অংশ, সেই দলটি কি আদৌ এই আন্দোলন সংগঠিত হওয়ার সময় কোনভাবে যুক্ত থেকেছে! আমাদের জানা নেই। মানে সোজা কথায় নেপোয় দই মেরে দিয়েছে বললেও ভুল হবে না। আর উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনেও সেভাবে এই আন্দোলন দাগ কাটতে পেরেছে বলে আপাত দৃষ্টিতে ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে না। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের জাঠ-কৃষকেরা বিজেপিকেই ঢেলে ভোট দিয়েছে এমনটাই ফলাফল দেখে মনে হচ্ছে। এমনকি যতটা খবর পেয়েছি যে, সমস্ত কৃষক আন্দোলনের নেতারা আলাদা আলাদা দল গড়ে পাঞ্জাবে এবারের ভোটে লড়েছেন, তাদের প্রায় সবারই জামানত জব্দ হয়েছে।

কাজেই কৃষি আইন প্রত্যাহৃত হওয়ার পর যেসমস্ত বামপন্থী নেতারা এমন একটি পতাকাবিহীন আন্দোলনের অংশ হয়ে আত্মশ্লাঘা বোধ করছেন এবং এই আন্দোলনের থেকে বারে বারে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলছেন, তারা এর পাশাপাশি এমন একটি আন্দোলনের বৃহৎ অংশের সংগঠক হয়েও কেন প্রতিবাদ মঞ্চে নিজেদের পতাকা ওড়াতে পারলেন না, তার আত্মসমালোচনাও করছেন কি! আম আদমি পার্টি যদি পাঞ্জাবে ‘শূন্য থেকে নব্বই’ হতে পারে তাহলে বামেরা কেন ‘শূন্য থেকে নয়’ ও হতে পারল না, ভেবে দেখছেন কি কেউ! এমনকি স্বয়ং টিকায়েত যখন বিগত বিধানসভা ভোটের প্রাক্কালে পশ্চিমবঙ্গে এসে “নো ভোট টু” স্লোগান তুলে কার্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হয়ে হাওয়া তুলে গেলেন, তার কোন প্রতিবাদ করতে পেরেছেন কি হান্নান মোল্লার মত অভিজ্ঞ সিপিআই(এম) নেতারা? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কোন কৃষক আন্দোলনটা করেছেন! এমনকি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার ২০১৪ সালে যে কৃষি আইন পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভায় পাশ করিয়েছেন, তার ব্যবহারিক তাৎপর্য অনেকক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ে আসা কৃষি আইনের অনুরূপ। বৃহৎ কোম্পানী অথবা তার নিযুক্ত দালাল, কেবলমাত্র কৃষকের কাছ থেকে ইচ্ছেমত দামে ফসল কিনতে পারবে তাই নয়, ক্রমশ সমগ্র কৃষি বাজারকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার অধিকারও এই আইনে পেয়েছে। সেই আইনে কোথাও বলা হয়নি ‘সরকার নির্ধারিত সহায়তা মূল্য’-র চাইতে কম মূল্যে কোনো কোম্পানী বা ব্যক্তি চাষীর কাছ থেকে ফসল কিনতে পারবে না। কিন্তু তারপরেও অরাজনৈতিক কৃষক আন্দোলনের নেতারা কার্যত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, কারণ তিনি নাকি বিজেপির বিরুদ্ধে! ভোটবাক্সেও দেখা গেছে তার প্রতিফলন। আর বামেরা সিঙ্ঘু বর্ডারে আন্দোলনের মূল হোতা হয়েও কৃষক সমাজের সামান্য ভোটও পাননি।
অবশ্য এমন পতাকাবিহীন আন্দোলনের উদাহরণ আমাদের রাজ্যেও রয়েছে । শিক্ষক নিয়োগে শাসকদলের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে যে স্থবিরতা ও স্থগিতাবস্থা চলছে তার বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনের মঞ্চটিও নাকি অরাজনৈতিক! আর পরিণতি সেই এক! কোন বিরোধীদল এর ফায়দা তুলতে পারেনি। এমনকি আন্দোলনকারীদের কপালেও “তারিখ পে তারিখ” ছাড়া কিছুই জোটেনি। চিটফান্ড আন্দোলনের কমিটি, ‘আক্রান্ত আমরা’ অথবা ‘সেভ ডেমোক্রেসি’ ইত্যাদি অরাজনৈতিক মঞ্চ গুলিও কি আদৌ কাউকে কোন ন্যায় বিচার দিতে পেরেছে! যদিও এগুলির সাথে যুক্ত রয়েছেন মূলতঃ বামপন্থী মানুষেরাই, তবুও তার কি কোন ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে বামেদের ভোটবাক্সে! ফলাফল তো সেকথা বলছে না। কাজেই দলের পতাকা পকেটে ঢুকিয়ে আন্দোলন করে সেই আন্দোলন থেকে ভোট কুড়ানো যায় না, এই সত্যটাও স্বীকার করবার সময় হয়েছে। এখনও যে সেটা বামপন্থীরা বুঝে উঠতে পারেননি, তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ হল আনিস হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে বামপন্থীদের ফের একবার পতাকাবিহীন মিছিলে পা মেলানো!

কাজেই গোড়ায় গলদ রেখে, আগায় আত্মানুসন্ধানের মন্ত্রজপে সকাল সন্ধ্যে জল ঢেলে লাভ নেই।

দিনের শেষে হাতে পেন্সিলই থাকবে।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস