উদয়ন মাস্টারের চিঠি / To The People of Hirak

প্রিয় হীরকবাসী,

মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র। হীরক রাজার সেই যুগান্তকারী যন্ত্র, যার মাধ্যমে শত্রুদের নিজের নিয়ন্ত্রণে আনত হীরক রাজ। আজ থেকে ৪৩ বছর আগে যখন সত্যজিৎ রায়, হীরক রাজার গল্প লিখেছিলেন, তখন দেশে মস্তিষ্ক প্রক্ষালন বা মগজধোলাইয়ের ব্যবস্থা ছিল এক্কেবারে অন্যরকমের। হামলা, মামলা থেকে প্রপাগান্ডা ছিল মগজধোলাইয়ের অন্যতম কিছু অস্ত্র। কিন্তু পুরো ব্যবস্থাটাই ছিল অসংগঠিত, ঝক্কিও ছিল প্রবল। কিন্তু পৃথিবী বদলেছে, অনেকটাই বদলেছে, তাই হীরক রাজও বদলেছে, তার প্রপাগান্ডার প্রেশক্রিপশানও বদলে গেছে।

ছোটবেলায় স্কুলে যখন আমরা পড়েছি, তখন সাজেশান হিসেবে যে প্রবন্ধ সক্কলের কাছে কমন ছিল, সেটা হল “বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ”। তাতে আমরা লিখতাম, কিভাবে বিজ্ঞানের যুগান্তকারী আশীর্বাদস্বরূপ আবিষ্কারগুলো কিছু ক্ষমতালোলুপ, মুনাফালোভী মানুষ বা গোষ্ঠীর হাতে গিয়ে কিভাবে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়।

১৯৭৩ সালে মার্টিন কুপার যখন মোবাইল আবিষ্কার করেন, তখন তা মানুষে মানুষে যোগাযোগের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার হলেও ক্রমেই তা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে হতে এক অন্যরকম রূপ নিয়েছে, যাকে এই মূহুর্তে মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্রের মিনিয়েচার বললে খুব একটা ভুল বলা হবে না।

আজ শারদীয়ার পুন্যালগ্নে, এই নিয়ে আকচা-আকচি না করে, আপনাদের সামনে আজ রাখছি গোটা দশেক তথ্য, যেগুলো আজ না হলেও, কোনো একদিন কাজে লাগবে আপনাদের।

১. গোটা বিশ্বে মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৮০৬ কোটি, যাদের মধ্যে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করেন ৪৮০ কোটি মানুষ, যা সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার প্রায় ৬০%।

২. একজন মানুষ দৈনিক ২ ঘন্টা ২৪ মিনিট সোশাল মিডিয়াতে ব্যয় করেন। আপনিও জানতে পারেন, আপনি কতক্ষণ মোবাইলে কাটান। তার জন্যে আপনার অ্যান্ড্রয়েড মোবাইলের সেটিংসে গিয়ে ক্লিক করুন, “Digital Wellbeing and Parential Control” আর জেনে যান, আজ ঠিক কতক্ষণ আপনি মোবাইলে কাটিয়েছেন।

৩. সারা পৃথিবীর প্রায় ৪৪% ইন্টারনেট ব্যবহারকারী যেকোনো তথ্যের প্রাথমিক উৎস হিসেবে সোশাল মিডিয়াকে বিবেচনা করেন।

৪. এনসিআরবি’র তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে, অর্থাৎ প্যান্ডেমিকের বছরে ১,৫২৭টি ফেক নিউজের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে এই রকম ফেক নিউজের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৮০ এবং ৪৮৬।

৫. দ্য জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে গোটা পৃথিবীতে ইন্টারনেটের ৬২% তথ্য “অসত্য এবং সন্দেহজনক”।

৬. টুইটারের গত ১২ বছরের ডাটা অনুযায়ী একটি সত্য তথ্য ১,০০০ জনের কাছে পৌঁছালে, অসত্য তথ্য ১০,০০০ জনের কাছে পৌঁছে যায়।

৭. একটি সমীক্ষায় পাওয়া গেছে একজন মোবাইল ব্যবহারকারীকে গোটা দিন মোবাইল ব্যবহার করতে না দিলে, তার মানসিক স্বাস্থ্য বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা ৯৪%।

৮. দেশে ফেক নিউজ প্রচারের অন্যতম হাতিয়ার সোশাল মিডিয়া। দেশে ২০১৯ সালে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর পরিমাণ ৬০ কোটি, যা ২০১২ সালে ছিল প্রায় ১৪ কোটি।

৯. ২০১৩ সালের মুজাফ্ফরনগর রায়টের প্রধান কারণ ছিল লাভ জেহাদের ওপরে একটি ফেক নিউজ ভিডিও। যার ফলে ৬২ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং ৫০,০০০ মানুষ গৃহত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।

১০. ভারতে প্রায় ৬০% মানুষ ফেক নিউজের সংস্পর্শে এসেছেন, যেটা গোটা পৃথিবীর গড়ের চেয়ে ৩% বেশি।

আসলে যে টেকনোলজি আমাদের খুব সহজেই একে অপরের সাথে কানেক্ট করে, তারাই আমাদের কন্ট্রোল করে, মানিপুলেট করে, ডিভাইড করে, পোলারাইজ করে এবং আমাদের আপনাদের পণ্য বানায়।

আর এই মুহূর্তের আয়রনি কি জানেন? এই চিঠি আপনি মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্রের মাধ্যমেই পড়ছেন। আর এই চিঠির তথ্য নিয়ে একটুকু সন্দেহের অবকাশ থাকলে অবশ্যই যাচাই করুন।

ধন্যবাদান্তে,
উদয়ন মাস্টার