এথিক্স : মাদারি কা খেল / The Committee of Ethics

তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে নদীয়ার কৃষ্ণনগর লোকসভা থেকে নির্বাচিত মহুয়া মৈত্রকে নিয়ে হৈ চৈ নতুন কিছু না। বিগত লোকসভা নির্বাচনে বামেরা ‘শূন্য’ হাতে ফেরার পর বাংলা থেকে যে ক’জন হাতেগোনা বাগ্মী সাংসদ সংসদে আছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন এই মহুয়া মৈত্র। বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতা শ্রীমতী মৈত্র রাজনীতিতে প্রবেশের পূর্বে নামজাদা বেসরকারি সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্ত্রীও ছিলেন। ফলে সংসদীয় রীতিনীতির অতীত ইতিহাস ঘেঁটে এবং বিভিন্ন সরকারী নীতি ও প্রণীত আইন পড়ে তথ্যসমৃদ্ধ পেশাদারী বক্তব্য পেশ করতে তিনি সিদ্ধহস্ত। তাঁর বক্তব্যের জেরে লোকসভায় সরকার পক্ষকে বহুক্ষেত্রে বেগ পেতে হয়েছে। স্বাভাবিক কারণেই লোকসভার অভ্যন্তরে রাহুল গান্ধী ছাড়া যে কয়েকজন বিরোধীদলের সাংসদ সরকার পক্ষের টার্গেটে থাকেন তারমধ্যে মহুয়া মৈত্র অন্যতম।
সম্প্রতি জনৈক বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে লোকসভার স্পিকারকে চিঠি লিখে এইমর্মে অভিযোগ করেছেন যে লোকসভায় বিভিন্ন সময় সাংসদ মহুয়া মৈত্র আদানী ইস্যুতে যেভাবে সরব হয়েছেন, তার পেছনে আদানী শিল্পগোষ্ঠীর প্রতিদ্বন্দ্বী শিল্পগোষ্ঠী হীরানন্দানির হাত আছে। শ্রীমতি মৈত্র হীরানন্দানি পরিবারের ঘনিষ্ঠ এবং তাদের থেকে টাকা নিয়েই তিনি সংসদে আদানীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় বক্তব্য রেখে হীরানন্দানিকে ব্যবসায়িক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। অভিযোগটি যে অত্যন্ত গুরুতর তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। দোষী প্রমাণিত হলে মহুয়া মৈত্রর যে সাংসদ পদ খারিজ হবে শুধু তাই নয়, তিনি সম্ভবত আগামীদিনে আর কোনদিন লোকসভা অথবা বিধানসভা ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা পর্যন্ত করতে পারবেন না। লোকসভার স্পিকার ওম বিড়লা সমগ্র অভিযোগটি বিশদে খতিয়ে দেখতে সংসদীয় এথিক্স কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছেন, এই মুহুর্তে যার চেয়ারম্যান বিজেপি সাংসদ বিজয় সোনকার।

দেশ ও রাজ্যের সব সংবাদমাধ্যমই ওপরে উল্লেখিত খবরটি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছেন। ফলে প্রশ্ন উঠতেই পারে তাহলে রাইজ অফ ভয়েসেস হঠাৎ মহুয়া মৈত্রকে নিয়ে পড়লো কেন! তা কি নিতান্তই ফুটেজ খেতে! সস্তা জনপ্রিয়তা কুড়োতে!

না। রাইজ অফ ভয়েসেস অযাচিত ফুটেজ চায় না। খায়ও না।

আমরা শুধু আমাদের পাঠকদের এই মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে বিজেপির তোলা ‘ক্যাশ ফর কোয়্যারি’র অভিযোগ প্রসঙ্গে অতীতের নারদ স্টিং কেলেঙ্কারির কথা মনে করিয়ে দিতে চাই। হ্যাঁ, সেই স্টিং অপারেশন যেখানে তৃণমূলের একগুচ্ছ প্রথমসারির সাংসদ/বিধায়ক ও নেতাদেরকে ঘুষ খেতে দেখা গেছিল। বিনিময়ে ঘুষ যিনি দিচ্ছিলেন তাঁর তরফে লোকসভা বা বিধানসভায় বিশেষ একটি প্রসঙ্গ উত্থাপনের অনুরোধ করা হচ্ছিল অথবা দাবী করা হচ্ছিল প্রশাসনিক সুযোগ সুবিধার যাতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বাণিজ্যিক সংস্থার ব্যবসায়িক সুবিধা হয়। ঘটনাটি ২০১৪ সালের। সামনে আসে ২০১৬তে। তখন রাজ্য বিধানসভার ভোটের দামামা বেজে গেছে। তাই বিজেপির সদরদপ্তর থেকে রীতিমত ভিডিও কনফারেন্সিং করে সাংবাদিকদের দেখানো হয় সেই স্টিং অপারেশনের ভিডিও। উদ্দেশ্য বামেদেরকে সরিয়ে রাজ্য রাজনীতির বিরোধী ভোট ও পরিসর কব্জা করা। আজ সেদিকে ফিরে তাকালে বলা যেতেই পারে তাতে বিজেপি পুরোপুরি সফল। তবে যেটা হয় নি সেটা হলো সেই ঘুষ কেলেঙ্কারির কোন যথাযথ তদন্ত। সে সময়ও সংসদীয় এথিক্স কমিটিকে খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন স্পিকার। কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন স্বয়ং লালকৃষ্ণ আদবানি। কিন্তু গত দশ বছরে সেই কমিটি নারদ স্টিং কেলেঙ্কারি খতিয়ে দেখতে মিটিং এ বসেছিল মাত্র একবার। তদন্ত কিছুই হয়নি। এর ফলে বামেদের সেটিং তত্ত্বে সিলমোহর পড়েছে কি না আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস জানি না, কিন্তু বাস্তব হলো সেই সমস্ত ঘুষখোর তৃণমূলী সাংসদ-নেতা-মন্ত্রীদের একজনেরও কোন শাস্তি হয়নি, উল্টে ঘুসকান্ডে অভিযুক্ত একের পর এক তৃণমূল নেতা-সাংসদ দল বদলে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে ঢুকেছে। বর্তমানে রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা বিজেপি বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী নিজেই নারদ ঘুষকান্ডে অভিযুক্তদের অন্যতম। আরেকজন অভিযুক্ত শঙ্কুদেব পাণ্ডাকেও সন্ধ্যে হলেই চ্যানেলে চ্যানেলে বিজেপির হয়ে গরম গরম বক্তৃতা দিতে দেখা যায়।
কাজেই নিশিকান্ত দুবের মত হাতেগোনা কিছু বিজেপি সাংসদ “ক্যাশ ফর কোয়্যারি” নিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করলেও বিজেপির কাছে ঘুষখোর নেতা-মন্ত্রীরা মোটেই অচ্ছুৎ নয়। বরং তাদেরকে সসম্মানে দলে নিয়ে বড়বড় পদ দিতেই তারা বেশি অভ্যস্ত।

আর তাই কোন প্রথমসারির সংবাদ মাধ্যম অনিবার্য প্রশ্নটা তুললো না বলেই রাইজ অফ ভয়েসেসকে প্রশ্নটা তুলতে হচ্ছে।

মহুয়া মৈত্র কে নিয়ে বিজেপির অস্বস্তিটা ঠিক কোথায়! তিনি ঘুষ নিয়েছেন বলেই কি বিজেপির এত রাগ, নাকি তিনি ঘুষ নিয়ে বিজেপি ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে সংসদে মুখ খুলে হইচই পাকিয়েছেন তাই বিজেপির এই অতি সক্রিয়তা! এর আগে সংসদের মধ্যে রাহুল গান্ধী আদানি নিয়ে মুখ খোলায় তাঁকেও মামলা-মকদ্দমায় জড়িয়ে সংসদ থেকে দূরে রাখতে সচেষ্ট ছিল বিজেপি শিবির! কাজেই প্রশ্নটা কিন্তু উঠছেই!

আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস চাই সংসদীয় এথিক্স কমিটি বসুক। মহুয়া মৈত্রর বিরুদ্ধে তদন্ত হোক। তদন্ত হোক অতীতের নারদ স্টিং অপারেশনেরও। আর আদানির বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় বেনিয়মের অভিযোগেরও যথাযথ দ্রুত তদন্ত করুক সেবি। দরকারে ইডি/সিবিআইও স্বতঃপ্রণোদিত মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করুক।

দেশের প্রধান চৌকিদার ও তার দলবলের কাছ থেকে এটুকু ‘এথিক্স’ আশা করা কি অন্যায়!

জানতে চায় বাংলা। জানতে চায় দেশ।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস