সত্যি ক্ষুদিরাম / The Theory

যুদ্ধ লাগিয়াছে মধ্যপ্রাচ্যে, দেশীয় সংবাদমধ্যম ইতিমধ্যেই তল্পিতল্পা গুটাইয়া পাড়ি দিয়াছেন দেশের রাজধানী হইতে ৪০০০ কিলোমিটার দূরের ইজরায়েলে। তাহারা সরাসরি সম্প্রচার করিতেছেন ইজরায়েল প্যালেস্টাইন যুদ্ধ এবং দেশবাসী দু নয়ন ভরিয়া তাহা দেখিতেছেন। রাজ্যাওয়ারি বঙ্গীয় সংবাদমাধ্যমগুলিও পিছাইয়া পড়ে নাই, দেশীয় মিডিয়ার সহিত তাহারাও পৌঁছাইয়া গিয়াছে কলকাতা হইতে ৫,৩০০ কিলোমিটার দূরবর্তী তেল অভিভে। আর তাহাদের চ্যানেলের সঞ্চালকেরা ঠান্ডা ঘরে বসিয়া গলার শিরা ফুলাইয়া তর্জন গর্জন করিয়া যাইতেছেন এবং তাহাদের যোগ্য সঙ্গত দিয়া যাইতেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীবৃন্দ, বিশ্লেষক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, অগণিত দর্শক সাথে আপনিও। হ্যাঁ, আপনিও।

কিন্তু এই দুই দেশের যুদ্ধ দেখিতে দেখিতে, আপনাদের কি মনে প্রশ্ন আসিয়াছে, দিল্লী হইতে ১,৭০০ কিলোমিটার এবং কলকাতা হইতে ৬৫০ কিলোমিটার দূরবর্তী ইম্ফলে পৌছাইতে যে সংবাদমাধ্যমের ৭৭ দিন সময় ব্যায় হয়, তাহারাই কোন মন্ত্রবলে গুপী বাঘার জুতা পায়ে গলাইয়া ইজরায়েল পৌঁছাইয়া যায়? ভাবিয়াছেন?

রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন,
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু।”

দেশীয় নিয়ন্ত্রিত বৃহৎ সংবাদগোষ্ঠীগুলির বর্তমান অবস্থা অনেকাংশে উপরিউক্ত কবিতার অনুরূপ। তাহারা মাঝে মধ্যেই সিন্ধু পেরাইয়া ভিনদেশী হইলেও, প্রায়শই ভুলিয়া যায় দেশের নাগরিকদের কথা, তাদের সমস্যার কথা।

মনে আসে কি মণিপুরের মানুষের কথা? কুকি – মৈতেইদের কথা? কলকাতার রাজপথে প্রাপ্য অধিকার বুঝিয়া লইবার কারনে জমায়েত হওয়া কৃষক, ক্ষেতমজুরদের কথা, চাকরি না পাইয়া বছরের পর বছর রাজ্য সড়কে হত্যে দেওয়া যোগ্য চাকুরিপ্রার্থীদের কথা? সেই মেয়েগুলির কথা, যারা রাষ্ট্রের নিকট সুবিচার আশা করিয়াছিল? সেই সাংবাদিকদের কথা, যাহাদের বিদেশী সংবাদমাধ্যমের দুই লাইনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ইউএপিএ ধারায় গারদের পিছনে স্থান দেওয়া হয়? মনে পড়ে বোগটুইয়ে জীবন্ত দগ্ধ হওয়া মানুষগুলোর কথা? অথবা অতি উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়া যাওয়া যোশিমঠ বা সাম্প্রতিক বিপর্যয়ক্লিষ্ট সিকিমের চুংথাংয়ের কথা? মালদহ মুর্শিদাবাদে গঙ্গার ভয়াবহ ভাঙন, অর্ধ শতাব্দী ধরিয়া দোদুল্যমান ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান বা ভুলতে বসা সাম্প্রতিক কয়লা দুর্নীতির কথা?

আমাদের দুর্বল স্মৃতিশক্তিকে উপজীব্য করিয়াই চলিতে থাকে গনতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভের দ্বিচারিতার ব্যবসা।

তবে ভারতীয় সংবামাধ্যমের এই দ্বিচারিতা নতুন নয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সরাসরি সম্প্রচার করিতে যাহারা বিদেশ বিভূঁইয়ে গিয়াছিলেন, সেই তাহারাই মণিপুরের জাতিদাঙ্গা-গৃহযুদ্ধ পরিস্থতির খবরকে অতি সন্তর্পনে চিতায় তুলিয়া, স্বস্তির নিশ্বাস লইয়াছিলেন এবং এখনও লইতেছেন! তাই মণিপুরসহ দেশ ও রাজ্যের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে পদাঘাত করিয়া আজ দেশের সর্বাপক্ষা বৃহৎ সংবাদ ইসরায়েল প্যালেস্তাইন সংঘাত। এমতাবস্থায় সংযত কারণেই বিশ্ব সংবাদমাধ্যম স্বাধীনতার সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৬১ তে আসিয়া পৌঁছাইয়াছে।

সেই দিন দেরি নাই, যেইদিন সম্রাট আলেকজান্ডার কোনো এক টেবিলের তলা হইতে বলিবেন, “সত্যি ক্ষুদিরাম, কি বিচিত্র এই ভারতীয় মিডিয়া”।

ধন্যবাদান্তে
সুজয় ঘটক