শিক্ষা / It’s not a Business

আমরা শিক্ষা, বা আরও নির্দিষ্ট করে শিশু-শিক্ষা নিয়ে কতটা চিন্তিত বা ওয়াকিবহাল? বা আমাদের সাধারণ অভিমতটা কি?

আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের, এই ধরুন ৭-৮ বছর বয়স কিংবা ১৩-১৪ বছর বয়স কিংবা আর একটু বেশি হয়ে ১৬-১৭-ও হতে পারে, পড়াশোনার জগতে থাকা উচিৎ কিনা, আপনারা কিন্তু সকলেই সমস্বরে বলবেন হ্যাঁ উচিৎ! সুতরাং সকলেই ইতিবাচক অভিমত পোষণ করেন।

কিন্তু আপনার আমার চাওয়াটা বাস্তবায়িত হতে গেলে যে পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয় সেটা পোড়ানোর দায় কার? কার দায়িত্ব এই দেশের ছেলেমেয়েদের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব? ব্যাস! এখানেই সকল ইতিবাচক অভিমত পোষণকারীদের মধ্যে মতানৈক্য সৃষ্টি হবে। তবে এরূপ দ্বন্দ্বে যাতে আমাদের না পড়তে হয় সেজন্য সংবিধান আগে থেকেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে রেখেছে। আমাদের দেশের সংবিধান অনুযায়ী অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার প্রতি ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের অধিকার রয়েছে এবং সেই শিক্ষার প্রতি অধিকার রক্ষা করা দেশের ও রাজ্যের সরকারের কর্তব্য।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই অধিকার রক্ষার্থে কর্তব্যরতদের ভূমিকা ঠিক কী হওয়া উচিত ছিল এবং বর্তমানে তাদের ভূমিকা কী?

নতুন স্কুল তৈরি করা, প্রান্তিক শিশুদের শিক্ষানুবর্তী করে তোলার স্বার্থে নানান সহকারী প্রকল্প আনার পরিবর্তে ৮০০০ টির বেশি স্কুল বন্ধ করে দেওয়ার মুখে রাজ্য।
এই স্কুল গুলির মধ্যে ৬৭১০ হচ্ছে প্রাথমিক স্কুল, ১৪৯৬ জুনিয়র হাইস্কুল ও একটি হাইস্কুল। কারণ হিসাবে সরকার দেখাচ্ছে ছাত্রছাত্রীর অভাব। বাস্তবের দিকে যদি তাকানো যায়, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার দেশে হঠাৎ কী এমন ঘটল যাতে স্কুলগুলো ছাত্রের অভাবে ধুঁকছে? নাকি আমাদের স্কুলের প্রয়োজন নেই?

সবথেকে সহজ সমীরকণ দাঁড়ায় স্কুলগুলির ভগ্নপ্রায় পরিকাঠামো এবং শিক্ষকের অভাবে একাংশ ভরসা রাখতে পারছে না সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায়। তবে আমার থেকেও ঢের ভালো সরকার জানবে ঠিক কোন কারণে স্কুলগুলিতে ছাত্রের অভাব দেখা যাচ্ছে, সেক্ষেত্রে সেই সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজতেও কি তারা সচেষ্ট? ফলে তাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য আছে তারা বেসরকারি স্কুলে বিভিন্ন দামের প্যাকেজে ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাচ্ছেন। আর যাদের সামর্থ্য নেই বা যারা এখনও ভরসা রাখেন মাতৃভাষায় পড়াশোনার প্রতি তাদের ছেলেমেয়েরা কিন্তু এখনও সরকারি স্কুলগুলোর ভরসাতেই আছে। এই ছাত্রছাত্রীদের প্রতি কি সরকারের কোনো দায়বদ্ধতা নেই?

তবে দায়বদ্ধতার কথা যদি বলতেই হয়, সেক্ষেত্রে সরকারি স্কুল গুলোর পরিকাঠামোগত অবনমন ঠেকাতে সরকার সংবিধানের কাছে, আইনের কাছে দায়বদ্ধ।

সেই দায়বদ্ধতা পালনে সরকার কী ভূমিকা নিয়েছে? সিদ্ধান্ত নিয়েছে শিক্ষাব্যবস্থাকে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যবসায়ীর হাতে তুলে দেওয়ার। অর্থাৎ শিক্ষার বিপণন। আর পাঁচটা সামগ্রীর মত এখন লেখাপড়া বিক্রি হচ্ছে মুনাফার বদলে। শহরে তো বটেই, শহরতলীগুলোতেও মোড়ে মোড়ে গজিয়ে উঠছে এই ওয়ার্ল্ড সেই ওয়ার্ল্ড, এই গার্ডেন ওই হেভেন ইত্যাদি ইত্যাদি নামের কত স্কুল। গ্রামের পথেও এই প্রক্রিয়া বেশ ভালোভাবেই শুরু হয়েছে।

এই নাম না জানা স্কুলগুলোর চাকচিক্য রয়েছে, কিন্তু পড়াশোনার মান কি সবক্ষেত্রে খুব উন্নত? না আসলে তা নয়। কিন্তু বেসরকারি হলে পরিষেবা ভালো হবে, ইংরাজি ভাষায় পড়লে বাচ্চা অনেকটা বেশি সুশিক্ষা পাবে এই দুইয়ের এক অদ্ভুত অ্যামালগামেশন-র মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষা বিক্রির কারখানা, যেখানে হয় তুমি প্রফিট দাও, নাহলে শিক্ষালাভের দাবি করো না! এদিকে শিক্ষা যে প্রত্যেক ভারতীয়ের সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত অধিকার সে বিষয়ে সরকারি তরফে সতর্ক করার প্রচেষ্টার লেশমাত্র নেই।

থাকবেই বা কীকরে? শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিলেই তো হবে না, তাদের ব্যবসা করার খদ্দের এনে দিতে হবে তো! সেটা সম্ভব যদি সরকারি স্কুলগুলোকে বন্ধ করা যায়। হুট করে বন্ধ করবে কীভাবে? দীর্ঘদিন ধরে তাই চলে আসছে একটা প্রক্রিয়া।

বাজেট বেরোলে দেখা যায় শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বছর বছর কমে। মিড ডে মিলের জন্য বরাদ্দ কমিয়ে মাথা পিছু প্রতিদিন করা হয়েছে ৩ টাকা ৩৩ পয়সা। এই বিভাগ গুলো কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকার মিলে চালায়। তাই এখানে কারুর নেতিবাচক অংশীদারিত্বকেই ছোটো করে দেখা যায় না।

মিড ডে মিল প্রকল্পটির দ্বিমুখী উদ্দেশ্য ছিল। প্রথমত, শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহ করা; দ্বিতীয়ত প্রান্তিক শিশুদের স্কুলমুখী করে তোলা। বরাদ্দ করা মূল্যে একটা ডিমও কেনা সম্ভব নয়, একটা ডিমের দামই ৫ টাকা। সুতরাং, মিড ডে মিল প্রকল্পকে কার্যত অচল করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক নিয়োগ হয় না। যে বিপুল পরিমাণ শূন্যপদ সৃষ্টি হয়েছে তার প্রভাব নিঃসন্দেহে পড়ছে স্কুল গুলোর ওপর। খবরে নজর রাখলেই জানা যায় এমন বেশ কিছু স্কুল রয়েছে যেখানে ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক নেই, এমনও কিছু স্কুল রয়েছে যেখানে একটিও শিক্ষক নেই মাসের পর মাস তবু সেদিকে কারুর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই, সেখানে পরীক্ষাও হয় না। হয়ত সেই স্কুলগুলির বুকেও সকলের অলক্ষ্যে একদিন তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হবে।

এদিকে এত কথা পড়ে মনে হতে পারে আমি সব মনগড়া গল্প লিখেছি। আসলে না, সরকারের পক্ষ থেকেই সেই সন্দেহ নিরসনের ব্যবস্থা আছে। শিক্ষাক্ষেত্রে পিপিপি মডেলের কথা শুনেছেন কি? এই অ্যাক্রোনিমের পুরো মানেটা হল পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল। যার গোদা ভাষায় মানে দাঁড়ায় বেসরকারি বিলগ্নীকরণ। কী হবে এই লগ্নীর মাধ্যমে? বিশেষজ্ঞদের মত এই লগ্নীর ফলে স্কুলে পড়ার সামান্য যে বেতন রয়েছে তা বিপুল হারে বৃদ্ধি পাবে বেসরকারি মালিকদের লগ্নীর টাকা মুনাফা সমেত তুলে দিতে।

সুতরাং ঘুরে ফিরে সেই জায়গাতেই এসে পড়লাম। শিক্ষা আর অধিকার না থেকে, হয়ে যাবে প্রিভিলেজ। যার কাছে অর্থ আছে সে দামী দামী প্যাকেজ কিনে স্কুলে যেতে পারবে। উচ্চমানের শিক্ষা পেতে হলে রিক্সাচালককে ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিতে হবে। লোন দেওয়ার ব্যাপারে আবার ব্যাঙ্কের আলাদা ফিরিস্তি আছে, তা নিয়ে আরও বিস্তর আলোচনা করা যায় তাতে আর যাব না। আর তাতেও না হলে স্কুল ছেড়ে চায়ের দোকানে আপনার আমার খাওয়া কাপ মাজতে হবে সেই শিশুদের। সাইকেলের দোকানে তেলকালিতেই শেষ হয়ে যাবে শৈশব থেকে যৌবন।

তবে সরকার চাইলেই এমন অরাজকতা সৃষ্টি হওয়ার থেকে আটকাতে পারে। শিক্ষাখাতে ক্রমহ্রাসমান বাজেট বৃদ্ধির মাধ্যমে, নামমাত্র না দেশ গঠনের কান্ডারিদের যে পরিমাণ যত্ন প্রয়োজন সেই পরিমাণ। যেসকল গ্রামেগঞ্জে ছেলেমেয়েদের জীবন জীবিকা অর্জনের জন্য বাবা মায়ের কাঁধে কাঁধ রেখে কাজ করতে হয় তাদের ঘরের কাছে স্কুল নির্মাণের মাধ্যমে, এবং শুধুমাত্র স্কুল নির্মাণই নয় সেখানে যোগ্য শিক্ষক নিয়োগও অনিবার্য। শিশুশ্রমিক দেখলে শুধু মালিককে শাস্তি না দিয়ে ওই শ্রম দিতে বাধ্য হওয়া বাচ্চাটির পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে একাগ্র উদ্যোগ নিতে হবে সরকারের পক্ষে। শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের বিশ্বাসযোগ্যতার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে, নাহলে এমন চিন্তা মাথায় আসা অস্বাভাবিক নয় যে পড়াশোনা করেও যদি চায়ের কাপ প্লেট মাজতে হয় তাহলে পড়াশোনা করে অর্জনটা কী? এই উদ্দেশ্যে সরকারের প্রয়োজন কর্মসংস্থানমুখী বাজেট নির্মাণ। আমারা দেশের সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ, আমরা প্রত্যেকে ডিরেক্ট অথবা ইন্ডিরেক্ট ট্যাক্স দিয়ে থাকি, তাই সরকারের আয়ের উৎস কিন্তু সামান্য নয়। তাই ওপরে যা যা বললাম এগুলোর কোনোটাই সরকার চাইলে বাস্তবায়িত করা অসম্ভব কিছু না।

ইতিমধ্যে করোনা পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন স্তর থেকে স্কুলছুটের সংখ্যা বেড়েছে, তার ওপর মুনাফাভিত্তিক বেসরকারি শিক্ষাব্যবস্থার নিঃশ্বাস যেভাবে ঘাড়ে উষ্মা বৃদ্ধি করছে তাতে আরও কী কী ফলশ্রুতি দেখতে হয় তা সময়ের অপেক্ষা। যেভাবে কৃষক ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করে সেরকম ঘটনা এক্ষেত্রেও দেখতে হতে পারে প্রস্তুত হ’ন। সমাজবিরোধী, দুর্নীতিগ্রস্ত, দরীদ্র মানুষে ভর্তি কঙ্কালসার সমাজ তৈরি হবে যদি শিক্ষা সার্বিক না হয়, যদি শিক্ষা কুক্ষিগত হয়ে থেকে যায়। প্রস্তুত হ’ন এমন সমাজ তৈরির কারিগরের তকমা নিতে।

আর যদি প্রস্তুত না হতে চান, তাহলে রুখে দাঁড়ান শিক্ষার প্রতি অধিকার রক্ষা করতে। যারা মুনাফাসর্বস্ব পৃথিবী গড়তে চায় তাদের বুঝিয়ে দিন পৃথিবীতে সব কিছু সামগ্রীর মত বিক্রি হলেও শিক্ষা কোনো পণ্য হতে পারে না। প্রতিষ্ঠান তৈরির বহু আগে থেকে মানুষ সভ্যতার পথচলায় শিক্ষাকে তার হাতিয়ার করেছে। কখনও আগুন জ্বালার শিক্ষা, কখনও চাকা নির্মাণের শিক্ষা, কখনও বা পশু শিকার করে বা ফল সংগ্রহ করে খিদে মেটানোর শিক্ষা।

আপনার ইতিবাচকতাকে সম্পূর্ণ রূপ দিন ওয়াকিবহাল হয়ে। এই দেশের স্বার্থে, আপনার স্বার্থে, সকলের স্বার্থে।