‘ইনসাফ’ দিদি / Minakshi Mukherjee

ইনসাফ বা ন্যয়বিচার! কিন্তু কিসের ইনসাফ!

চাকরি না পাওয়ার। পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে পরিবার-পরিজন ফেলে পেটের দায়ে দেশ-বিদেশ পাড়ি দেওয়ার। ১০০ দিনের প্রকল্পে কাজ বা আবাস যোজনার ঘর না পাওয়ার। ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার। সারের কালোবাজারির। এসএসসি-টেট-পুরসভা সহ সমস্ত সরকারী নিয়োগ প্রক্রিয়ায় বিগত এক দশক ধরে ঘটে চলা সীমাহীন দুর্নীতির। রেশনের চাল-ডাল-আটা চুরির। গরু-কয়লা-পাথর-বালি পাচারের। রাজ্য সরকার ও ক্ষমতাসীন দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ অজস্র। কাজেই তালিকা লম্বা। অথচ বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ তদন্তকারী সংস্থা বছরের পর বছর তদন্ত করে গেলেও রাঘব-বোয়ালরা কেউই ধরা পড়ে না। জেল খাটে মূলতঃ চুনোপুঁটিরা। সঙ্গে চক্ষুলজ্জার খাতিরে দুএকটা রুই-কাতলা। ব্যস ঐ পর্যন্তই। মানে সোজাকথায় ওপরতলায় ‘টপ-টু বটম সেটিং’ করে লুঠ চলছে।

আর এসবের থেকে মুক্তি পেতে ইনসাফ চেয়ে গোটা বাংলা জুড়ে পদযাত্রা। তাই নাম ইনসাফ যাত্রা। শুরু হয়েছে গত ৩রা নভেম্বর কোচবিহার থেকে। শেষ হবে আগামী ২২ শে ডিসেম্বর কলকাতার যাদবপুরে। বাংলার প্রতিটা জেলা অতিক্রম করবে এই মিছিল। আর তারপর আগামী ৭ই জানুয়ারি কলকাতার বুকে ‘ইনসাফ’ ব্রিগেড। আর এই পুরো কর্মসূচির আয়োজক সিপিআই(এম)র ছাত্র-যুব সংগঠন। নেতৃত্বে বাম যুবনেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জ্জী। যাঁকে বাম জনতা ইদানীং “ক্যাপ্টেন” বলে ডাকা শুরু করেছে।

রাইজ অফ ভয়েসেস সাধারণতঃ কোন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচী নিয়ে প্রতিবেদন করে না। কারণ মূলস্রোতের সংবাদমাধ্যম তা ‘কভার’ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে কিছুটা ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। কোন প্রথমসারির সংবাদমাধ্যম বা খবরের চ্যানেল এই ইনসাফ যাত্রার কোন খবর করছে না বা ন্যুনতম কভারেজ/ফুটেজও সারাদিনে দেখাচ্ছে না। বামেদের এই মুহুর্তে বিধানসভা বা লোকসভাতে কোন জনপ্রতিনিধি নেই। প্রাপ্ত ভোট শতাংশও এমন কিছু আহামরি নয়। হতে পারে সেই নিরিখেই তারা হয়তো বা বামেদের ইনসাফ যাত্রাকে ব্রাত্য করে দিয়েছে। অথবা এমনটাও হতে পারে যে জেলার গ্রামাঞ্চল-জনপদে ঘটে চলা রোজকার রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল থেকে খবর তুলে আনবার মত পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে শহরকেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যমগুলোর। সেখানে ‘শূন্য’ বামেদের কর্মসূচি কভার করতে একগাদা খরচের কোন মানে হয় না। হাজারহোক জনগণকে সংবাদ বা নিউজ পৌঁছে দেওয়াটা বহুদিন হলো একটা ব্যবসা। কাজেই ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতি, ‘টিআরপি’র ওঠানামা এবং সর্বোপরি চ্যানেল অথবা কাগজের মালিকের মর্জি ও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা -এইসব দিক জেনেবুঝে খবর করাটাই এখন দস্তুর।

কিন্তু এমন ভোট ও নোট গোনা ‘না-ইনসাফি’র বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে আড়ালে চলে যাওয়া খবর বা ঘটনার প্রতিবেদন করবে বলেই রাইজ অফ ভয়েসেসের জন্ম। শুরু হয়েছিল ‘বাংলার খুঁটিনাটি’। সেও প্রায় দুবছর আগেকার কথা। আর সেইসূত্রেই রোজকার শহরকেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যমের দাপাদাপির বাইরে বেরিয়ে বাংলার জেলার জনপদগুলোতে ক্যাপ্টেন মীনাক্ষীর ইনসাফ যাত্রা কেমন সাড়া ফেললো খুঁজতে গেছিল রাইজ অফ ভয়েসেস।

প্রথম পাঁচদিনে কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি এই চার জেলা ঘুরে পদযাত্রা ঢুকেছে উত্তর দিনাজপুরে। ভিড় হচ্ছে চোখে পড়ার মত। মীনাক্ষী-ধ্রুব-কলতানদের মত তরুণ তুর্কিদের আলিমুদ্দিন সামনে এগিয়ে দেওয়ায় কম বয়সই ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাড়তি উৎসাহ-উদ্দীপনা চোখে পড়ছে। ধামসা-মাদলের তালে তালে নৃত্যে-সংগীতে-পুষ্পবৃষ্টিতে সেই বাম যুবনেতৃত্বকে জায়গায় জায়গায় মিছিল থামিয়ে বরণ করছেন বাম মনস্ক আম-জনতা। কোথাও আবার পথচলতি জনতা হঠাৎ বামেদের বিশাল মিছিল দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছে। কারণ প্রথমসারির সংবাদমাধ্যম সেভাবে কভার না করায় তাদের কাছে ইনসাফ যাত্রার কোন খবর নেই। অনেকেই চমকে উঠছেন হাতের সামনে মীনাক্ষী মুখার্জ্জীদের পেয়ে। এঁদের কেউ কেউ এগিয়ে আসছেন তাদের নিজস্ব অথবা স্থানীয় দাবি-দাওয়া, জ্বালা-যন্ত্রনার কথা শোনাতে। হচ্ছে জনসভা। দাবী উঠছে সব হাতে কাজ-সব পাতে ভাতের। সেইসঙ্গে তৃণমূল শাসনে আবাস যোজনা, ১০০ দিনের কাজ,সরকারি নিয়োগ,রেশন ব্যবস্থা সহ সর্বত্র যে চরম দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে তার প্রতিকারের জন্যও গলা ফাটাচ্ছে মীনাক্ষিদের মিছিল। জনতাকে বলছে আগামী ৭ই জানুয়ারি ব্রিগেড সমাবেশে সামিল হতে। ইনসাফের দাবিকে জোরালো ও মজবুত করতে।

মানে মানুষের সাথে পা-মিলিয়ে পথচলা, জনসংযোগ, লড়াইয়ের শপথ এবং ইনসাফ আদায়ের অঙ্গীকার – বাম ঘরানার সমস্ত রসদই মজুদ রয়েছে ইনসাফ যাত্রায়। কিন্তু তারপরেও একটা “এক্স” ফ্যাক্টর দরকার লাগে যে কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিকে গতি দিতে, মানুষের সামনে তুলে ধরতে। আর এখানে সেই “এক্স” ফ্যাক্টর হলো “ক্যাপ্টেন”! তা না হলে মীনাক্ষী আসছে শুনে তাকে সামনে থেকে দেখবে বলে রাস্তার দু ধারে ইতিউতি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতারা ভিড় জমাবে কেন! কেনই বা আসবে ‘সেলফি’র আব্দার। কোথাও মীনাক্ষীর মাথায় উঠছে আশীর্বাদের হাত আবার কোথাও মীনাক্ষীর হাতে জুটছে বয়ঃজেষ্ঠ্য মহিলা সাথী কমরেডের স্নেহের চুম্বন!

উত্তরবঙ্গের যে এলাকা এখনও পর্যন্ত প্রদক্ষিণ করেছে ইনসাফ যাত্রা তা বাজারি সংবাদমাধ্যমের ভাষায় বিজেপির গড়। যদিও সেই গড় গত পঞ্চায়েত ভোটে শাসক তৃণমূলের হাতে চলে গেছে বলে রাজনৈতিক মহলের একাংশের অভিমত। সেখানে দাঁড়িয়ে বামেদের ‘ক্যাপ্টেন’কে ঘিরে আম-জনতার এমন উন্মাদনা তৃণমূল বা বিজেপি উভয় দলকেই যে খুব একটা স্বস্তি দিচ্ছে না, তা তাদের সমর্থকদের কথাতেই স্পষ্ট। দূর থেকে দাঁড়িয়ে ইনসাফ যাত্রার ভিড়টার ওপর নজরদারি চালানোর ফাঁকে এদেরই মধ্যে বয়স্ক কেউ কেউ বলেও ফেলছেন…. মেয়েটা যেন কেমন…. একরোখা-জেদি টাইপ! অনেকদিন আগে কোথায় যেন দেখেছি দেখেছি লাগছে….

“কলকাতার বুকে কি?”

প্রশ্নটা করাতে চমকে উঠে এক ঝলক তাকিয়েই হারিয়ে যাচ্ছেন মিছিল- জনপদের ভিড়ে।

কিন্তু ক্যাপ্টেনের থামবার জো নেই। ‘ইনসাফ’ দিদি হয়ে বাংলার মানুষকে ইনসাফ দিতে পথ হাঁটছেন। উত্তর থেকে দক্ষিণ, বাংলাকে জুড়ছেন এক সুতোয়, এক মিছিলে। আর সেই মিছিল থেকে গান উঠছে:

এখনও অনেক পথ হাঁটা বাকি হয়তো
এখানেই সব শেষ নয় জেনো বন্ধু
আমাদের চোখে নতুন ভোরের স্বপ্ন
রাত্রির পথ হোক না যতই বন্ধুর।

আর সেই গান শুনে রাইজ অফ ভয়েসেসের মনে হয়েছে, ঠিক গানই গাইছে মিছিলটা, পথটা একটু বেশিই বন্ধুর, একটু বেশিই লম্বা! হয়তো ২০২৪ বা ২০২৬এও শেষ হবে না। কিন্তু লড়াইটা শুরু করবার জন্য এদের একটা অভিনন্দন প্রাপ্য। মিডিয়ায় পাত্তা না পেয়েও মাটি কামড়ে লড়াইয়ের ময়দান আঁকড়ে পড়ে থাকবার জন্যও এদেরকে একটা কুর্নিশ করাই যায়।

আর দিনের শেষে ভোটবাক্সে মানুষই তো ইতিহাস লেখে। সরকার পালটায়। পরিবর্তন চায়। কোথাও কোথাও তো পাঁচ বছর অন্তর উল্টেপাল্টে যায় সব। কাজেই মানুষের মতিগতি বোঝা মুশকিল! তাই জনগণেশ ‘ক্যাপ্টেন’কে নিয়ে ‘ইনসাফ দিদি’ নামে যে অদূর ভবিষ্যতে বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে একটা চ্যাপ্টার লিখবে না এমন কথা কেউ কি হলফ করে বলতে পারে!

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস