হিজাবের হিজিবিজি / Curious Case of Hijab
এই মুহুর্তে একটা দারুণ খেলা শুরু হয়েছে দেশজুড়ে। এটা আমরা ছোটবেলায় সব্বাই খেলেছি। খাতায় পেন পেন্সিল দিয়ে হিজিবিজি আঁকা। কে কত তাড়াতাড়ি সবার আগে সারা পাতা জুড়ে হিজিবিজি কাটতে পারে!
কিন্তু এখন যে হিজিবিজি কাটবার খেলাটা শুরু হয়েছে সেটা কোন খাতার পাতায় না, হচ্ছে আমাদের মনে। আর কোন পেন বা পেন্সিল দিয়ে নয় হিজিবিজি কাটা হচ্ছে হিজাব দিয়ে ।
হিজাব পরে স্কুল-কলেজে মেয়েরা যাবে কি যাবে না তা নিয়ে একটা অহেতুক বিতর্ক তোলা হয়েছে। ধর্মীয় সুড়সুড়ি আছে! কাজেই এটা যে লোকে ভালো খাবে সেটা জানা কথা! ফলে দেশ জুড়ে হইচই শুরু হয়েছে! আর আমাকে আপনাকে এই মাতিয়ে রাখাটাই হল এই হিজাব বিতর্কের আসল উদ্দেশ্য।
এই মুহুর্তে কেন্দ্রের শাসকদল নানাবিধ সমস্যা ও প্রশ্নের সম্মুখীন। আর সেগুলোর ওপর এখন হিজাব দিয়ে হিজিবিজি কাটা চলছে যাতে আপনি আমি সেগুলো পড়তে না পারি। জানতে না পারি। আপনার আমার বা মিডিয়ার নজর ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিজাবের দিকে।
তাই আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস ভাবলাম হিজিবিজি মুছে হিজাব সরিয়ে ছোট্ট পরিসরে গত এক সপ্তাহ দশদিনে সামনে আসা আসল ইস্যু গুলো এক এক করে আপনাদের একবার মনে করিয়ে দিই!
আর তারমধ্যে প্রথমেই যেটা আসবে সেটা হল বাজেট। বাজেট পেশ হয়েছে ফ্রেব্রুয়ারী মাসের ১ তারিখ। কেন্দ্রীয় সরকারের সেই পেশ করা বাজেটে সাধারণ চাকুরিজীবীদের ইনকাম ট্যাক্সে কোথাও ছাড় দেওয়া হয় নি! পাশাপাশি রেগার ১০০ দিনের কাজেও বাজেট বরাদ্দ ছেঁটে ফেলা হয়েছে। সার, খাদ্য অথবা পেট্রোপণ্যে ভর্তুকি সবেতেই গতবারের তুলনায় বাজেট বরাদ্দ কমানো হয়েছে! মানে আপনার আমার দিন গুজরান আরও কঠিন হতে চলেছে ।
এমনকি যে মহামারী নিয়ে এত দমবন্ধ অবস্থা সেই মহামারীর সাথে যুঝতে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ বর্তমান মুদ্রাস্ফীতির হার ধরলে বলা যায় গতবারের থেকে কমানো হয়েছে।
কৃষিক্ষেত্র, যার ওপর রুটি-রুজির প্রশ্নে এখনও দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ নির্ভরশীল, তাতেও বরাদ্দ বেড়েছে নামমাত্র যা মুদ্রাস্ফীতি ধরলে আগের বারের বরাদ্দর থেকে কম হবে।
যে সরকার একটা সময় বলেছিল বছরে নাকি ২ কোটি করে চাকরি দেবে সেই সরকার এখন বলছে ৬০ লক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হবে তাও সেটা হবে আগামী পাঁচ বছরে! মানে গাজর ঝোলানো হয়েছে পাঁচবছরের। আর বলা হচ্ছে সামাজিক/শিল্প পরিকাঠামো তৈরিতে সরকার ১১ লক্ষ কোটি টাকার ওপর খরচা করবে যা দৃষ্টিসুখ দিতেই পারে কিন্তু পাশাপাশি এও বলা হচ্ছে অমৃতকাল সবে শুরু হয়েছে, মন্থন শেষে অমৃত উঠতে ২৫ বছর লাগবে। মানে ডান্ডাটা এত লম্বা যে তার আগায় ঝোলানো গাজরটা আমি আপনি ঠিক মত দেখতেও পাচ্ছি না।
কাজেই ত্রাতা হয়ে হাজির হিজাব। মুসলিম ছাত্রীদের স্কুল কলেজে হিজাব পড়তে বাধা দিয়ে কার্যত আস্ত বাজেট বিতর্কটাকেই হিজাব পরিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা!
তবে শুধু কি বাজেট! আরও আছে। এই মুহুর্তে আপনি আমি কি আর মনে করতে পারছি “পেগসাস” ইস্যুটা! হিজাবের হট্টগোলে কি হারিয়ে গেল সেটা! নাকি সেভাবে পড়ে বুঝে ওঠবার আগেই বাজেট এসে গেল আর বাজেট মিটতে না মিটতেই হিজাব! আর তাই আপনি আমি সেভাবে গণপরিসরে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা বা চর্চা করতে পারলাম না। তাহলে আসুন একটু চর্চা করে নি। ঝালিয়ে নিই।
গত বছরের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল যে ভারত সরকার পেগসাস স্পাইওয়ার সফটওয়্যার ব্যবহার করে বিভিন্ন বিরোধী রাজনৈতিক দলের একগুচ্ছ নেতা, প্রথমসারির কিছু প্রোথিতযশা সাংবাদিক এবং সমাজকর্মীদের মোবাইল ফোনে নজরদারি চালাচ্ছে। মানে সরাসরি ব্যক্তিস্বাধীনতায় ও গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ যা সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে। সেসময় এই ইস্যুতে দেশজুড়ে প্রবল হইচই হয়। সুপ্রিমকোর্টে মামলা পর্যন্ত হয়। সে সময় সরকার সংসদ কক্ষের মধ্যে যে বিবৃতি দিয়েছিল অথবা শীর্ষ আদালতে হলফনামায় যা বলেছিল তাতে এই অভিযোগ স্বীকার বা অস্বীকার কোনটাই করে নি। কার্যত ভাষার মারপ্যাঁচে আর জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিল। এমনকি সরকার পেগসাস স্পাইওয়ার সফটওয়্যার আদৌ কিনেছে কি না সেটাও স্পষ্টভাবে জানাতে অস্বীকার করে। ফলে সেসময় শীর্ষ আদালতে কেন্দ্রীয় সরকার তোপের মুখেও পড়েছিল। শেষমেশ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি আর ভি রবীন্দ্রনের নেতৃত্বে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে শীর্ষ আদালতের নজরদারিতে তদন্ত কমিশন গঠিত হয় যারা এখন এই অভিযোগের তদন্তে ব্যস্ত। প্রসঙ্গত বলে রাখা জরুরি যে এই সফটওয়্যারটি তৈরি ও বিক্রি করে ইজরায়েলের সরকারী সংস্থা এনএসও এবং কোন দেশের সরকার ছাড়া এই সফটওয়্যারটি আর কাউকে বিক্রি করা হয় না। কাজেই দেশে বসবাসকারী কোন ভারতীয়র মোবাইলে যদি এই পেগসাস সফটওয়্যারের ফুটপ্রিন্ট পাওয়া যায় তাহলে ভারত সরকারের কোন অধীনস্থ দপ্তর বা সংস্থা এর সাথে জড়িত নিশ্চিতভাবে বলা যায়। আর তারই তদন্ত চলছে এই মুহুর্তে।
আর এই তদন্তের মধ্যেই গত ২৯ শে জানুয়ারী মানে কেন্দ্রীয় বাজেটের দুতিনদিন আগে আমেরিকার প্রথমসারির সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস জানালো ২০১৭ সালের জুলাই মাসে কেন্দ্রের মোদী সরকার ইজরায়েলের সরকারি সংস্থা এনএসও র থেকে এই পেগসাস সফটওয়্যার কিনেছিল। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ইজরায়েল সফরকালে এই চুক্তিপত্র সাক্ষর হয়। তার আগে পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারত ইজরায়েলের বিরোধীপক্ষ প্যালেস্টাইনকেই সাপোর্ট করে এসেছে। কিন্তু এই প্রথম এই চুক্তির পর ২০১৯ সালে জুন মাসে রাষ্ট্রসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে প্যালেস্টাইনের পর্যবেক্ষক হওয়া আটকাতে ভারত ইজরায়েলের পক্ষে ভোট দেয়। কাজেই দেওয়া -নেওয়া বা “Quid pro quo” স্পষ্ট ! স্পষ্ট ভারত সরকার আমার আপনার ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও গোপনীয়তার মত মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে উদ্যোগী। অথচ আমি আপনি জানতে পারছি না। আমাদের মন পড়ে আছে হিজাবে!
এবার আসুন আরেকটা খবরের কথা বলি। গত ৮ই ফ্রেব্রুয়ারী মানে পরশু পিএম কেয়ার্স ফান্ডের থলে থেকে কালো বেড়ালটা বেরিয়ে কালো হিজাবের তলায় লুকিয়ে পড়েছে। তাই আমাদের কারোরই আর নজরে আসে নি। সর্বভারতীয় চ্যানেল এনডিটিভি জানিয়েছে ২০২০ সালের মার্চ মাসে পিএম কেয়ার্স ফান্ড তৈরি হওয়া থেকে ৩১ শে মার্চ ২০২১ পর্যন্ত এই ফান্ডে ১০, ৯৯০ কোটি টাকা জমা পড়লেও খরচ হয়েছে মাত্র ৩৯৭৬ কোটি টাকা। মানে মহামারীর মধ্যে দেশবাসীর চরম দারিদ্র -দুর্দশার মধ্যেও দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সামনে রেখে তৈরি হওয়া ফান্ড তার পুরো টাকা কোন ছার সংগৃহীত অর্থের অর্ধেকও খরচ করতে পারে নি ! এদিকে ব্যাপারটা এমনও নয় যে সরকার এই ফান্ডের টাকা খরচের ব্যাপারে যথেষ্ট সতর্ক ছিল। কারণ এই ফান্ডের টাকায় কেনা বহু ভেন্টিলেটার ত্রুটিপুর্ণ এমন অভিযোগ এসেছে। এমনকি জম্মু-কাশ্মীর, ছত্রিশগড় অথবা মধ্যপ্রদেশের মত রাজ্যে ত্রুটির কারণে অথবা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী না থাকায় পিএম কেয়ার্স ফান্ডের টাকায় কেনা শয়ে শয়ে ভেন্টিলেটার ব্যবহার করা যায় নি বলে অভিযোগও সামনে এসেছে।
এই ফান্ডের অব্যবহৃত বিপুল অর্থ লকডাউনে আটকে পড়া লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাবার কাজে উপযুক্ত গণপরিবহণের ব্যবস্থাপনায় কাজে লাগানোই যেত। কিন্তু করা হয় নি। আর আজ সেই প্রধানমন্ত্রী সংসদে দাঁড়িয়ে মহামারী ছড়িয়ে পড়বার জন্য পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরা কে কাঠগড়ায় তুলছেন ভাবতে অবাক লাগে!
আমরা চাই হিজাবের হিজিবিজি থেকে বেরিয়ে আপনারাও ভাবুন আসল ইস্যু গুলো নিয়ে! তাতেই আমাদের স্বার্থকতা!
আর আমাদের প্রতিবেদন গুলি পড়তে এবং নোটিফিকেশন পেতে অবশ্যই ফলো করুন ফেসবুকের “রাইজ অফ ভয়েসেস” পাতাটি। আমাদের পাতায় কোন হিজিবিজি নেই। আপনাদের কন্ঠই আমাদের কলম।
ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস
তথ্যসূত্র
a) https://epaper.anandabazar.com/imageview_61191_35533251_4_71_30-01-2022_0_i_1_sf.html
b) https://epaper.anandabazar.com/imageview_61263_43118925_4_71_02-02-2022_0_i_1_sf.html
c) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-30/202201292342171.jpg&category=0&date=2022-01-30&button=
d) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-01-30/202201292346097.jpg&category=0&date=2022-01-30&button=
e) https://www.ndtv.com/india-news/pm-cares-fund-pm-cares-collected-rs-10-990-crore-till-march-2021-spent-rs-3-976-crore-2754454
f) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-02-08/202202072358205.jpg&category=0&date=2022-02-08&button=
g) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-02-09/202202082342123.jpg&category=0&date=2022-02-09&button=
Comments are closed.