দুটো চাষী মরে গেল! / Farmers Suicide

দুটো চাষী মরে গেল! হ্যাঁ ঠিকই শুনছেন!

কলকাতা পুরসভার ভোট বলে কথা ! গত এক সপ্তাহ ধরে আমরা তাই খোলা নর্দমাপুকুর বুজিয়ে প্রমোটারিদুয়ারে জলপরিবেশ দূষণবস্তি উন্নয়নকোটিপতি প্রার্থী প্রভৃতি গূঢ় বিষয় নিয়ে যখন “এট্টু চচ্চা” করছিলাম, ঠিক সেই সময় আমাদের নজর এড়িয়ে কলকাতা শহর থেকে বহুদুরে বর্ধমান জেলার গাঁ-গঞ্জে দুটো চাষী গলায় দড়ি দিল। আমাদের নজরে এলেও, তখন শহরের পুরপরিষেবার চুলচেড়া বিশ্লেষণে এতটাই মত্ত ছিলাম যে জাস্ট “নজর-আন্দাজ” করে দিলাম। কারণ কারা যেন আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছে শহরের ভোট মানে শুধুই শহুরে সমস্যা সংক্রান্ত দাবি দাওয়া আদায়ের হিসেব নিকেশ। গাঁয়ের চাষাভুষোরা বাদ! অথচ এদের ফলানো ধান থেকেই আমাদের শহরের রান্নাঘরে ভাত ফোটে! ওদের ক্ষেতের শাক-সব্জি, আলু-পেঁয়াজ খেয়েই আমাদের এত্ত পেঁয়াজি! দিন দশ-বারো আগেও অন্নদাতাদের সমর্থনে ফেসবুক পোস্ট আর ট্যুইট করে সোশ্যাল মিডিয়া কাঁপিয়েছি আমরা! অথচ শাসক যখন শহরের পাড়ায় পাড়ায় দুয়ারে দুয়ারে ভোট চাইতে এল তখন সেই সমস্ত নেতাদা’দের কিম্বা নেতাদি’দের আমরা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম, বাংলার গাঁয়ের চাষীরা শুনছি সাইক্লোন ঝড়বৃষ্টিতে বড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে! ওদের পাশে কি সরকার দাঁড়িয়েছে! বলতে পারলাম কই, দুর্গা পুজো আমরা পাড়ায় চাঁদা তুলে করে নেব! ক্লাবের ব্যাট-বল, ক্যারাম বোর্ড কিম্বা ব্যাডমিন্টনের নেট শার্টল কক আমরা নিজেরা পয়সা তুলে কিনে নেব! আপনারা গাঁ-গঞ্জের গরীব-গুরবো চাষী-ক্ষেতমজুরদের একটু দেখুন! একদিকে সারের কালোবাজারি চলছে! অন্যদিকে ফসলের ন্যায্য দাম পাচ্ছে না! তার ওপর রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মার। ফলে মহাজনী ঋণেরজালে জড়িয়ে নিজের জমি থেকে এক প্রকার উচ্ছেদ হয়ে এদের অনেকে আজ পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ভিনরাজ্যে পাড়ি দিচ্ছে। অথবা বেছে নিচ্ছে চরম পথ। সরকার এসব শহুরে দান খয়রাতি ফেলে বরং এদের একটু দেখুক।

না! এমন সব বেয়াক্কেলে আব্দার আমরা কেউ জানাই নি! আমরা আসলে দরদাম করে চাল-ডাল/ আলু-পটল ইত্যাদি কিনেই কলার তুলে দি! রংবাজির এর ভাষায় “পয়সা ফেলি, মাল নি” টাইপ। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না সেই মাল আমাদের মালখানা পর্যন্ত পৌছে দিতে একজন চাষীকে এরকম কত রোদ-ঝড়-জল অতিক্রম করতে হয়। আর যারা পারে না তাদের জন্য গলার দড়ি অথবা কীটনাশকের বোতল মজুত থাকে।

আজ তাই ভোটের নামে ছাপ্পাভোটের ধাপ্পাবাজিতে ঠকে নিজেদের গালে ঠাটিয়ে চড় কষিয়ে রাইস অফ ভয়েসেস এর তরফে এমনই এক বেমক্কা খবরের অবতাড়না।

প্রথম জন কালনার মানিক শেখ! ভরসা করেছিলেন বর্ষার আমন ধানের সাথে চলতি মরশুমের আলুচাষে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের নিম্নচাপের বৃষ্টিতে (সাইক্লোন “জাওয়াদ”) মাঠের ধান তুলতে পারেন নি। আর আলুর জমি চলে যায় জলের তলায়। সামলাতে পারেন নি। বাজারে মহাজনী ঋণ প্রায় ৫ লাখ টাকার মত। বন্ধক রয়েছে মেয়ে-বউদের সোনাও। কাজেই চরম পথ বেছে নিলেন। দ্বিতীয়জন রায়নার গনেশ ঘোষ! ইনিও ধান এবং আলু চাষী। এক্ষেত্রেও ভিলেন সেই “জাওয়াদ” । আর সেই এক মহাজনী ঋণের গপ্পো এবং আত্মহত্যা।

অভিযোগ মানিক শেখ , গনেশ ঘোষের মত অসংখ্য চাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন জাওয়াদে। তবুও সরকারের তরফ থেকে তেমন কোন হেলদোল নেই। এমনিতেই সমবায় ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ায় শাসক মদতপুষ্ট মহাজনেদের কারবার চলছে গ্রাম বাংলা জুড়ে। তারওপর সারের কালো বাজারি। সেই সঙ্গে ন্যয্যমূল্যে আলু ও ধান বিক্রিতে কুপন বিলি নিয়ে বছর বছর চলছে সীমাহীন দুর্নীতি। ফলে কৃষকমাত্রই আজ ঋণের জালে।

এদিকে কৃষকবন্ধু প্রকল্পের নামে রাজ্য সরকার যে স্কিম চালাচ্ছে তাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষতিপূরণ মেলে না বলে অভিযোগ। নিয়মের বেড়াজালে সময় মত আর্থিক সাহায্য কিম্বা ঋণ কোনটাই পাওয়া যায় না। এদিকে চাষ-আবাদ মরশুম নির্ভর। তাই কৃষক বাধ্য হয় মাইক্রোফিন্যান্স বা মহাজনদের থেকে চড়া সুদে ধার করতে। আর তারপর জাওয়াদের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে পড়ে যায় ঋণের ফাঁদে। আরও অভিযোগ, জাওয়াদে একর প্রতি আলুচাষে যেখানে ক্ষতি ৬০,০০০ টাকা, কৃষকবন্ধু স্কিমে সরকারী সাহায্য মিলছে মাত্র ৫০০০ টাকা। “সব কিছু কি একদিনে হয়! আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে” এমনটাই জানালেন শাসকদলের এক নেতা। আর কৃষক আত্মহত্যার দায় এড়াতে শাসকদলের কৃষক নেতাদের বক্তব্য আরও মারাত্মক। তাঁরা বলছেন “চাষ-আবাদে ক্ষতির কারণেই আত্মহত্যা, নাকি অন্যকোন পারিবারিক কারণ রয়েছে তা ক্ষতিয়ে দেখতে হবে।”

এদিকে যেহেতু ভোট নেই তাই রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল, মানে বিজেপির কোন নেতার দেখা নেই! ক্যামেরা আর বুম নিয়ে “এক মুঠো চাল”, “সহভোজ” ইত্যাদির ফুটেজ দরকার নেই যে আর!

কিন্তু আমরা কি এবার আমাদের “আমি” কেন্দ্রিক শহুরে বোলচাল ছেড়ে, দলাদলি ফেলে একটু বাকি বাংলাটার দিকে তাকাবো!

তথ্যসূত্র
a) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-18/202112172328022.jpg&category=0&date=2021-12-18&button=
b) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-18/202112172334564.png&category=0&date=2021-12-18&button=
c) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-19/202112182336441.jpg&category=0&date=2021-12-19&button=
d) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-19/202112182350414.jpg&category=0&date=2021-12-19&button=
e) https://epaper.anandabazar.com/imageview_60353_4291761_4_71_19-12-2021_5_i_1_sf.html
f) https://epaper.anandabazar.com/imageview_60391_43941768_4_71_20-12-2021_3_i_1_sf.html
g) https://epaper.anandabazar.com/imageview_60334_33038114_4_71_18-12-2021_6_i_1_sf.html