গরুটাকে গাছ থেকে নামানো হোক! / Media Propaganda

২১ শে ডিসেম্বর, ২০২১। সারাদিন ধরে কলকাতা শহরের বুকে কয়েক হাজার সরকারী কর্মচারী এবং বিভিন্ন স্বীকৃত রাজনৈতিক দলের কর্মীরা একসাথে “ছাপ্পা” গুনলেন। আপাতত সে গল্প তোলা থাক আগামী কিস্তির জন্য।

দূর্গাপুজোকে ইউনেস্কোর দেওয়া স্বীকৃতি উপলক্ষে প্রথম পাতা জুড়ে “মা দূর্গা ও মাননীয়া”র বিজ্ঞাপনী ছবি ছাপানো খবরের কাগজগুলোর “ছাপ্পা” ভোট নিয়ে বিশ্লেষণের দৌড় দেখি একটু! ঠিক যেমনটা হত বাম আমলে! ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় না পেয়ে প্রতিটি বুথ ধরে ধরে পাতার পর পাতা ক্যাঙ্গারু কোর্টের কায়দায় আদেশ নামা জারি হত সেরকম কিছু বেরোয় কি না দেখে নিই আগে!

তাই, আমরা রাইস অফ ভয়েসেস শুরুটা করব একটু পিছন থেকে। এটা হল একটা অঙ্কের গপ্পো। ঘটনাচক্রে পুরো অঙ্কটা ভুল কষবার পরেও এর উত্তরটা কিছুটা হলেও মিলে গেছে। তাই অঙ্ক কষা কতৃপক্ষ কলার তুলবেন, না কি মাথা হেঁট করবেন ঠিক করতে পারছেন না। আর যারা এখনও বুঝতে পারছেন না তাদের জন্য জানাই আমরা প্রাকনির্বাচনী এবং নির্বাচনোত্তর সমীক্ষকদের কথা বলছি!

ওনারা আসলে প্রথম থেকেই জানতেন গরুর রচনা লিখতে হবে। তবে এ গরু যে সে গরু নয়। এ হল নীল সাদা গরু। গায়ে কোথাও ইতিউতি গেরুয়া ছোপ। আর লেজ নেড়ে মাছি তাড়াবার মত লাল মাছিকে বিদায় করতেই হবে। পারলে হাতকে একটু বড় করে কাস্তে হাতুড়ির ওপরে তুলে দাও। কিন্তু কিছুতেই বামেরা যেন না বাড়ে! এই ছিল উদ্দেশ্য।

সেইমত প্রথমে পুরসভা নির্বাচনের আগে নান্দীমুখ লেখা হল। প্রাক নির্বাচনী জনমত সমীক্ষায় জানালো হল কলকাতা কর্পোরেশনের ১৪৪ টা ওয়ার্ডের মধ্যে শাসক তৃণমূল একাই পেতে চলেছে ১৩০ টা সিট। সঙ্গে শতকরা ৫২ শতাংশ ভোট ঢুকছে শাসকের পকেটে। বিজেপি পেতে চলেছে ১৩ টা ওয়ার্ড এবং শতকরা ২৪% ভোট, অর্থ্যাৎ রানার্স -আপ বিজেপি যদিও বহু ব্যবধানে। আর বামেরা পাবে ১ টি ওয়ার্ড এবং সাকুল্যে শতকরা ৯% ভোট। কংগ্রেস বা অন্যান্যদের ভাঁড়ার শূন্য-ই থাকবে যদিও অন্যান্যরা নাকি ১২% ভোট পেতে চলেছে যা কিনা বামেদের প্রাপ্ত ৯% অপেক্ষা বেশি। মানে ঘুরিয়ে যেটা বলবার চেষ্টা করা হল, সেটা হল বামেদের ভোট দিয়ে ভোট নষ্ট করবেন না প্লিজ!

এরপর এল ভোটের দিন। কি ঘটেছে কি বৃত্তান্ত সে গপ্পো আমরা সবাই কমবেশি জানি! নিজের চোখে দেখেছি! রাইস অফ ভয়েসেস এর তরফে তা নিয়ে লেখাও হয়েছে “ভাগাড়ে জনমত”! সারাদিন ধরে শাসক মদতপুষ্ট দুষ্কৃতী বাহিনীর তাণ্ডব নৃত্য শেষে সমীক্ষক কতৃপক্ষকে বোধহয় ফিডব্যাক দেওয়া হল, যেভাবে ছাপ্পা দেওয়া হয়েছে, বিশেষতঃ যে অঞ্চলগুলিতে বামেরা শক্তিশালী সেইসব এলাকার ওয়ার্ডের বুথে বুথে, তাতে বামেরা আরও ধসবে। বাড়বে শাসক।

কাজেই নতুন উদ্দ্যমে নির্বাচনোত্তর সমীক্ষা করতে হল। সেখানে শাসক তৃণমূলকে দেওয়া হল ১৩১ টি আসন এবং শতকরা ৫৮% ভোট! বলাই বাহুল্য অতিরিক্ত সিটটা এল বামেদের ঝুলি থেকে। তাদের বানানো হল শূন্য। শুধু তাই নয় শতকরা ভোটপ্রাপ্তিতে তাদেরকে নামিয়ে আনা হল মাত্র ৫% এ। আর বিজেপিকে সেই আগের মত বাকি ১৩ টা সিট দেওয়া হলেও ভোট শতাংশ বাড়িয়ে ২৪% থেকে করে দেওয়া হল ২৮%। আর কংগ্রেস এবং অন্যান্যর প্রাপ্ত আসন সংখ্যা শূন্য হলেও এবার কংগ্রেসকে দেওয়া হল ৭% ভোট আর অন্যান্যদের খাতায় গেল বাকি ২%। মানে সোজা কথায় তৃণমূল বিজেপি তো কোন ছাড় কংগ্রেসের থেকেও বামেরা দুর্বল হতে চলেছে এবারের পুরসভা ভোটে। মানে কোলকাতার সমস্ত দক্ষিণপন্থী দলগুলি বামেদেরকে মাত দিতে চলেছে! আলিমুদ্দিন স্ট্রীটে তালা ঝুললো বলে! অর্থ্যাৎ ভোট গণনার আগে বাম কর্মী সমর্থকদের মনোবল ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সব রকম চেষ্টা করা হল।

কিন্তু ফলাফল সামনে আসতেই যাকে বলে চক্ষু চড়কগাছ! এমন দেদার ছাপ্পার বাজারে শাসক প্রাপ্ত ওয়ার্ডের সংখ্যা হল ১৩৪ যা মোটামুটি ভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা ১৩১ আসনের কাছাকাছি। এতে ক্রেডিটের তেমন কিছু নেই কারণ যে হারে ছাপ্পা পড়েছে তাতে ১৪৪ টা ওয়ার্ডই তৃণমূল জিততে পারত। কিন্তু ভবিষ্যদ্বাণী করা, এছাড়া আর কিছুই মিলল না।

সব থেকে বড় বিচ্যুতি বিজেপির। ১৩ র জায়গায় প্রাপ্ত আসন সংখ্যা মাত্র ৩। আর ভোট শতাংশের নিরিখে পেল মাত্র ৯.২% ভোট, যেখানে বলা হয়েছিল তারা নাকি ২৮% ভোট পেতে চলেছে! আর দুরছাই করা বামেরা সেখানে শুধু ২ টি আসন পেল তাই নয়, সেইসঙ্গে প্রায় ১২% ভোট গেল তাদের ঝুলিতে।

কিন্তু এমন ফলাফল সামনে আসতেই সমীক্ষা নিয়ে উঠে গেল অনেক গুলো প্রশ্ন যা বাজারি সংবাদ মাধ্যমগুলি বেমালুম চেপে গেল।

বিজেপিকে টপকে উঠে এল দ্বিতীয় স্থানে। কংগ্রেসও পেল ২ টি আসন এবং ৪% ভোট। বাকি ৩টি আসন গেল নির্দলদের দখলে। এটাও জানা গেল।

এক, শাসক ভোট পেল ৭২% যেখানে নির্বাচনোত্তর জনমত সমীক্ষা দেখিয়েছে অনেক কম মাত্র ৫৮%! তারমানে এই অতিরিক্ত ১৪% (মানে শাসকের প্রাপ্ত ভোটের পাঁচ ভাগের এক ভাগ বা ২০% এর থেকেও বেশি) ভোট কি তবে ছাপ্পা ভোট! শাসকের ছাপ্পা ভোটের কারনামা কি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই নির্বাচনোত্তর সমীক্ষা!

দুই, ছাপ্পা ভোটের দৌলতে শাসক না হয় ৫৮% থেকে ৭২% এ গেল, কিন্তু বিজেপির ভোট নির্বাচনোত্তর সমীক্ষায় বা এক্সিট পোলে ২৮% দেখানো হলেও বাস্তবে তা ৯% এ নেমে এল কি করে! মানে মার্জিন অফ এরর বা বিচ্যুতি প্রায় ৬৭%! আদৌ গ্রহণযোগ্য!

তিন, বামেদের ভোট এক্সিট পোলে মাত্র ৫% দেখানো হলেও ফলাফল ঘোষণা হতে তা গিয়ে দাঁড়ালো ১২%-এ। এক্ষেত্রে মার্জিন অফ এরর ১০০% এর বেশি! আদৌ বিশ্বাসযোগ্য!

শাসকের ছাপ্পা ভোটের কারণেই যদি বিজেপির প্রাপ্ত ভোটের হার কমে তবে সেক্ষেত্রে বামেদের ভোটও সেই হারে কমা উচিৎ! কিন্তু তেমনটা হল না তো! উলটে বেড়ে গেল!

তাহলে যে নমুনা বা স্যাম্পল নেওয়া হয়েছিল তা কি কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই পক্ষপাতদুষ্ট ছিল! আদৌ কোন সমীক্ষা হয়েছিল কি! অঙ্কের উত্তর খানিকটা মিলে গেলেও গোঁজামিল গুলো বড্ড বেশি চোখে পড়ছে যে!

তাই আমরা রাইস অফ ভয়েসেস-এর পক্ষ থেকে আবেদন করছি প্রতিবার নির্বাচনের আগে-পরে জনমত সমীক্ষার নামে শাসকের ভাড়াটে সংবাদ মাধ্যম দিয়ে জনমত তৈরির এই ঘৃণ্য অপচেষ্টা বা খেলা এবার বন্ধ হোক! গল্পের গরুটাকে গাছ থেকে এবার নামানো হোক!

তথ্যসূত্র
a) https://bengali.abplive.com/elections/kmc-election-2021-c-voter-opinion-poll-what-will-be-the-result-for-kolkata-municipal-election-853125
b) https://bengali.abplive.com/district/c-voter-exit-poll-kmc-election-2021-result-may-remain-same-like-2021-assembly-election-ward-wise-result-854022