“সন্মান মিলিল কি”-এর জবাবী খোলা চিঠি / Reply to ABP

মাননীয় সম্পাদক সমীপেষু,
আনন্দবাজার পত্রিকা

গত ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২১ এ প্রকাশিত “সম্মান মিলিল কি” কলামটি আমাদিগের ন্যয় কিয়দ সংখ্যক পাঠকের শুধু আঁখি উন্মোচিত করে নাই, শাসককে সুপরামর্শ দিয়া জনগণেশের দুয়ারে যে আনন্দবার্তা বহন করিয়া আনিয়াছে, তাহা পাঠ করিয়া আমাদিগের মনে হইয়াছে যে আপনাদের ন্যয় প্রথমশ্রেণীর সর্বাধিক বিক্রিত ও প্রচারিত সংবাদ মাধ্যম গুলি শাসকের সম্মান অপেক্ষা নিজ নিজ সম্মান পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হইলে আপামর বাঙালী জাতি আপনাদের পাঠ করিয়া আরও কিছুটা পথ অগ্রসর হইতে পারিত। এইরুপে শাসকের শুভাকাঙ্খী হইয়া পড়িলে রাজ্য তথা দেশের হিতাহিত বিবেচনার হেতু পঞ্চম স্তম্ভের খোঁজ পড়িবে।

শাসক অথবা বিরোধী কোন পক্ষকে পরামর্শ দিবার নিমিত্ত চাতুর্যপূর্ণ শব্দচয়নের মাধ্যমে যখন পক্ষপাতের মার্জারটি থলি হইতে মুখ বাহির করে তখন উক্ত থলিটি নামিয়ে রাখাই শ্রেয়। ভুলিলে চলিবে না গণতন্ত্রে নির্বাচন একটি নিরপেক্ষ ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। কাজেই আটমাস পূর্বের বিধানসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে নির্বাচনের পূর্বেই শাসককে বিজয়ী ঘোষণা করিবার এমন দুর্দম প্রয়াস হইতে অথবা “বাহাত্তর শতাংশ জনাদেশ না মিলিলেও শাসকের বিজয় অবসম্ভাবী ছিল” এমন একটি ধারণার দ্বারা জনমানসকে জারিত করিবার মধ্যে সংবাদ মাধ্যমের নিরপেক্ষতা আদৌ রক্ষিত হইল কি না ভাবিয়া দেখিতে অনুরোধ রহিল। আর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সম্প্রচারিত এবং বহুল প্রচারিত জনমত সমীক্ষা যখন মূষিক প্রসব করিল এবং সমীক্ষাকে ভ্রান্ত প্রমাণ করিয়া পাঁচ শতাংশের “শূন্য” বামশক্তি কমবেশি বারো শতাংশ জনাদেশ লইয়া বিজেপিকে পিছনে ফেলিয়া দ্বিতীয় স্থানে উঠিয়া আসিল তখন বামশক্তির তাৎক্ষনিক উৎফুল্লতার প্রতি করুণা বর্ষন না করিয়া নিজ সমীক্ষক দলের আত্মবিশ্লেষণই উচিৎ হইত বলিয়া মনে হইতেছে।

যদিও বলিতে বাধা নাই ভোট লুন্ঠনের অভিযোগ বাংলার মাটিতে নতুন নহে। সত্তরের দশকে কংগ্রেস আমলে অথবা তিন দশকের বাম আমলে এমন অভিযোগ উঠিত এবং তাহার যথেষ্ঠ সারবত্তাও রহিয়াছে। তথাপি উক্ত সময়কালে সত্তর শতাংশ, আশি শতাংশ অথবা নব্বই শতাংশের অধিক জনাদেশ লইয়া বিজয়ী জনপ্রতিনিধির খোঁজ পাওয়া বিরলতম দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিগণিত হইত ! এ প্রসঙ্গে আপনাদের ন্যয় প্রথম সারির অগ্রজ সংবাদমাধ্যম গুলি বাম আমলের দুইটি উদাহরণ ( অনিল বসু ও নন্দরানী ডল) লইয়া ক্যানেস্তারা বাজাইতেন এবং আমরা পাঠকগণ তাহাতেই তাল মিলাইতাম। হয়ত এর বাইরেও আরও কিছু উদাহরণ থাকিতে পারে যাহা আমাদিগের আগোচরে রহিয়া গিয়াছে।

কিন্তু বিগত এক দশকে বর্তমান শাসকের রাজত্বে এইরূপ “ছাপ্পা” জনাদেশ মুড়ি -মুড়কির ন্যয় বাস্তবে পরিণত হইয়াছে। খবরের প্রকাশ কলিকাতা পৌরনির্বাচনে শাসকদলের এমন ৭৭ জন বিজয়ী প্রার্থীর হদিশ রহিয়াছে যাহারা প্রদত্ত ভোটের সত্তর শতাংশ অথবা তাহার অধিক জনাদেশ পাইয়াছেন। ইহাদের মধ্যে নব্বই শতাংশের বেশি জনাদেশ পাইয়াছেন ৭ জন। শুধু সদ্য অনুষ্ঠিত কলিকাতা পৌরনির্বাচন নহে, সাম্প্রতিক অতীতে অনুষ্ঠিত বিধানসভা উপনির্বাচনেও চারটির মধ্যে দুইটি (দিনহাটা এবং গোসাবা) তে এমন নজির বিদ্যমান, যাহারা প্রায় নব্বই শতাংশের কাছাকাছি জনাদেশ লইয়া নির্বাচিত হইয়াছেন।

ইহার পূর্বে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটেও অনুরূপ আধিপত্যবাদের সাক্ষী রহিয়াছি, যখন শতকরা ৩৪% আসনে শাসকদল বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় বিজয়ী হইয়াছিলেন। কারণ সসস্ত্র অবস্থায় শাসকদলের কর্মীবৃন্দ খোদ জেলা শাসকের দপ্তর ঘেরাও করিয়া রাখিতেন, যাহাতে বিরোধীদলের প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা করিতে না পারেন। জনৈকা মহিলা “বাম” প্রার্থী মনোনয়ন দাখিলের দুঃসাহস দেখাইয়া অগ্রসর হওয়ায় পথিমধ্যে জনসমক্ষে উহাকে শাসকদলের সমর্থকদ্বারা “বিবস্ত্র” হইতে হয় যাহা বাংলার রাজনৈতিক ইতিহাসে খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর! অতএব দূর্গাপূজাকে ইউনেস্কো কতৃক প্রদত্ত স্বীকৃতি উপলক্ষে “মা-দূর্গা ও মাননীয়া”র প্রথম পাতা জোড়া সরকারী বিজ্ঞাপনের বাস্তবতা স্বীকার করিলেও বর্তমান শাসকের অপকর্মকে লঘু করিয়া অতীতের বাম আমলের সাথে গুলিয়া খাওয়াইয়া দেওয়ার প্রচেষ্টার মধ্যে যে কোন “সুশান্ত” পবিত্রতা নাই তাহা উত্তম-মধ্যম-অধম সকলেই বুঝিতে পারে। কাজেই বাম আমলের চতুর্ত্রিংশ বৎসরের ভোটদানের অনিয়ন-বেনিয়মের বিস্তর অভিযোগ সত্য হইলেও বর্তমান শাসকের রাজত্বে সমগ্র রাজ্যব্যাপী গণতন্ত্রের গণলুন্ঠনের সহিত তাহা যে কিছুতেই তুলনীয় নয় স্বীকার করিলে সম্মান বাড়িবে বৈ কমিবে না।

পরিশেষে সমগ্র পাঠক সমাজের তরফে আপনাদিগের ন্যয় প্রথমশ্রেণীর সংবাদ মাধ্যম গুলির চরণকমলে আর্জি এই যে শাসকদলের বিজয়ের অনিবার্যতার ধ্বজা না উড়াইয়া, উহাদের বাহাত্তর শতাংশ প্রাপ্ত ভোটের কতখানি খাঁটি এবং কতখানি জল তাহার বুথওয়ারী বিশ্লেষণের (ঠিক যেমনটা বাম আমলে করিতেন) মধ্যেই আপনাদের হৃত সম্মান পুনরুদ্ধারের বীজ সুপ্ত রহিয়াছে। আর ইহার ন্যয় শুভকর্মের নান্দীমুখ হিসাবে ২৩ শে ডিসেম্বর তারিখে সিপিআই(এম) এর মুখপত্র “গণশক্তি”তে সাংবাদিক সুদীপ্ত বসুর তথ্যসমৃদ্ধ লেখা “দুর্বৃত্তের অবাধ দাপটই মমতার উৎসব” কলামটি পড়িয়া দেখিবার অনুরোধ রইল। শাসকের মুখপত্র “জাগো বাংলা” হইতে অনিলকন্যা অজন্তা বিশ্বাস অথবা জয় গোস্বামীর লেখা লইয়া সংবাদ পরিবেশন করিতে পারিলে “গণশক্তি” পঠনে আশাকরি কোন মহাভারত অশুদ্ধ হইবে না । তাই আপনাদের সুবিধার্থে নিম্নে লিঙ্ক দেওয়া হইল।

http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-23/202112222335373.jpg&category=0&date=2021-12-23&button=

শাসক যখন সরকারী মদতে ভোটলুন্ঠনের ‘উৎসব’কে “মডেল” করিয়া গণতন্ত্রকে পাপসে মুছিয়া ফেলিয়া, দুয়ারে আসিয়া করাঘাত করে চতুর্থস্তম্ভকে, তখন আরও নিরপেক্ষ এবং সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হইতে হয়। ইহা না করিলে সংবাদ মাধ্যম উহার হৃত সম্মান ফিরিয়া পাইবে কিনা বলিতে পারি না।

ধন্যবাদান্তে
রাইস অফ ভয়েসেস