সব্বাই বলছে শিরদাঁড়া কমজোরি / Condition of Bengal Media

মিডিয়া তোমাদের ক্যালসিয়ামটা কম!
সব্বাই বলছে শিরদাঁড়া কমজোরি!

গত কয়েকদিন ধরে বালির দুই গৃহবধূ রাজমিস্ত্রীর সাথে প্রেম করে পালিয়েছে খবরটিকে “যশরত” কিম্বা “কাননে বৈশাখী”র মত ট্রোল করিয়ে চালানোর চেষ্টা হল। মনোবিজ্ঞানীকে দিয়ে কলাম লেখানো হল। “খাপ” পঞ্চায়েতের কায়দায় বিকল্প সমাজ মাধ্যমে রাজমিস্ত্রী এবং দুই গৃহবধূর চরিত্রের যে চচ্চরি বানানো চলছিল তার প্রতিবাদ জানানো হল। এমনকি “রাজমিস্ত্রী”র প্রতি আচরণে সামাজিক শ্রেণীবিন্যাস কতটা প্রতিফলিত হল এবং গৃহবধূদের বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের আলোচনায় ও সমালোচনায় পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা কতটা আধিপত্য বিস্তার করল তার চুলচেরা বিশ্লেষণ হলো! কারণ সাম্প্রতিক কলকাতার পৌরভোটে শাসকের “ছাপ্পা” ভোটের লজ্জা লুকোতে হবে! তার থেকে জনমানসের চোখ ঘোরাতে হবে! তাই এত আয়োজন!

এদিকে পিঠোপিঠি খবর এল কোচবিহারে তুফানগঞ্জের কলেজের মধ্যে ধর্ষণের ঘটনার পর, এবার শীতলকুচির এক কলেজছাত্রীকে কলেজে যাওয়ার পথে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। আর দেউচা-পাঁচামী’র প্রস্তাবিত কয়লা খনিপ্রকল্প অঞ্চলে বসবাসকারী আদিবাসী মহিলারা বেদম পিটিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে শাসক দলের গুন্ডা বাহিনীকে। তার প্রত্যুত্তরে স্থানীয় থানার “আইসি”র নেতৃত্বে পুলিশবাহিনী আদিবাসী মহিলাদের যথেচ্ছ মেরেছেন। শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠেছে খোদ পুলিশের বিরুদ্ধে। আর সেই ঘটনা ধামাচাপা দিতে, জেলাশাসক দেউচা-পাঁচামিতে বহিরাগত ঢোকা নিষিদ্ধ করেছেন যাতে এমন অপ্রীতিকর ঘটনার খবর বাইরের কেউ না পায়। পাশাপাশি খবর এল ২১শে ডিসেম্বর কলকাতা পুরসভা ভোটের ফল প্রকাশের পর শাসক দলের সৌজন্যে দখল হওয়া নেতাজি নগরে বামেদের বাস্তুহারা কমিটির অফিস, ডিওয়াইএফআই আর এসএফআই এর অফিস হাজার হাজার স্থানীয় মানুষ জড়ো হয়ে তার দুদিনের মাথায় পুনরুদ্ধার করেছেন। একসাথে এতগুলো নেতিবাচক ঘটনার খবর সামনে এসে পড়ায় শাসক ফের ব্যাকফুটে!

মিডিয়া বুঝলো একটা “বালি” র ঘটনা দিয়ে এতগুলো খবরকে চাপা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই গরু খোঁজা খুঁজে সামনে আনা হল মেদিনীপুরবাসী পিংলার জনৈকা গৃহবধূর রহস্যজনক নিখোঁজ সংবাদ। ইনিও নাকি পালিয়ে তাঁর প্রেমিককে বিয়ে করেছেন। অপ্রাসঙ্গিক মুচমুচে খবর তৈরি হল। বালির ছায়া নাকি পিংলায়!

কিন্তু এদিকে দেউচা-পচামির আন্দোলনের ছায়া, যতদিন যাচ্ছে ততই দীর্ঘ হচ্ছে! খবর আসছে বীরভূম জেলার মহম্মদবাজারে আদিবাসী অধিকার মঞ্চের তরফে দেউচা-পচামিতে আদিবাসী মহিলাদের ওপর পুলিশী অত্যাচারের প্রতিবাদে বড় মিছিল হয়েছে। সিপিআই(এম) নেত্রী দেবলীনা হেমব্রমও ট্যুইট করে বসে আছেন তাই নিয়ে! যদিও আদিবাসী মহিলাদেরকে পুরুষ পুলিশবাহিনী পিটিয়ে দিলেও কোন মনস্তত্ববিদকে দিয়ে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে কলাম লেখানো হল না কোন সংবাদপত্রে!

উল্টে সে খবর চাপা দিতে হাজির করা হল মুকুল রায়কে! একদা এই মিডিয়ার তৈরি বাংলার “চাণক্য” এখন হাসির খোরাক! একদল সাংবাদিক ও ঘর ভর্তি ক্যামেরা-বুমের সামনে উনি বলে ফেলেছেন “তৃণমূল কংগ্রেস মানেই বিজেপি”। পাশে তৃণমূল নেতা কেষ্ট! সামাল দিতে এবার বাজারে ছাড়া হল সোডিয়াম পটাসিয়ামের গপ্পো! দল ও পরিবারের তরফে জানানো হল স্ত্রী-বিয়োগের পর রায় সাহেব মানসিকভাবে বিপর্যস্ত, তৃণমূলে যোগ দিয়েও তা কাটে নি । এখনও নাকি রায় সাহেবের সোডিয়াম পটাসিয়াম ওঠানামা করছে! তাই মাঝেমধ্যেই মানসিক ভারসাম্যের অভাব ঘটছে!

এসব “হাবিজাবি” তত্ত্ব দিয়ে সবে ড্যামেজ কন্ট্রোল “হচ্ছে হচ্ছে” পরিস্থিতি তারমধ্যেই এবার খবর এল মুকুল রায়ের আইনজীবী বিধানসভার স্পিকারের কাছে এবং হাইকোর্টে এফিডেফিট দিয়ে জানিয়েছেন মুকুল রায় এখনও বিজেপিতেই আছেন! উনি বিজেপি থেকে পদত্যাগ করেন নি! ফলে স্বভাবতই বিজেপি থেকে পদত্যাগ না করেও তৃণমূল করা যায় এমন একটা সম্ভাবনা উঁকি দিতে শুরু করলো জনমানসে! সেই সঙ্গে কলকাতা পুরভোটের পর উজ্জীবীত বামেদের পুরনো “বিজেমূল” তত্ত্বে সিলমোহর পড়তে শুরু করলো! যদিও এখনও আমরা জানতে পারিনি রায় সাহেবের আইনজীবীরও সোডিয়াম -পটাসিয়ামের সমস্যা আছে কি না! মিডিয়ার উচিৎ ছিল খোঁজ-খবর করে জানানো!

কিন্তু তা না করে নজর ঘোরাতে এবার সামনে আনা হল নতুন ব্রেকিং নিউজ! বিজেপির নতুন গঠিত রাজ্য কমিটিতে মতুয়া প্রতিনিধি না থাকায় তার প্রতিবাদে বিজেপির বিজয়ী পাঁচজন “মতুয়া” বিধায়ক নাকি বিজেপির হোয়াটসওয়্যাপ গ্রুপ থেকে বেড়িয়ে গেছেন! মানে দলত্যাগ নয়, দলের হোয়াটসওয়্যাপ গ্রুপ ত্যাগ করলেও হেড লাইন বা ব্রেকিং নিউজ করতে হচ্ছে আসল গুরুত্বপূর্ণ খবর ঢাকবার জন্য!

আর এভাবে ক্রমাগত ব্রেকিং নিউজ করতে করতে সংবাদমাধ্যমের শিরদাঁড়াটাই ক্রমশঃ ভেঙ্গে যাচ্ছে! অন্যের সোডিয়াম-পটাসিয়াম ওঠা নামার খবর করতে গিয়ে নিজেদের ক্যালসিয়ামের অভাবটা এরা ধরতে পারছে না।

আর তাই রাইস অফ ভয়েসেস এর তরফে জনস্বার্থে সবকটি বাজারি সংবাদমাধ্যমকে অঞ্জন দত্তের জনপ্রিয় গান ধার করে জানানো হচ্ছে :

মিডিয়া তোমাদের ক্যালসিয়ামটা কম!
সব্বাই বলছে শিরদাঁড়া কমজোরি!

ধন্যবাদান্তে,
রাইস অফ ভয়েসেস