ভাগাড়ে জনমত / Public Opinion in the Bin

১৯শে ডিসেম্বর ছিল কলকাতার পুরভোট। সেই উপলক্ষে ধরা পড়ল ভিন্ন স্বাদ ও মাত্রার নানা ছবি। ইদানীং গণতন্ত্রে জনগণের খুব একটা আধিপত্য থাকে না। বরং ভোট এলেই শাসকদল তার ভাড়াটে সংবাদ মাধ্যম এবং বাহুবলী বাইক বাহিনীকে দিয়ে নিজের স্বপক্ষে জনমত তৈরি করে নেয়। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। এটাই এখন রেওয়াজ! এজন্যই ধারে ভারেও প্রচারে শাসকদল ভোটের আগেই বিরোধীদল গুলোর থেকে এগিয়ে ছিল। শাসকদলের প্রার্থীদের সমর্থনে হোর্ডিং ব্যানার আর পোস্টারে কলকাতাকে মুড়ে ফেলা হয়েছিল। সৌজন্যে সরকারের তরফে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে চালিয়ে যাওয়া ক্লাব খয়রাতি। আর বিজ্ঞাপন খয়রাতির প্রতিদানে মূলস্রোতের প্রায় সবকটি সংবাদ মাধ্যম তাদের সাধ্যমত বিরোধীদের হেয় এবং শাসককে মহিমান্বিত করে সংবাদ প্রচার করে গেছে। সঙ্গে রয়েছে জনমত সমীক্ষার নামে বাজারি দালাল চক্রের মগজধোলাই। ফলে অধিকাংশ ওয়ার্ডেই ভোটের আগেই শাসকের স্বপক্ষে জনমত তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আর যে ৪০-৫০ টা ওয়ার্ডে বিরোধীরা কিছুটা লড়াই দিতে পারত সেখানে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনকে ঠুঁটো জগন্নাথ করে রেখে চললো শাসকমদতপুষ্ট দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি। বিরোধীদলের এজেন্টদের বার করে দেওয়া হল বুথ থেকে। বুথের মধ্যেকার সিসিটিভি ক্যামেরার মুখ কাগজ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল (সে ছবিও ক্যামেরা বন্দি হল এবং সামনে এল) যাতে ভোট চুরির কোন রেকর্ড না থাকে। কোথাও আবার ক্যামেরার মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া হল এমনভাবে যাতে বুথের মধ্যেকার কিছুই দেখা না যায়। তারপর দেদার ছাপ্পা ভোট হল বুথে বুথে। এমনকি বিরোধী দলের প্রার্থীর পরিবারের ভোটও ছাপ্পা পড়ল। বহু মানুষজন ভোট দিতে এসে জানতে পারলেন তাঁদের ভোট ইতিমধ্যেই পড়ে গেছে। তবুও যখন এদ্দুর কষ্ট করে এসেছেন তখন অন্য কারোর নামে একটা ভোট দিয়ে যান এমন হাস্যকর অনুরোধও এল স্বয়ং প্রিসাইডিং অফিসারদের তরফ থেকে। বেলা গড়াতেই শহরজুড়ে চলতে থাকা এমন সার্বিক লুঠপাঠের প্রতিবাদ জানাতেই পুরুষ-মহিলা নির্বিশেষে বিরোধীদলের প্রার্থীদের গায়ে হাত উঠল।

সিপিআই(এম) প্রার্থী মনীষা বিশ্বাসের ফাটলো মুখ। বিজেপির মীনাদেবী পুরোহিতের ছিঁড়ল ব্লাউজ। দুষ্কৃতীদের ছোঁড়া বোমার আঘাতে জনৈক বামকর্মীর পা উড়ে গেল। আহত হলেন সিপিআই(এম) প্রার্থী ফৈয়াজ খান। শহর জুড়ে চললো বাইক বাহিনীর দাপাদাপি। উদ্দেশ্য স্পষ্ট ! শাসকের তরফে একতরফা জনমত চাই। ১৪৪ এ ১৪৪। আগরতলার ৫১ তে ৫১ র পাল্টা। যেহেতু ত্রিপুরার শাসকদল বিজেপি এখানে প্রধান বিরোধী কাজেই খুব একটা ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারবে না।

এমনিতে বাস্তবের মাটিতেও প্রধান বিরোধীদল বিজেপিকে কলকাতার ১৪৪ টা ওয়ার্ডের মধ্যে ৩-৪ টে ওয়ার্ডের বাইরে কার্যত খুজে পাওয়া গেলো না। সেই তুলনায় বামফ্রন্ট কর্মীরা এবং কিছুটা হলেও কংগ্রেস রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ প্রতিরোধ করলেন। বিজেপির কাগুজে বাঘ নেতারা দুদিন আগে সিঙ্গুর বেড়াতে গিয়ে ফুটেজ না পেয়ে শেষে ভোটের দিন সল্টলেকে বিধানসভার বিরোধীদলনেতার বাড়িতে ঘরবন্দী থেকে এবং হাতেগোনা কয়েকজন বিধায়ক হস্টেলের তালাবন্দী গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে পোজ দিয়ে ফুটেজ খাওয়ার চেষ্টা করলেন। পেলেনও হয়ত বা!

দিনের শেষে শাসকদলের তরফে দাবী করা হল কলকাতাবাসী উৎসবের মেজাজে ভোট দিয়েছেন। প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন গর্দান হেলিয়ে সারাদিন ধরে ঘন্টায় ঘন্টায় সেরকমটাই জানাচ্ছিল। দিনের শেষে তারাও জানাল কয়েকটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া ভোট অবাধ এবং শান্তিপুর্ণ! জানা গেল ৬৩.৫৭% ভোট পড়েছে। যা কিনা গত পুরভোটের ভোটদানের হার ৬৮.৫% এর থেকে প্রায় ৫% এর মত কম।

আর আমাদের প্রশ্নের শুরু এখানেই! উৎসবই যদি হবে তাহলে গতবারের থেকে ৫% কম মানুষ ভোট দিতে এলেন কেন! তাঁদের কি এই শাসক নির্মিত উৎসবের মেজাজটা পছন্দ হল না! নাকি তারা পুরপরিষেবাতে সন্তুষ্ট না হলেও শাসকদলের প্রথমসারিতে জেলখাটা চোর-চিটিংবাজ-তোলাবাজ-দুর্বৃত্তরা রয়েছে জেনেও যেহেতু তারাই জিতবে কাজেই কষ্ট করে আর রাস্তায় নামলেন না বা খুব একটা আগ্রহ দেখালেন না ভোট নিয়ে! বরং এসব ভুলে পাড়ার মোড়ে মাংসের দোকানে লাইন দিলেন! রোববারের দুপুরে মাংস-ভাত পেঁদিয়ে দিবানিদ্রার মধ্যেই আসল মেজাজ খুজে নিলেন! কারণ শহরের বেশ কিছু এলাকায় বুথে বুথে ভোট দাতাদের লাইনের থেকে ঐ পাড়ারই মাংসের দোকানের লাইন অনেক বড় ছিল এমনটাই খবর রয়েছে আমাদের কাছে।

প্রত্যেকবার ভোটের দিন দুয়ারে শাসক মদতপুষ্ট দুষ্কৃতীদের দাপাদাপি কি শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্তকে পোলিং বুথের লাইন থেকে হঠিয়ে মাংসের দোকানে পাঠিয়ে দিচ্ছে!

শাসকের দাপাদাপিতে গণতন্ত্রে আজ ভোট মানে কি তবে মাংসের দোকান!

তথ্যসূত্রঃ-
a) https://epaper.anandabazar.com/imageview_60382_4334095_4_71_20-12-2021_0_i_1_sf.html
b) https://epaper.anandabazar.com/imageview_60382_43346912_4_71_20-12-2021_0_i_1_sf.html
c) https://epaper.anandabazar.com/imageview_60382_43346912_4_71_20-12-2021_0_i_1_sf.html
d) https://epaper.anandabazar.com/imageview_60393_4412016_4_71_20-12-2021_5_i_1_sf.html
e) https://epaper.anandabazar.com/imageview_60393_4412016_4_71_20-12-2021_5_i_1_sf.html
f) https://www.epaper.eisamay.com/imageview_6460_41433_4_1_20-12-2021_4_i_1_sf.html
g) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-20/202112200006354.jpg&category=0&date=2021-12-20&button=
h) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-20/202112200006352.jpg&category=0&date=2021-12-20&button=
i) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-20/202112192353458.png&category=0&date=2021-12-20&button=
j) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2021-12-20/202112192353433.jpg&category=0&date=2021-12-20&button=