ও নদী রে / The New Sorrow Of Bengal

“একূল ভেঙে ওকূল তুমি গড়ো,
যার একূল ওকূল দুকূল গেল,
তার লাগি কি করো?”

পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খন্ড এবং পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষের এই একই প্রশ্ন। ইস্যু আসে, ইস্যু যায় আর কিছু ইস্যু বছর বছর রিনিউ করা হয়, কেবলমাত্র রাজনৈতিক ডিভিডেন্ডের আশায়। ফারাক্কা বাঁধ তেমনই একটা ইস্যু। চলমান সাপের মাথা চেপে ধরলে যেমন সাপ ছটফট করে, সেভাবে সুবিশাল গঙ্গাও ছটফট করছে ফারাক্কা বাঁধের ঠেলায়, আর কালে কালে বাড়ছে সেই ছটফটানি। যার প্রভাবে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে মালদহ, মুর্শিদাবাদের একের পর এক জনপদ। ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পর থেকে মালদহ, মুর্শিদাবাদের দুই পাড়ের প্রায় ৭,৫০,০০০ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে গঙ্গা ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও দেশের বা বঙ্গীয় রাজনীতিতে গঙ্গা ভাঙন কোনদিনই বিরাট ইস্যু হয়ে দাঁড়ায়নি, আজও ব্যপারটা সেই একই। রাজ্যের সেচ প্রতিমন্ত্রী কয়েক মাস আগে ভাঙন কবলিত অঞ্চল পরিদর্শনে গিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষোভের শিকার হয়েছিলেন। জুতোও ছোড়া হয়েছিল তাকে উদ্দেশ্য করে, পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়েছিল যে, শেষমেশ রাজ্যের সেচ প্রতিমন্ত্রীকে তড়িঘড়ি নৌকায় করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়া হয়। তারপরেও রাজ্যের ভাঙন পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।

ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ইতিকথা

১৯৭৫ সালে ভারত সরকারের উদ্যোগে এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় ফারাক্কা বাঁধ চালু হলেও, এর পরিকল্পনা সর্বপ্রথম করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে। সেই সময় কলকাতা বন্দর ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম (লন্ডন পোর্টের পরেই) এবং ব্যস্ততম বন্দর। ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ ভারতের অর্ধেকের বেশি আমদানি-রপ্তানি চলত আমাদের কলকাতা বন্দরের মাধ্যমে। কলকাতা বন্দর মানে তখন রয়্যাল প্রাইড। কিন্তু পলি সঞ্চয়ের কারণে কলকাতা বন্দরে জাহাজ ভিড়তে হচ্ছিল বিস্তর সমস্যা, কারণ গঙ্গা নদীর মূলপ্রবাহ তখন পদ্মা হয়ে পূর্ববঙ্গমুখী। আর হুগলী-ভাগীরথী ক্রমশঃ হারাচ্ছিল নাব্যতা। ব্রিটিশদের কাছে সেটা মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাই নেওয়া হয় গঙ্গার ওপর বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা। ১৮৫৩ সালে আর্থার কটন নামে এক ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারের মাথায় আসে এই ফরাক্কা ব্যারেজের ভাবনা। কারণ বিপুল ব্যবসা দেওয়া কলকাতা বন্দরকে তো মরতে দেওয়া যায় না।

জানা যায়, ১৮৫১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল অবধি ব্রিটিশ সরকার কমপক্ষে পাঁচটি সমীক্ষা করেছিল গঙ্গার ওপর বাঁধ নির্মাণের জন্যে। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল কিভাবে গঙ্গার জলের একাংশ ঘুরিয়ে হুগলী-ভাগীরথীতে প্রবাহিত করে পলি অপসারণ করা যায়। কিন্তু ব্রিটিশ জমানায় এর বাস্তব রূপায়ণ সম্ভব হয়নি।

ব্রিটিশরা দেশ ছাড়ার পর স্বাধীন ভারতে ফারাক্কা বাঁধের প্রথম পরিকল্পনা শুরু হয় ১৯৫১ সালে। কারণ পঞ্চাশের দশকে কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদীতে পলি জমা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৬১ সালে ভারত সরকারের উদ্যোগে শুরু হয় ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের প্রক্রিয়া। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন তদানীন্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার কপিল ভট্টাচার্য এই পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করেন। যার জন্যে তাকে “পাকিস্তানের চর” পর্যন্ত আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। সাধারণ বুদ্ধিতে অনেকেরই তখন মনে হয়েছিল, বাঁধ নির্মাণ করে পদ্মার স্বাভাবিক জলপ্রবাহ বন্ধ করলে যেমন কলকাতা বন্দর তার হারানো জৌলুস ফিরে পাবে, তেমনই রাজনৈতিকভাবে নতুন এবং ঘোষিত শত্রু পাকিস্তানকে একটু হলেও শায়েস্তা করা যাবে।

কপিল ভট্টাচার্য

কপিল বাবু কল্লোল এবং কালি-কলম গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থেকে সাহিত্য সেবা করলেও তিনি তাঁর বিজ্ঞানভিত্তিক নদীমনস্ক মন দিয়েই ফারাক্কাকে বিশ্লেষণ করেছিলেন। তিরস্কৃত হয়েছেন, চাকরি ছেড়েছেন কিন্তু বিজ্ঞানকে ছাড়েননি। তাই, নদীকে নদীর মতো চলতে দেওয়ার নীতি থেকে সরে আসেননি। ওনার যুক্তি ছিল:

ভাগীরথীর প্রবাহমুখ যেহেতু মূল গঙ্গার চেয়ে বেশ অনেকটা উঁচুতে (প্রায় ৮ মিটার), তাই উচ্চতার তারতম্যের কারণে গঙ্গা জলের সঞ্চালন স্বাভাবিক হবে না। ফলে গঙ্গা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজবে। যার ফলে ভাঙন কবলিত হবে মুর্শিদাবাদ এবং মালদহ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল। এছাড়াও এই দুটি জেলাজুড়ে দেখা দেবে জলাবদ্ধতা। ব্রহ্মপুত্রের তুলনায় গঙ্গা যেহেতু কম গতি শক্তিসম্পন্ন নদী, তাই সমতলে গঙ্গার গতিপথ অত্যন্ত আঁকাবাঁকা। কৃত্রিমভাবে বিপুল পরিমাণে জল সেখান দিয়ে প্রবাহিত করলে ভাঁটিতে হুগলী-ভাগীরথী ও উজানে বিহার পর্যন্ত সব নদীর আঁকাবাকা গতিপথের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফলে ওই সব নদীতে জলাবদ্ধতা, নদীভাঙন এবং চর সৃষ্টি ত্বরান্বিত হবে।

কপিল ভট্টাচার্যের প্রায় প্রতিটি আশঙ্কা এখন বেদবাক্যে পরিণত হয়েছে। গঙ্গার ক্রমশ পূর্বমুখী ভাঙনের প্রবণতা ও গতি-প্রকৃতি বিশ্লেষণ করে ইতিমধ্যে একদল বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়েছেন যে গঙ্গার বাম তীরের প্রবাহের চাপটি ক্ষয়কারী চ্যানেল থেকে সরিয়ে দিয়ে চাপ কমিয়ে ফেলার ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু ঘন জনবসতিপূর্ন মুর্শিদাবাদে রাতারাতি সেটা করে ফেলা প্রায় অসম্ভব। এখন গঙ্গার প্রবাহের যা গতিপ্রকৃতি দেখা যাচ্ছে, তাতে বর্ষা চলে যাওয়ার পরেও বেশ কিছু জায়গায় ভাঙন অব্যাহত।

বঙ্গীয় প্রকৃতি ও পরিবেশ যেভাবে দিনে দিনে পাল্টাচ্ছে, তাতে এমন সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে যে, অতি ভারী বৃষ্টির ফলে সৃষ্ট বন্যায়, গঙ্গা ক্রমশ পূর্ব দিকের কালিন্দী নদীর সঙ্গে মিশে যেতে পারে এবং সম্মিলিত প্রবাহটি মালদহর নিমসারাই ঘাটে মহানন্দা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তাদের সম্মিলিত প্রবাহ বাংলাদেশের গোদাগাড়ী ঘাটে গঙ্গা/পদ্মার সঙ্গে মিশে গিয়ে সৃষ্টি হতে পারে নতুন নদী। তবে এমনটা কয়েক বছরে হবে না, সময় লাগবে। কিন্তু আগে থেকে উপযুক্ত প্রতিকার নিলে লক্ষাধিক মানুষ উদ্বাস্তু হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে পারে।

শুধু কপিল ভট্টাচার্য নন, দেশের প্রবাদ প্রতিম বৈজ্ঞানিক মেঘনাথ সাহাও বাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় সরকারের মাথায় রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু তা যথাযথভাবে পালন করা হয়নি। তৎকালীন ভারত সরকার অর্থনৈতিক লাভের উদ্দেশ্যে গঙ্গার গতিপথ এবং প্রাকৃতিক চরিত্রকে কম গুরুত্ব দিয়ে, জলবিদ্যুৎ আর সেচকে অতি গুরুত্ব দেওয়ায়, ফারাক্কাসহ বেশ কিছু বহুমুখী নদী পরিকল্পনা সার্বিকভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছিল।

কোন কোন অঞ্চল ভাঙনপ্রবন?

ফারাক্কা বাঁধের উজান (upstream) এবং ভাঁটি (downstream) দুই দিকেই গঙ্গা ভাঙন অব্যাহত।

উজান (Upstream)

ফারাক্কা বাঁধের আগে (upstream) গঙ্গার বাম পাড়ের মালদহ জেলার মানিকচক, কালিয়াচক ১, কালিয়াচক ২-এর ২২ টি মৌজা ইতিমধ্যেই গঙ্গাগর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়াও কালিয়াচক ৩, রতুয়া ১, রতুয়া ২ প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা কালিয়াচক ২-এর ভূতনির চর এবং পঞ্চানন্দপুরের। ষাটের দশকেও এই পঞ্চানন্দপুর ছিল এক বর্ধিষ্ণু অঞ্চল, এই অঞ্চলে ছিল নদী বন্দর, চিনিকল, হাই স্কুল ইত্যাদি। কিন্তু গঙ্গা ভাঙন এই অঞ্চলে এতটাই বিপজ্জনক হয়েছিল, যার ফলে প্রায় পুরো গ্রামের মানুষদের অন্যত্র চলে যেতে হয়। গঙ্গা ভাঙন প্রতিরোধ অ্যাকশন নাগরিক কমিটির সার্ভে রিপোর্টে জানা যায়, কালিয়াচক, মানিকচক অঞ্চলের প্রায় ৭৫০ বর্গকিমি অঞ্চলকে ইতিমধ্যেই গঙ্গা গিলে খেয়েছে, যার মধ্যে আছে ৬০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৪টি উচ্চ বিদ্যালয়।

মালদহের গৌড়ের নাম ও ইতিহাস আপনারা নিশ্চয়ই শুনেছেন। অতীতে গঙ্গার মূল ধারা প্রবাহিত হত এই অঞ্চল থেকেই, এরপর কালের নিয়মে গঙ্গা গতিপথ পরিবর্তন করেছে। ১৯৬১ সাল থেকে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে গঙ্গার স্বাভাবিক গতিপথ ব্যাহত হতে থাকে। নদীর উজানে প্রবল ভাবে জমতে থাকে নুড়ি, কাঁকড়, কাদা, বালি। নদীর মাঝে গজিয়ে ওঠে নানান চর, কালে কালে অগভীর হতে থাকে গঙ্গা, যার ফলে অতিরিক্ত জলের চাপে নদী ক্ষয় করতে থাকে বা ভাঙতে থাকে তার পাড়। এমনিতে ভূতাত্ত্বিক দিক থেকে মালদহ, মুর্শিদাবাদের মাটি দুর্বল এবং বেশির ভাগই বালির স্তর। তাই নদীতে জলের পরিমাণ বেড়ে গেলে, এই বালির স্তরগুলিতে জল ঢুকে ভাঙনের মাত্রা বেশ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেয়। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও প্রতিবেশী রাজ্য বিহারেও প্রায় প্রতিবছর বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি লেগে থাকে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, ফারাক্কাতে গঙ্গার স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ হওয়ার কারণে, প্রাকৃতিক ভাবে গঙ্গা আবার তার পুরানো পথ ধরতে চাইছে, সেটা গৌড় অঞ্চল থেকে। তাই মালদহের প্রায় গোটা দক্ষিণ অংশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

ভাঁটি (Downstream)

উজানে মালদহের মতন ভাটিতে গঙ্গার ডানদিকে ভাঙন গ্রাস করেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। নদীর উজানের সম্পূর্ণ অংশ ভারতের মধ্যে থাকলেও ভাঁটি অংশ ভারত আর বাংলাদেশের মধ্যে বিভক্ত। ভারত বাংলাদেশ দুই দেশের যৌথ উদ্যোগ ছাড়া মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে ভাঙন হাত থেকে রক্ষা পাওয়া অত্যন্ত কঠিন। র‌্যাডক্লিফ সাহেব যখন ‘৪৭ এ দেশ ভাগ করেছিলেন, তখন গঙ্গার এক পাশে ছিল পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) আর আরেক পাশে ভারত, কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর এই ছবি বদলে গেছে, কোথাও ভারতে গজিয়ে উঠেছে নতুন নদীচর, আবার কোথাও বাংলাদেশে। তাতে আবার আরেক সমস্যা, সেটা আন্তর্জাতিক সীমানার অদল-বদল।

মুর্শিদাবাদের গিরিয়া, এখানেই একসময় গঙ্গা দুই ভাগে ভাগ হয়েছে। একটা ভাগীরথী-হুগলি আর অপরটি পদ্মা৷ ভৌগলিক নিয়মে গঙ্গার স্বাভাবিক জলপ্রবাহ পদ্মা থেকেই প্রবাহিত। তার ওপর ভাগীরথীর উৎসমুখ এখন পদ্মার চেয়ে প্রায় ৮ মিটার (২৬ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত, তাই প্রাকৃতিক ভাবে জলের জোগান নেই ভাগীরথী-হুগলির নদীতে। ঠিক এই কারণেই প্রয়োজন হয়েছিল ফারাক্কা বাঁধের। কিন্তু এখন শুধু কলকাতা বন্দর নয় এখন, গোটা ভাগীরথী-হুগলি নদীর পার্শ্ববর্তী সব কয়টা গ্রাম-শহরের জলের যোগানের জন্যে ফারাক্কা বাঁধের গুরুত্ব আজ অপরিসীম। কিন্তু তাতে কপাল পুড়ছে আজ মালদহ, মুর্শিদাবাদের মানুষদের। এটা মাথায় রাখতে হবে, ফারাক্কা বাঁধের পরিকল্পনা যখন প্রথম করা হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, তখন দেশ ভাগ হয়নি। আর এই বাঁধের যখন রূপদান করা হল, তখন দেশ বিভক্ত।

গিরিয়া থেকে জলঙ্গি পর্যন্ত আসল ভাঙ্গনটা আসলে পদ্মার, গঙ্গার নয়৷ নদীর এক দিক ভাঙ্গে, আর আরেক দিক গড়ে, যার ফলে নিয়মিত নদীর বুকে চর সৃষ্টি হয়৷ প্রকৃতি আইন-আদালত-প্রশাসন যেহেতু বোঝে না, তাই এই অঞ্চলে মানুষ হারাচ্ছে জমি-জায়গা। পদ্মা জমি গিলে তৈরি করছে নতুন নতুন চর, তারপর সেটা কোন দেশের, তা নির্ধারণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই নিয়ে কূটনৈতিক কাজিয়া চলছে নিত্যদিন ৷ নদীর বুকে একের পর এক বিচিত্র সব অঞ্চলের সৃষ্টি হচ্ছে। কোনো কোনো চরের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কিছু অংশ ভারতের, বাকি অংশ বাংলাদেশের, যেখানে সীমান্ত রক্ষা করা মোটামুটি অসম্ভব৷

যেমন রাজনগর চরের উত্তর পাড়ের সামান্য কিছু অংশ বাংলাদেশের৷ নির্মল চরের পরেও নদীর অন্য পাড়ে ভারতের অংশ আছে, কিন্তু সেখানে প্রত্যেকদিন গিয়ে ক্যাম্প বানিয়ে রক্ষা করা রীতিমতো অসম্ভব৷ এতেই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের আন্তর্জাতিক সমস্যা৷

ফারাক্কার প্রায় ২০ কিমি ভাঁটি থেকে প্রত্যক্ষ করা যায় গঙ্গা ভাঙন। ফারাক্কা থেকে জলঙ্গী পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটার নদী পাড়ের ফারাক্কা, সামশেরগঞ্জ, সুতি ১, সুতি ২, রঘুনাথগঞ্জ ২, লালগোলা, ভগবানগোলা ১, ভগবানগোলা ২, রাণীনগর ১, রাণীনগর ২ এবং জলঙ্গী ভালোরকমের ক্ষতিগ্রস্ত। অতীতে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে ১৯৫২-৫৩ সালে ধুলিয়ান শহর প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তারপর আবার ১৯৭০-এ হয়েছিল এর পুনরাবৃত্তি, তারপর আবার এখন। বসতবাড়ি, স্কুল, ধর্মস্থান থেকে আম বাগান, লিচু বাগান অনেককিছুই আজ তলিয়ে গিয়েছে গঙ্গায়।

এক অদ্ভুত উভয় সঙ্কট তৈরি আজ ফারাক্কাকে নিয়ে। সঙ্কট সবারই, সে হোক পশ্চিমবঙ্গ, বিহার বা পড়শি বাংলাদেশ।

Image Credit: mongabay.com

ফারাক্কা বাঁধের উজান-ভাঁটির রক্ষণাবেক্ষণ এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ

বর্তমানে ফারাক্কা বাঁধের ৬ কিলোমিটার উজানে আর ৬ কিলোমিটার ভাঁটির মোট ৬+৬=১২ কিলোমিটার নদী পথের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের, বাকি অংশের দায়িত্ব রাজ্য সরকারের। অতীতে যেটা ছিল ৪০+৪০=৮০ কিলোমিটার অঞ্চল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার ভাড়ারের দোহাই দিতে দিতে, তাদের রক্ষণাবেক্ষণের অঞ্চল কমিয়ে দেওয়ার ফলে রাজ্যের ওপর চাপ বেড়েছে। অন্যদিকে রাজ্য সরকারের ভাঁড়ারে অর্থনৈতিক চাপের কারণে, সঠিক ভাবে নদী তীরের রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা যাচ্ছে না। যার ফলে প্রতিদিন সঙ্কটে পড়ছেন মালদহ, মুর্শিদাবাদ জেলার লক্ষ লক্ষ মানুষ। প্রশাসনিক স্তরে বালির বস্তা দিয়ে প্রতি বছরই অস্থায়ী ভাবে নদীর পাড় রক্ষার চেষ্টা হলেও, তা কোনোভাবেই সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। গঙ্গার জলের তোড়ে তলিয়ে যাচ্ছে বালির বস্তা। বোল্ডার অথবা কংক্রিট দিয়ে স্থায়ী ব্যবস্থার দাবি স্থানীয়রা বারংবার করলেও, তা কানে যাচ্ছে না প্রশাসনের। নিয়ম করে প্রতিবছর নদীতে ফেলা হচ্ছে বালির বস্তা, খোলা হচ্ছে নতুন টেন্ডার, তাতে পকেট ভরছে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এবং শাসক দলের নেতার, এমনটাই অভিযোগ করছেন গঙ্গা তীরে বসবাসকারী অনেকে। কিছু ক্ষেত্রে বালির জায়গায় ব্যবহার করা হচ্ছে ছাই এবং মাটির, এমনও অভিযোগ উঠেছে বারে বারে। বাম আমলে ধুলিয়ানের কিছু অংশে স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করা হয়েছিল বলে আমাদের জানালেন স্থানীয় মোদাস্সর হোসেন। তিনি আরও বলেন, ধুলিয়ান ঘাট সংলগ্ন কাঞ্চনতলা জেডিজে ইন্সটিটিউশন আর পুরোনো সিনেমা হলের নদী সংলগ্ন অঞ্চলে বোল্ডার পিচিং করে ভাঙন সামাল দেওয়ার যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তা এখনও অটুট। এরপর থেকে নদীর পারে প্রতিবছর বালি, ছাই, মাটির বস্তা দিয়ে খাপছাড়া ভাবে কিছু জায়গায় কাজ হলেও মুর্শিদাবাদের ১০২ কিলোমিটার নদী পাড়ের বিস্তীর্ণ এলাকায় তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি। যার ফলে বর্ষার সময় ছাড়াও অন্যান্য সময়েও মুর্শিদাবাদে গ্রামের পর গ্রাম তলিয়ে যাচ্ছে নদীর গ্রাসে।

Image Credit: mongabay.com

সামসেরগঞ্জের মহম্মদ ইলিয়াস আমাদের জানালেন, “প্রশাসন চিঠি-চাপাটি আর দায় ঝেড়ে ফেলা ছাড়া কিছুই করছে না।” কয়েকদিন আগে নাকি শাসক দলের কর্মীরা ফারাক্কা ব্যারেজের জিএম অফিস ঘেরাও করেছিল, ইলিয়াসের প্রশ্ন, “ফারাক্কা বাঁধের ডাউনস্ট্রীমে ৬ কিলোমিটার কেন্দ্র সরকারের অধীনে থাকলেও, সামশেরগঞ্জের নদীর পাড়ের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব রাজ্যের সরকারের। শাসকদল কি তবে জিএম অফিস ঘেরাও করে নিজেদের দায় দায়িত্ব থেকে হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে?”

“রাজ্য সরকার একান্তই যদি মানুষকে গঙ্গার থেকে রক্ষা করতে না পারে, তবে লোকসভা রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় সরকারকে তীব্র চাপ দিচ্ছে না কেন? তাহলে, কি রাজ্য সরকারের কেন্দ্রীয় সরকার পক্ষের প্রতি দুর্বলতা আছে?” প্রশ্ন রাখলেন বর্ষীয়ান ভোলানাথবাবু।

স্থানীয় বাসিন্দা নাসিম আবার ক্ষোভ প্রকাশ করলেন মুখ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যের ওপর। “সেদিন মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনিক সভায় বলেছিলেন, ‘গঙ্গার ধারে এরা বাড়ি করেছে কেন?’ ওনার কাছে নাকি সব খবর থাকে, উনি কি জানেন না, কেউ গঙ্গার ধারে বাড়ি তৈরি করেনি, প্রশাসনের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে গঙ্গা নিজের গতিপথ বদলে আমাদের বাড়ি-ঘরের কাছে পৌঁছে গেছে৷”

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বেশ কয়েক বছর আগে ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দেওয়ার কথা বলেছিলেন, আর সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও প্রধানমন্ত্রীকে তিন পাতার চিঠি লিখে গঙ্গা ভাঙন সম্বন্ধে তার উদ্বেগের কথা জানালেও, সামশেরগঞ্জের স্থানীয় বাসিন্দা আলম বললেন, “চিঠি লিখলেই যেন গঙ্গা পাড় ভাঙা বন্ধ করে দেবে, আর আমাদের বাড়ি ঘরগুলো যেন গঙ্গা থেকে উঠে দাঁড়াবে, ভোট ছাড়া এরা কিচ্ছু বোঝে না।”

মালদার বীরনগর, পঞ্চানন্দপুর, এবং মুর্শিদাবাদের ফারাক্কা ও ধুলিয়ানবাসীদের জীবনধারণে ভাঙন ধরিয়ে দিয়েছে গঙ্গার ভাঙন। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ প্রতি বছর সরকার আশ্বস্ত করে, কিন্তু সুরাহা হয়না। প্রশ্ন তোলা হলেই, রাজ্য আঙ্গুল তোলে কেন্দ্রের দিকে আর কেন্দ্র আঙ্গুল তোলে রাজ্যের দিকে।

ফারাক্কা বাঁধ ভেঙে দিলে কি হতে পারে?

  • প্রথমে যেটা হবেই, সেটা গঙ্গার মূল প্রবাহ অতি অবশ্যই পদ্মা দিয়ে প্রবাহিত হবে। যাতে সবচেয়ে খুশি হবে পড়শি বাংলাদেশ
  • যদি নিয়মিত ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীবক্ষ থেকে অতিরিক্ত পলি তুলে নেওয়া হয় এবং বৈজ্ঞানিক উপায়ে নদীর পাড়ে বৃক্ষরোপন ও বোল্ডার বা কংক্রিট দিয়ে বাঁধ দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে মালদহ, মুর্শিদাবাদ ভাঙনের হাত থেকে যেমন রক্ষা পেতে পারে, তেমনই বিহারও বন্যা পরিস্থিতির হাত থেকে বাঁচাতে পারে
  • গোটা ভাগীরথী-হুগলি জলের পর্যাপ্ত যোগানের অভাবে অতি দ্রুত শুকিয়ে খালের মত হয়ে যেতে পারে
  • গাঙ্গেয় বদ্বীপে প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে সেচ ব্যবস্থা, যাতে মাথায় হাত পড়তে পারে কৃষকদের।
  • গঙ্গা তীরবর্তী শিল্পসমূহের শিল্প চালানোর জন্যে পর্যাপ্ত জলের জোগান বড় মাত্রায় কমবে।
  • কলকাতা বন্দরের নাব্যতা মারাত্মক ভাবে কমে যাবে, যার ফলে জাহাজ চলাচল ব্যাহত হবে। যাতে কলকাতা ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য প্রবল ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

তাই ফারাক্কা বাঁধ ভাঙ্গার প্রশ্ন উঠলেও, তা ভাঙা যাবে না। এই বাঁধ রেখেই কেন্দ্র ও রাজ্যের অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে সবাই উপকৃত হয়।

এই মুহূর্তে কি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা

  • যে কোন উপায়ে উজানে নদীর বাম দিকে এবং ভাঁটিতে নদীর ডান দিকে মুর্শিদাবাদে ভূমিক্ষয়ের চাপ কমিয়ে আনতে হবে।
  • ভাঙন রোধে বালির বস্তা, ছাই ইত্যাদি দিয়ে অস্থায়ী সমাধানকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে এবং অবিলম্বে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে স্থায়ী সমাধানের পথ প্রশস্ত করতে হবে।
  • নদীর পাড়ে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বৃক্ষরোপন করে ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ কমানোর চেষ্টা করতে হবে।
  • নদীর বুকে যে সব নিত্যনতুন চর গজিয়ে উঠছে, সেগুলো ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে অপসারণ করে, নদীর নাব্যতা বাড়াতে হবে।
  • নদীর পাড় থেকে বালি তোলা এবং মাটি কাটার কাজ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
  • ভারী এবং মাঝারি শিলা দিয়ে নদী বাঁধ তৈরি করা প্রয়োজন, যাতে জলের চাপে বাঁধ ভেঙে না পড়ে।
  • নদী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে নদীর গতিপথ সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য জোগাড় করা প্রয়োজন।
  • নদী ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের যথাযথ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।

মালদার বীরনগর, পঞ্চানন্দপুর, এবং মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ ও ধুলিয়ানের সাধারণ মানুষের সাথে কথা বলে আমরা যা তথ্য সংগ্রহ করেছি, সেটাই তুলে ধরলাম আপনাদের সামনে। আমাদের অনুরোধ, যত দ্রুত সম্ভব নদী বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের গঙ্গা ভাঙন নিয়ে স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করা প্রয়োজন, আর সাথে এটাও মাথায় রাখা দরকার, পড়শি রাজ্য বিহার এবং বাংলাদেশের সহযোগিতা ছাড়া গঙ্গা ভাঙন রোধ করা অত্যন্ত কঠিন। তাই সমস্ত রকমের রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতাকে দূরে সরিয়ে বিহার, মালদহ, মুর্শিদাবাদ এবং তার সাথে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষদের ভবিষ্যতের জন্যে গঙ্গা ভাঙনের স্থায়ী সমাধান খুবই জরুরি।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস