ব্যাটে বল লাগছে কি? / It’s Not a Game

‘খেলা হবে’ স্লোগানটাই গত বিধানসভা টুর্নামেন্টের থুড়ি নির্বাচনের মূল এজেন্ডা ছিলো বলাটা অত্যুক্তি হবেনা।

প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে ভোট দেওয়া ছাড়া দেশ পরিচালনায় (বা রাজ্য) বিশেষ কোনো ভূমিকা থাকে না জনসাধারণের। ওয়েল ইনফর্মড ভোটার গণতন্ত্রের সম্পদ। অজ্ঞ জন নিজেদের শাসনতন্ত্রে আপদ ঘরে বিপদ টেনে আনে, ওই ভোটের মাধ্যমেই এবং জনতা বেশি তথ্য ঘাঁটতে ভালোবাসে না। তার কানে চোখে তথ্য পৌঁছে দেয়ার দায়িত্বে থাকে সংবাদমাধ্যম। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। গণতন্ত্রের পোশাকে রাজতন্ত্রের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে যখন দেশ ও বিশ্ব পরিচালক বৃহৎ বাণিজ্যচক্রের; তখন তারা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিগ হাউসগুলো কিনে নিয়ে যেটা পরিবেশন করছে তাকে সংবাদযাত্রা বা অলীকতথ্যকুনাট্য নাম দিলে ‘তথ্যনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন’ শব্দবন্ধের সম্মানরক্ষা হবে। (মৃতের অসম্মান করতে নেই, এ সুপ্রাচীন সংস্কার নিশ্চই মরে যায়নি এখনো!)।

আমরা কবে থেকেই দেখছি (তাই আর অবাক হই না) সংবাদমাধ্যমের রাজনৈতিক ধারাবিবরণী থেকে অর্থনীতি, সামাজিক উন্নয়নের যত প্রশ্ন সব আগাছার মতো নির্মূল হয়ে গেছে। সরকার নিজেই সংবিধান লঙ্ঘন করছে কিনা, নিজের আইন নিজেই ভাঙছে কিনা, তারা কি প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, কতটা পালন করেছে; সরকারি নীতির অভিমুখ কোনদিকে – এসব প্রশ্ন নেই। সরকারি বিজ্ঞাপনের দাবিগুলো বাস্তবের সাথে মিলিয়ে নেয়ার অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা অবলুপ্ত, সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরা অনুসন্ধিৎসু কেবল ভোটপ্রচারকালে নেতাকুল কি পানাহার করছে, সেই বিষয়ে। কত বছর হয়ে গেল মূলধারার সংবাদমাধ্যমে সরকারি কর নীতি, ভর্তুকির ক্ষেত্র নির্বাচন, সরকারি পরিকাঠামোর বৃদ্ধি-সংকোচন নিয়ে কোনো বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা দেখিনা কোনো ঘন্টাখানেক বা জানতে চাওয়ার প্রোগ্রামে।

সবরকম বাস্তব পরিস্থিতি ও জরুরি প্রশ্নগুলোকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রের চতুর(থ) স্তম্ভ নির্বাচন কেন্দ্র করে একটা উৎসবের পরিবেশ তৈরী করে। ভোট দিন। আনন্দ করতে করতে ভোট দিন। দেখুন অমিতাভ বচ্চন বিরাট কোহলি ভোট দিচ্ছে। ভোট দিচ্ছে একশো দুই বছরের বৃদ্ধা, নাতির কাঁধে চেপে। বৃদ্ধার মুখের ফোকলা হাসিতে নাতির আঙুলের ভিকট্রি চিহ্নে গণতন্ত্রের জয়। তিন প্রজন্মের ভোটার একসাথে এনজয় করছে আর আপনার এত অনীহা ভোট দিতে! ছিঃ !

কিন্তু ভোট তো শুধু উৎসব নয়। বাস্তবিক কোনো উৎসবই নয়। রাষ্ট্রের/রাজ্যের পরিচালকদের সাথে জনসাধারণের হিসাব নিকাশের দিন, ফয়সালার সময়। কিন্তু কিসের ওপর নির্ভর করে ফয়সালা, ভোট এসব হবে! বাস্তব রাজনীতির প্রশ্নগুলো সযত্নে ছেঁটে দেয়ার পর যে মাঠ পড়ে থাকে, সেখানে কি আর হবে, খেলা ছাড়া? সময়ের এ বিধিলিপি পড়ে ফেলেই তৃণমূল গত বিধানসভা নির্বাচনে এজেন্ডা পেশ করেছিল সুরে গানে – খেলা হবে। এ সুরে একটা আহ্বানও রাখা ছিলো। আহ্বান ছিলো নির্বাচিত প্রতিপক্ষ বিজেপির প্রতি। বিজেপিও সে আহ্বান শুনে সহজেই খেলতে রাজি। পাল্টা ‘খেলা খেলা খেলা হবে’ গেয়ে মাঠ গরম করতে নেমে পড়ে। খেলা হতে থাকে। একই খেলোয়াড় বাহিনী দু দলে ভাগ হয়ে বা একই খেলোয়াড় এদল-ওদল খেপ খেলে বাইনারীর খেলা জমিয়ে তোলে। তৃতীয়পক্ষ সিপিআইএমকে মাঠের পাশে দর্শক বানিয়ে বসিয়ে রাখার এই খেলা সফলও হয়। (খেলা চলাকালীন নো ভোট্টু চিয়ার লিডাররা যে বর্ণিল নৃত্য প্রদর্শন করে তার বিবরণ এখানে দিতে গেলে ফ্যাশন এন্ড লাইফস্টাইল পত্রিকায় লেখার রগরগে দক্ষতা চাই যা এই কলমচির নাই) । অতঃকিম? এরপর!

এরপর শিল্ড ও রানার্স কাপ ঘাড়ে যার যার ঘরে ফেরার কথা। কিন্তু ওকি! খেলোয়াড়রা খেলতে খেলতে মদহোঁশ। ঘর ভুলেছে তারা। রানার্স কাপ জয়ীরা প্রায় সকলেই শিল্ড বিজয়ীদের ঘরে ফিরেছে। শিল্ড বিজয়ীরা কেউ কেউ পরিশ্রমের মাপমত কল্কে না পেয়ে ঢুকে পড়েছে রানার্স কাপওলাদের ঘরে। এবং কিমাশ্চর্য্যম! দুই নির্বাচনী খেলার মাঝের যে ছোটছোট অতিগুরুত্বপূর্ণ খেলাগুলো, সেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির খেলোয়াড় বাহিনীর আর দেখাই নেই। দেখানোর মতো খেলোয়াড় নেই। খেলোয়াররা হেলমেট পরিবৃত মাথা নিয়ে মাঠের আশেপাশে আতংকিত মুখে বা ব্ল্যাক ক্যাট পরিবৃত দেহ নিয়ে প্রাতঃভ্রমণকালীন নিরুদ্বিগ্ন মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খেলার দম বা স্পৃহা সম্পূর্ণ উৎসন্নে গেছে।

এখানেই সিপিআইএম এর প্রবেশ। মিডিয়ার চৌকো মঞ্চে। সেখানে এদ্দিন ছিলনা, তার কারণ বোধহয় তৃণমূলকর্তৃ বলামাত্র কলকাতা লন্ডন, বাংলা ইংল্যান্ড হয়ে গেছে। বা না বলতেই আমেরিকা হয়ে গেছে। বিশ্বের উন্নততম গণতন্ত্র। যেখানে দুটি দলই থাকবে প্রতিদ্বন্দ্বীতায়। তৃতীয় কোনো দলের লাইমলাইটে আসার অবকাশ নেই। এতে খেলা সহজ ও স্পষ্ট হয়। সত্যিকারের খেলা হোক বা না হোক। বিরোধী বিজেপি খেলোয়াড় একেবারেই না দিতে পারায় মিডিয়া নেহাত খেলার চৌকো মাঠটাকে টিঁকিয়ে রাখার স্বার্থে সিপিআইএম কে একটু দেড়টু ফুটেজ দিতে শুরু করে। এমতাবস্থায় সিপিআইএম কেই প্রধানত লড়তে হচ্ছে তৃণমূলকর্তৃর ছোট ছোট কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ খেলাগুলোর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে। আদৌ তারা খেলতে পারছে? বল বুঝতে পারছে? নাকি গুগলিতে চালিয়ে খেলতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যাচ্ছে পরপর!

নিকট অতীতের একটা উদাহরণ দেখা যাক। সরকারি অনুষ্ঠানমঞ্চে মুখ্যমন্ত্রী বললেন পশ্চিমবঙ্গে শিল্প নেই এটা নেহাতই বিরোধী অপপ্রচার। শিল্পের কাঠামোকে সুবিপুল হতে হবে কে বলল! বাংলার মোড়ে মোড়ে শিল্প। চপ তৈরী বা ঘুগনি রান্না করে বিক্রি করা কি কম শিল্প? কত লোক ওই করে লাখ কোটিপতি হচ্ছে। চাকরি চাকরি করে পাগল না হয়ে বেকার যুবসমাজ কেন শিল্পকর্তা হয়ে উঠছে না চপ ভেজে বা ঘুগনি বেচে! আমাদের সততার প্রতীক মুখ্যমন্ত্রী কথাগুলো বলার সময় ‘বিস্ময়ের প্রতীকে’ পরিণত হয়েছিলেন। সিপিআইএম বল পেয়েই চালিয়ে দেয়। বল না বুঝে, লোপ্পা ক্যাচ তোলা শট নিয়ে। প্রথাগত মিডিয়া সোশ্যাল মিডিয়া বাজার হাটে সচল সিপিআইএম নানা প্যারোডি মিমে বিরোধী প্রচার জমিয়ে তুলল – যার মূল আক্রমন তির, না, তৃণমূলনেত্রী না, চপ ও ঘুগনি বেচা পেশার দিকে। বক্তব্য বিষয়, বিশেষতঃ সোশ্যাল মিডিয়ায় – চপ বাণিজ্য শিক্ষিত লোকের কাজ না (মানে ছোটলোকের কাজ) থেকে ক্রমে চপ ঘুগনি বানানো অত্যন্ত নিচু কাজ, হাস্যকর পেশা, তুচ্ছ কাজ – জাতীয় রঙ্গব্যঙ্গর দিকে ধাবিত। এই সমবেত হৈহল্লা প্রচারের ব্যাট চালানোর ফলাফল কি হচ্ছে? কাশফুলের বালিশ বা কচুরিপানার থালাবাটির ব্যবসাবুদ্ধি দানের সাথে চপ ঘুগনি কে বাংলার শিল্প বলে হেঁকে দাবি করার ধূর্তামিগত পার্থক্যটা না বুঝে, গরিব বস্তিবাসীর পার্টি হিসাবে একদা নিজেকে দাবি করার দল ওই মানুষগুলোর সাথেই নিজের দূরত্ব আরো বাড়িয়ে ফেলছে।

ভ্যান ঠেলা রিক্সা চালানো, লটারির টিকিট বেচা, চায়ের দোকান, পানবিড়ির গুমটি, ফুটপাথে দোকান দেয়া হকার, নানা মুখরোচক খাদ্য বানিয়ে বিক্রি করা, ছোটোখাটো কারখানায় কায়িক শ্রম দেওয়া মানুষেরা – এককথায় সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমজীবী ভোটারদের কাছে চপ ঘুগনি বেচা গ্লানির পেশা তো নয়ই, একটা অংশের কাছে নিজের পেশার থেকে উত্তরণের উপায়। স্রেফ প্রচারভঙ্গী ব্যবহার করে তৃণমূল নেত্রী মোড়ের চপ বিক্রেতা থেকে ওই সমস্ত ‘ভদ্রলোক-অগম্য’ পেশার মানুষগুলোর কাছের লোক হয়ে উঠলেন। দেখালেন, আমি তোমাদের লোক, তোমাদের পেশাকে অত্যন্ত মর্যাদা দিই। বিরোধী সিপিআইএম জানিয়ে বসল এসব ওঁচা পেশার বোঁচা লোক না, আমরা উন্নতনাসা চাকরিজীবীদের কাছের লোক। শ্রীমতি ব্যানার্জি এটাই চাইছিলেন। বল যেখানে যেভাবে যা ভেবে ফেলেছেন, সেটাই খাটছে।

বলি, সিপিআইএম কি মোডে বিরোধিতা করলে ব্যাটে বল ঠিক লেগে চার ছয় হতেও পারত। তারা বলতে পারত কিছু তৈরী করে আউটলেটে বিক্রি করা মানেই শিল্প নয়, কড়াই কাঁচের আউটলেট নিয়ে বসে থাকা ছোট গুমটি আর কুটির শিল্পের সংজ্ঞাগত পার্থক্য আছে। তারা সরকারের কাছে জানতে চাইতে পারত, চপশিল্প কি এমএসএমই তালিকাভুক্ত? সরকারি ভর্তুকিযুক্ত লোন মেলে ওই শিল্পে? অন্যান্য কুটিরশিল্পের মতো এই শিল্পের জন্য ক্লাস্টার গড়ে তোলায় সরকার অগ্রণী ভূমিকা নেয় কি? চপ-ঘুগনি নির্মাণ প্রকৌশল আরো আধুনিক করে তোলা, বিপণনের নতুন কায়দা জানানোর জন্য কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে সরকারের যেমন থাকে ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পের জন্য? যদি না থাকে, তাহলে এরকম একটা প্রমিসিং স্বনির্ভরতা স্কিমের প্রতি সরকারি অবহেলার কারণ কি? সত্যি কি সরকার আন্তরিক? নাকি মুখে স্বীকৃতি দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলতে সচেষ্ট? সেক্ষেত্রে অবহেলার শিকার এরকম একটি অনুন্নত ক্ষেত্রে সরকারের তরফ থেকে নতুন উদ্যোগীদের প্রবেশ করতে বলা হচ্ছে কেন? এখনই সরকার একে শিল্পের প্রকৃত মর্যাদা দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিক।

অবশ্য বক্তৃতার গুগলিই এই পপুলিস্ট রাজনীতিকটির একমাত্র কৌশল নয়, সঙ্গে সরকারি প্রকল্পের ইয়র্কারও আছে। আর তা শুরু থেকেই বিরোধী উইকেট ওড়াতে সক্ষম। সিপিআইএম কে বস্তুতঃ জখম করে মাঠ ছাড়িয়েছে যে ইয়র্কার, তার নাম লক্ষীর ভান্ডার। লকডাউনে ধসে যাওয়া ধারে ডুবে থাকা অনিশ্চিত আয়ের কোটি মানুষের কাছে অভাবনীয় এক আশ্বাস – সরকার পাশে আছে। কিছু দিচ্ছে। সিপিআইএম ঠিকই বুঝেছিল এটা শ্রীমতি ব্যানার্জির ভোট ময়দান দখলের আসল হাতঘুর্ণী। উল্টোদিকে সিপিআইএমের ভোট খেলার স্টান্স ছিল ‘আমরা জোট করেছি’। যথারীতি ভোটে হার। তারপরেই ভাবনাচিন্তারহিত অন্ধ আক্রোশময় আক্রমণ ধেয়ে গেলো, না, তৃণমূল সুপ্রিমো নয়, প্রকল্প প্রাপক আপামর জনসাধারণের দিকে। মধ্যবিত্ত আপাত স্বচ্ছল বাম সমর্থক ও কর্মীদের একাংশ ছবি ছড়া গান মিমে বিরোধী প্রচার জমিয়ে ফেলল। যার সারাৎসার, সব লক্ষীর ভান্ডার প্রাপক ভিখারি, ভোটবেচা পাবলিক, ঘুষখোর, অনুদানজীবী। এ প্রচারের বিপদ রাজ্য কমিটি বুঝতে পেরে একটি বিবৃতি দিয়ে কর্মীদের এসব বলা থেকে বিরত থাকতে বলে। নির্দেশ দিয়ে এরিয়া কমিটিগুলিকে দুয়ারে সরকার প্রকল্প, লক্ষীর ভান্ডার প্রকল্পে নাম তোলার সহায়ক কেন্দ্র করে তোলে। সহায়তা কেন্দ্রে কাজ করে ফেরার পথে কর্মীরা ব্যক্তিগত স্তরে প্রকল্পটির প্রতি উষ্মা প্রকাশে বিরত থাকে না অবশ্য।

না, সিপিআইএম কর্মীদের চেতনার মান নির্ণয় এ নিবন্ধের লক্ষ্য নয়। কিন্তু বিষয়টি এড়ানোও যাচ্ছেনা। মুখে মুখে, মুখবুকে মতবিনিময়ের জেরে এ ধারণা জনমনে ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত যে সিপিআইএম সরকার গঠন করলে ওই অন্যায্য সাহায্যটি, যেটি বহু গৃহবধূর সরকারি পকেট মানি, বহু নিম্ন আয়ের মানুষের মুদিমসলা বা অপরিহার্য্য হয়ে পড়া স্মার্টফোনটির নেট রিচার্জের বাঁধা ব্যবস্থা, কয়েকমাস জমিয়ে সংসারের ছোটোখাটো শখের জিনিস কেনার উপায় বা শূন্য পড়ে থাকা শূন্যব্যালান্স একাউন্টটির অবিচল ভরে উঠতে থাকার আনন্দ সংবাদ; সেটি বন্ধ হয়ে যাবে।

এক্ষেত্রেও বল বুঝে পার্টির রাজ্যস্তর থেকে মাপা শট নেয়া দরকার ছিল। প্রথমতঃ শ্রীমতি ব্যানার্জির অন্যান্য সহায়তা প্রকল্পগুলির মতো এই প্রকল্পেও আয়সীমা দেখা হয় না। দাবি তোলা যেত, আয়সীমা দেখে স্বচ্ছল ঘরের বধূদের এ প্রকল্পের আওতা থেকে বাদ দিয়ে নিম্ন আয়ের মহিলাদের ভাতার পরিমান বাড়ানো হোক। কি হয় মাত্র পাঁচশো টাকায়! সিপিআইএম এর যুব সংগঠনের অনেকদিনের দাবি, সক্ষম বেকারদের কাজ না দিতে পারলে সরকার ৭৫০০ টাকা করে বেকার ভাতা দিক। এই দাবি নিয়ে আরো সোচ্চার হওয়া যেত। এর সঙ্গে ১৮০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরীর দাবিটি যোগ করে জোরকদমে প্রচার চালানো যেত। না। সেরকম কোনো কেন্দ্রীয় উদ্যোগ না থাকার ফলে আজও সাধারণ সমর্থক থেকে ক্যাডাররা বলে চলেছে ওরে ভোটার, তুই ভিখারি, দুর্নীতিগ্রস্থ, অমেরুদন্ডী। আবার মান হুঁশ সম্পন্ন হতে চাইলে আমাদের ভোট দে। এটা কি একটা পরিণত রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের হুঁশের নমুনা! তাদের থেকে আশা করা যায়!

যাকে পাগলী, সাইকো বলে একসময় অনির্বচনীয় আনন্দ উপভোগ করা চলত, এখনো অন্ধকার মুখে গালিটি একই দম্ভে দেওয়া চলছে, তার রাজনীতির ধারাটি অনুধাবন করা চলছে না। লকডাউন ও পরবর্তী পরিস্থিতির হিসাব নির্ভুল কষে দুর্নীতির শীর্ষে বসে থাকা রাজ্যের প্রকৃত উন্নয়নে অনিচ্ছুক মুখ্যমন্ত্রী পপুলিস্ট রাজনীতির নিয়মক্রম মেনে প্রসাধনী সংস্কারের মতোই ওপর চালাকি রাজনীতির বৃত্তাকার এক চাল চেলেছেন। সে চক্রবুহ্য ভাঙতে হলে বৃত্ত খুলে সরলরেখায় ফেলে বুঝতে হবে। একের পর এক নেয়া সিদ্ধান্ত ও আচরণ থেকে মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি ও বার্তাটি স্পষ্ট। স্পষ্ট পৌঁছোচ্ছে হেরে থাকা রাজনৈতিক দলের কাছে গবেট ও লোভী নামে আখ্যায়িত গনমস্তিষ্কে। কোভিড পিরিয়ডে ঘর চালাতে চোখে অন্ধকার দেখা মানুষেরা দেখে গেছে সরকারি কর্মচারীরা কেমন নিশ্চিত আয় উপভোগ করেছে বসে বসে। শেষের দিকে অফিস-কাছারি নিভু নিভু চালু হলে বাকিদের যাও বা সপ্তায় দুদিন অফিস করতে হয়েছে, টিচাররা কিন্তু ‘মজা মেরে গেছে’ বাড়িতে বসে বসে। আর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী শত অনুরোধ আন্দোলন আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে আজও ওদের ডি এ বন্ধ রেখেছে। কিন্তু প্রাইভেট সাধারণকে লক্ষীর ভান্ডার ডিএ দিয়ে চলছে কড়ায় গন্ডায়। দিনের পর দিন ধর্ণা গেড়ে বসে থাকা এসএসসি পাশরা ‘মজা মারা’ টিচার সম্প্রদায়ই হবে হয়তো একদিন। তাই ওদের প্রতিও সমবেদনা কম। ওই ফাঁকিবাজির চাকরি কে পেল না পেল বয়েই গেল, এ ভাবনাটাও কাজ করছে। সবশেষে মুখ্যমন্ত্রী বৃত্তটি জুড়েছেন চপ ঘুগনিকে শিল্প পদবাচ্য বলে। মোটমাট বার্তাটি হলো, দেখো, আমিও তোমাদের মতো ওই নিশ্চিত আয়ের মজায় থাকা সম্প্রদায়ের ওপর হাড়ে হাড়ে চটা। বাধ্য হয়ে স্যালারি দিচ্ছি, কিন্তু অনেক ভোগাচ্ছিও। ডান্ডা পেটাও দিচ্ছি। আমার ভাবনায় তোমরা, তোমাদের ডিএ। তোমাদের পেশা পশ্চিমবঙ্গের গর্বের পেশা।

অথচ বছর ঘুরতে চলল একশো দিনের কাজের টাকা বন্ধ। কেন্দ্র বন্ধ রেখেছে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগে। ভুগছে কারা? ওই চপ যাদের কাছে উত্তরণের শিল্প সেই শ্রেণীই। বামেদেরও শ্রীমতি ব্যানার্জির মতো এ নিয়ে বিশেষ হেলদোল নেই। তাদের সব আন্দোলন শিক্ষক পদপ্রার্থীদের ঘিরে। বারবার সমবেদনা জানিয়ে মিছিল, তাদের হয়ে কেস লড়া – এ সবই জরুরি। কিন্তু ব্যালান্সহীন। কিছু সংখ্যক দরিদ্র পরিবার বাদ দিয়ে মূলত মধ্যবিত্ত স্বচ্ছল শ্রেণীই শিক্ষকের চাকরির দাবিদার। সাড়ে ছ’কোটি ভোটারের মধ্যে পঞ্চাশ লক্ষের বেশি এই ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায় না। বাকি ছ’কোটির কাছে অনেক আকর্ষণীয় হতো ১০০ দিনের কাজের টাকা বন্ধের পিছনে যে দুর্নীতির অভিযোগ, তা সামনে আনা। তার কেষ্ট বিষ্টু কারা সেই নিয়ে তদন্ত করা। স্বতঃপ্রণোদিত মামলা করা। প্রাইভেট সেক্টরে ন্যূনতম ১৮০০০ টাকা মজুরির দাবির আন্দোলন আরো জোরালো করা। রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিক ও নারীপাচারের বাড়বৃদ্ধি নিয়ে জনপরিসরে প্রশ্ন রাখা।

শ্রেণী নির্বাচনে ভুল হচ্ছে বলা ভুল হবে। সিপিআইএম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পার্টিতে পরিণত তার নানা নিদর্শন আগেও দেখা যাচ্ছিল। এখন গৃহকর্মী, অ্যাপ কর্মীদের নমো নমো ইউনিয়ন গড়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা বা আইএসএফ কংগ্রেসের সাথে জোট গড়ে সাঁওতাল কুর্মি মুসলমানদের কাছে টানার চেষ্টা, কোনোটাই ফলপ্রসূ হবে না, যদি না পার্টিটি তার শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গিতে সার্বিক বদল আনে। যে শ্রেণীর ভোটে একদা শক্তিশালী ছিল পার্টিটি আজ সেই শ্রেণীই জড়ো হয়েছে বিরুদ্ধে ও স্থায়ী সমর্থন জুগিয়ে চলেছে কেন তৃণমূলকে তার সঠিক বিশ্লেষণ এড়িয়ে রামধনু জোটের সার্কাস দেখিয়ে লোক টানা যাবে না। পপুলিস্ট রাজনীতির অনেক বড় খেলোয়াড়টি মাঠ ভরিয়ে রাখবেন। এক্ষেত্রে প্রথম দরকার পাগলামি খামখেয়ালিপনা নয়, অত্যন্ত চালাক একটি মস্তিষ্কের চালের সাথে লড়াই হচ্ছে, এটা বোঝা। প্রতিপক্ষকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া। ব্যঙ্গ করতে থাকলে অনেক বড় বড় অপরাধী জোকারে পরিণত হয় জনমানসে। তার ক্রুর রূপটা লুকিয়ে ফেলতে সাহায্যই করে অতিব্যঙ্গের ব্যবহার। তাই পিসি-টিসি বাদ দিয়ে শ্রীমতি ব্যানার্জি বলা অভ্যেস করা চলতে পারে, যেমন করা হয়েছে নিবন্ধটিতে। এতে নিজের কাছে ছবিটা স্পষ্ট থাকবে। হয়তো ভবিষ্যতের বল স্পষ্ট দেখা যাবে, সঠিক চালাতে অসুবিধা হবেনা।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস