মরার উপর খাড়ার ঘা /  Don’t pour water on a drowned mouse!

বছর দশেক আগে বেড়াতে গিয়েছিলাম কাশ্মীর। সেপ্টেম্বর মাস, পেহেলগাওতে তখন হাতে গোনা টুরিস্ট, ঠিক করলাম চন্দনবাড়ি যাব। আঁকাবাকা পথ পেরিয়ে চন্দনবাড়ি পৌঁছাতেই আমাদের গাড়ির সামনে ছুটে এলেন এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক, নাম সম্ভবত আতিফ। উনি বললেন, চন্দনবাড়ি ঘুরিয়ে দেখাবেন। প্রথমে রাজি হইনি। ভদ্রলোক শুরু করলেন কাকুতি-মিনতি, অবশেষে রাজি হলাম। ওনার সাথেই গল্প করতে করতে দেখতে লাগলাম চন্দনবাড়ি। অভ্যেস মত জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় থাকেন, বাড়িতে কে কে আছেন, কি করেন? সেই প্রশ্নের মধ্যে থেকেই উঠে এলো কিছু উত্তর, যার জবাব আমার কাছে আজও নেই।

আতিফ জানালো অমরনাথ যাত্রার সময় পিঠে করে পুণ্যার্থী বয়ে নিয়ে গিয়ে ও যা রোজগার করে, তাই দিয়েই ওদের বছরের কয়েকটা মাস ঠিকঠাক চলে যায়। কিন্তু অমরনাথ যাত্রা তো বছরে একবার, বাকি সময়টা! আতিফ বললেন, “স্যার, আপনি জানেন, ছয় মাস বাদে আপনি কি করবেন, আমরা জানি না। পড়াশুনা খুব বেশি দূর করিনি। এই অঞ্চলে কোনো শিল্প নেই, তাই চাকরিও নেই, চাষবাসের কাজও সীমিত, আর শীতে বরফ পড়ে গেলে, সেটাও হয় না, তখন মেহনত-মজদুরিই ভরসা। আর ভরসা আপনাদের মত টুরিস্ট, যারা বছরের নানান সময় এখানে ঘুরতে আসেন, তখন যা আয় হয়, তাই দিয়েই আমাদের কষ্ট করে কেটে যায়।” আমি জিজ্ঞেস করলাম, তাহলে যখন অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হয়, তখন? তখন কি করেন?

“স্যার, আমার একটা ছোট ভাই ছিল, টাকার জন্যেই ওকে বাঁচাতে পারিনি। আমাকে বলা হয়েছিল, একটা প্যাকেজ লাগিয়ে আসতে হবে একটা ব্রিজের নিচে, তাহলে কিছু টাকা দেওয়া হবে, আমি রাজি হইনি।” দৃঢ় কন্ঠে বললেন আতিফ। তারপর কিছুক্ষন চুপ থেকে মাথা নিচু করে বললেন, “ভাইটাকে বাঁচাতে পারিনি স্যার। জানেন স্যার, আমরা কাশ্মীরীরা পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছি। দুটো শক্তিশালী দেশের শক্তি পরীক্ষার জায়গা হয়ে গেছে, আমাদের কাশ্মীর। সবাই বলে আমরা খারাপ, কিন্তু স্যার আমারা খারাপ নই, আমরা দুটো দেশের রাজনীতির শিকার। আমাদের কথা কেউ ভাবে না, ভারত ভাবে ভারতের কথা, পাকিস্তান ভাবে পাকিস্তানীদের। আমাদের কথা কেউ ভাবে কি? আপনি বলুন স্যার, কাশ্মীরের মানুষের কথা কি কেউ ভাবে?”

কোনো উত্তর দিতে পারিনি সেদিন। আজ সামাজিক মাধ্যমে ওএমআর শিট নিয়ে নানান পোস্ট দেখে আমার আবার মনে পড়ল আতিফের কথা।

যেভাবে কাশ্মীর ও কাশ্মীরীদের কথা না ভেবে শুধুমাত্র ভোটের রাজনীতির কথা ভাবা হয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সহানুভূতি কুড়োনোর চেষ্টা করা হয় সেই রকমই আজ যখন সামাজিক মাধ্যমে ওএমআর শীট নিয়ে যেভাবে প্রতিদিন বাজার গরম করা হচ্ছে তখন ধর্মতলার গান্ধীমূর্তির তলায় ৬০০ ও বেশী দিন ধরে বসে থাকা ছেলেমেয়েদের কথা মনে পড়ে গেল। সত্যিই কি ওদের কথা কেউ ভাবছেন?

কোনো দক্ষ ব্যক্তিও ভুল পদ্ধতিতে সরকারি চাকরি পেলে তা ১০০% বেআইনি নিয়োগই হয় এবং তা আইনি মতে চলে যাওয়ারই কথা। তা নিয়ে রাজ্যের শাসক দল ছাড়া কারোরই দ্বিমত নেই।

এখন বিশ্বকাপের মরসুম। মেসি, রোনাল্ডো, নেইমার বা এমবাপে যদি অফসাইডে গোল দেয়, তা কি গ্রাহ্য হবে? কখনোই হবে না। কিন্তু, তার মানে এই নয় যে তাদের অনসাইডে দারুণ গোল করার ক্ষমতা নেই।

যদি গোটা সরকারি নিয়োগপদ্ধতিটাই এলোমেলোভাবে হয়, তাহলে তার মধ্যে দক্ষ-অদক্ষ সবারই চাকরি যাবে। সবচেয়ে দক্ষ ব্যক্তিটি যদি যোগ্যতার প্রমাণ না দিয়ে, ঘুরপথে চাকরি পান, সেটাও অন্যায়।

যতটা কষ্ট করে একজন পোস্টদাতা ভুয়ো চাকরিপ্রার্থীদের ছবিসহ ফেসবুক একাউন্ট খুঁজে বের করছেন, তারা আরেকটু কষ্ট করলেই বার করতে পারেন, কোন নেতা টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইয়ে দিয়েছেন। সেক্ষেত্রে কিন্তু বিশেষ নজর কোনো দিক থেকেই দেখা যাচ্ছে না। আদালতের নির্দেশে যারা এখন জেলবন্দি তাদের নিয়ে কয়েকদিন ট্রোল করে, আর কিছু মিম বানিয়েই অনেকে ক্ষান্ত। কেন ভাই! ভয় পাওয়া আপনার অলিখিত জন্মগত অধিকার বলে? দুর্বলকে টার্গেট করা অনেক সোজা, কারণ এরা পুলিশ দিয়েও পেটাবে না, ভক্ত দিয়েও পেটাবে না। তার চেয়ে বরং প্রশ্ন করুন সবলদের, একসাথে… এক হয়ে।

প্রশ্ন করুন মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী ব্যানার্জিকে, যিনি বলেছিলেন, ক্ষমতায় এলে ডাবল ডাবল চাকরি দেবেন। তা চাকরিগুলো গেল কই? দিনের পর দিন যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের কেন রাস্তায় বসে থাকতে হচ্ছে? কেন রাজ্যের সরকারী কোষাগার থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করে, দুর্নীতিবাজদের আড়াল করার চেষ্টা চলছে? কেন তিনি দুর্নীতিকে জাস্টিফাই করতে সুভাষ বোসকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার চেষ্টা করলেন?

প্রশ্ন করুন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুকে, যিনি বলেছিলেন, “তৃণমূলের ছেলেরাই চাকরি পাবে, কিভাবে পাবে তা বলব না।”

প্রশ্ন করুন কালনার প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক এবং বর্তমান বিজেপি নেতা বিশ্বজিৎ কুণ্ডুকে, যিনি সংবাদমাধ্যমের সামনে বলেছিলেন, তিনি তার স্ত্রী এবং বৌদিসহ ৬২ জনকে চাকরি দিয়েছেন।

প্রশ্ন করুন বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্যকে যিনি বিশ্বজিৎ কুণ্ডুর স্বীকারোক্তির পর ওনাকে সততার প্রতীক হিসেবে ব্যক্ত করেছিলেন।

প্রশ্ন করুন সিবিআইকে, যারা কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ৬২ জনকে চাকরি দেওয়া বিশ্বজিৎ কুণ্ডুকে একবারের জন্যেও ডাকেননি?

প্রশ্ন করুন জাস্টিস অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়কে, যাদের নিয়োগ বেআইনিভাবে হয়েছে, তাদের ধরে ধরে কেন জানতে চাওয়া হচ্ছে না, কার বা কাদের আশীর্বাদে তারা বেআইনি চাকরি পেয়েছিলেন?

প্রশ্ন করুন এসএফআই নেতা সৃজন ভট্টাচার্য, প্রতিকুর রহমানকে, যখন শাসক দলের নিয়োগ দুর্নীতিতে হাঁসফাঁস অবস্থা, তখন তারা কেন এসব ভুলে বিশ্বকাপ জ্বরে আক্রান্ত হয়ে নানা বিদেশী জার্সি পড়ে মিছিল করছিলেন?

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু থেকে বিজেপির বিশ্বজিৎ কুণ্ডু, শমীক ভট্টাচার্য হয়ে ছাত্রনেতা সৃজন, প্রতিকুর, এদের তো আমরা নেতা বলেই জানি। কিন্তু এগুলো কি নেতাদের কাজ হতে পারে? তাহলে কি এমন ভেবে নেওয়া যায়, যাদের ঘরে ভাতের অভাব নেই, তারা ফুটানি করে বেড়াতেই পারে? প্রশ্ন রইল।

বেআইনি চাকুরীজীবীদের চাকরি যাবেই। তাই মারার ওপর খাড়ার ঘা মেরে হবে আর কি, তার চেয়ে এটা খুঁজে বার করুন, তাদের কারা মারলো? কারা তাদের সব পথ বন্ধ করে, তাদের দুনম্বরী পথ বেছে নিতে বাধ্য করল। সেই দুর্নীতিবাজদের প্রত্যেককে খুঁজে বের করতে না পারলে, অদূর ভবিষ্যতে আরো অনেকে মরবে। সে কাশ্মীরের আতিফ হোক বা চাকরি না পেয়ে আত্মঘাতী হওয়া মুর্শিদাবাদের বাবু দলুই হোক বা লোকলজ্জার ভয়ে আত্মঘাতী হওয়া বেআইনি শিক্ষিকা নন্দীগ্রামের টুম্পারানী হোক।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস