হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট এবং কিছু জরুরি প্রশ্ন / The Hindenburg Files

হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট সামনে আসবার পর থেকে গত কয়েকদিন দারুণ হইচই চলছে চারিদিকে। সমাজমাধ্যমে মুহুর্মুহু পোষ্ট আসছে। ঘুরছে মিম। ‘ট্রোল’রা নেমে পড়েছে কোমর বেঁধে। রাস্তাঘাটে বা চায়ের ঠেকেও বিশেষজ্ঞ মতামতের ছড়াছড়ি-লড়ালড়ি চলছে। আর আমরা সেই হট্টগোলের মূল সুরটা খুঁজতে গিয়ে পেলাম মাত্র তিনটে লাইন। এক, আদানী ডুবছে। দুই, স্টেট ব্যাঙ্ক আর জীবন বিমা কর্পোরেশনেরও এতে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হতে চলেছে। ডুবে যেতে পারে। তিন, ২০২৪-এ বিজেপি ফিরছে না। ইতিউতি দু একজন আদানীর ওপর এই আক্রমণ আসলে পৃথিবীর আর্থ-সামাজিক মানচিত্রে ভারতের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে ঈর্শাণ্বিত পশ্চিমী দুনিয়ার চক্রান্ত বলে অভিহিত করতে চাইলেও, সেভাবে খেই পাচ্ছে না।

এখন আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস আম জনতার এমন মেছো বাজারে ঘুরে এসে যে কথা গুলো বলবো, সেগুলো ‘সেকু-মাকু’ বা ‘সনাতনী কাকু’, কারোরই মনঃপূত হবে না। কিন্তু তাও যা সত্যি, সেটা তো বলতেই হবে।

স্পষ্ট কথায় কষ্ট নেই। তাই প্রথমেই বলতে চাই, আদানী গ্রুপ ডুববে না। শেয়ারের দাম ওঠা নামা হয়! আপার সার্কিট-লোয়ার সার্কিট লাগে। আর যাঁরা আদানী গ্রুপ অফ কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার, তাঁরা সবাই এমন উত্থান-পতনে অভ্যস্ত! কারণ মাসের মধ্যে এক-দুদিন আদানী গ্রুপের কোন না কোন শেয়ারে সার্কিট লাগেই। তাই আমাদের ধারণা দু-একদিনের মধ্যেই আদানী গ্রুপের সাতটি লিস্টেড কোম্পানির শেয়ারে স্থিতাবস্থা চলে আসবে। এমনটাই হয়ে থাকে। হ্যাঁ, তাতে হয়তো কয়েক লক্ষ ক্ষুদ্র শেয়ারহোল্ডারের আর্থিক ক্ষতি হবে ঠিকই, তবে তাঁরা যদি একটু ধরে ব্যাট করতে পারেন, তাহলে তাও হবে না। তবে এর মধ্যে একটা ছোট্ট ‘যদি’ আছে! ‘সেবি’র মত নিয়ামক সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট পড়ে যদি আদানী গ্রুপের বিরুদ্ধে কোন নতুন তদন্ত শুরু করে, তাহলে কিন্তু আদানী গ্রুপের কোম্পানিগুলির শেয়ারের দামে আরও বেশ কিছুটা পতন আটকানো মুশকিল! যদিও তাতেও আদানী গ্রুপ ডুবে যাবে, এমনটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না! যদি ‘সেবি’ বা অন্য কোন কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত করে এবং তাতে আদানী গ্রুপ যদি দোষী সাব্যস্ত হয়, তবেই ডুবে যাওয়ার একটা ক্ষীণ আশঙ্কা আছে! কিন্তু আপাতত সেবি বা কেন্দ্রীয় সরকার আদানী গ্রুপের বিরুদ্ধে তেমন কোন তদন্তমূলক পদক্ষেপ নেবে বলে এখনও জানায়নি।

এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, বিশিষ্ট সাংবাদিক সুচেতা দালাল, পরাঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা ও রবি নায়ার এর আগে দফায়-দফায় আদানী দের বিরুদ্ধে একই রকমের অনিয়মের অভিযোগ এনেছিলেন। তাতে সেসময় সরকার বা প্রশাসনের তরফে আদানীদের বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নেওয়া তো হয়ইনি, উল্টে ঐ সমস্ত সাংবাদিকরা রাজরোষের মুখে পড়েছিলেন। একের পর এক মামলায় জড়িয়ে দিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটিয়ে মারা থেকে জেলযাত্রা, সমস্ত রকম দুর্ভোগই তাদের ভোগ করতে হয়েছে! আর সেসব দিনগুলোতেও শেয়ার বাজারে আদানী গ্রুপের রক্তক্ষরণ হয়েছিল এবং সেটা ছিল সাময়িক কয়েকদিনের জন্য। তারপর যে কে সেই! প্রথমে স্থিতাবস্থা এবং তারপর উল্কাসম উর্ধ্বগতি! তাই না আদানী বিশ্বের তৃতীয় ধনীতম ব্যক্তি হয়েছিলেন! সত্যি কথা বলতে কি, আমাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তবে বলবো হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট নতুন কথা প্রায় কিছুই বলেনি। তাঁরা এদ্দিন ধরে উঠে আসা একগুচ্ছ অনিয়মের অভিযোগকেই একটি সুসংহত রিপোর্টের আকারে প্রকাশ করেছে মাত্র! আর যেহেতু সংস্থাটি আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের, তাই তার একটা গ্লোবাল বা বিশ্বজনীন আবেদন তৈরি হয়েছে! সুচেতা-রবি-পরাঞ্জয়রা নেহাতই ঘরের মুরগী, তাই পাত্তা পায়নি! সামান্য দিশি ডাল খেয়ে কেউ তৃপ্তির ঢেঁকুড় তোলে নাকি! কিন্তু ঐ যে বললাম, যতই গ্লোবাল আবেদন তৈরি হোক, সেবি বা কোন তদন্তকারী সংস্থা যতক্ষণ না পদক্ষেপ করছে, ততক্ষন আদানী ও ডুবছে না, ফলে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে আদানীদের কর্পোরেট অনুদান চলতেই থাকবে। আর সেই টাকায় ফুলে ফেঁপে ওঠা বিজেপিও ২০২৪-এ এত সহজে হারছে না। মানে প্রতিবেদনের শুরুতেই যে তিনটে লাইন পাওয়ার কথা বলছিলাম তার দুটো সরাসরি নাকচ হয়ে গেল।

এবার আসি বাকি থাকা স্টেট ব্যাঙ্ক ও জীবন বিমা সংক্রান্ত লাইনটায়। আপনারা মানুন বা না মানুন, যা বাস্তব তা হলো, আদানী গ্রুপ যদি ডুবেও যায় তাতে এলআইসি বা স্টেট ব্যাঙ্কের তেমন কোন সঙ্কট নেই, আর তাদের ডুবে যাওয়ার তো কোন সম্ভাবনাই নেই। কারণ এই দুই সংস্থারই আদানী গ্রুপে বিনিয়োগ তাদের মোট বিনিয়োগের ১ শতাংশেরও কম। শুধু সেই ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে আপনাকে আমাকে এদের থেকে ঋণ নিলে কিছু অতিরিক্ত সুদ গুনতে হবে। আর এদের কাছে আমাদের যদি কোন গচ্ছিত টাকা পয়সা বা বিনিয়োগ থাকে, তার ওপর আমরা সুদ বা রিটার্ন পাবো কিছুটা কম, এই যা! তাতে এমন কিছু মহাভারত অশুদ্ধ হবে না! কারণ মোদী জমানার বিগত আট বছরে ভারতীয় ব্যাঙ্কগুলি ১২ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ পাকাপাকিভাবে ‘মায়ের ভোগে’ পাঠিয়ে দিয়েছে যাকে ব্যাঙ্কিং পরিভাষায় বলে ‘রাইট অফ’ এবং তারপরও আমি, আপনি, ব্যাঙ্ক গুলো এবং আমাদের দেশ, সবাই দিব্যি আছে!

সেখানে এখন আদানী গ্রুপে আমাদের দেশের ব্যাঙ্ক ও বিমা কোম্পানি গুলির মোট বিনিয়োগ ১ লক্ষ কোটি টাকার আশপাশে, যার একটা বড় অংশ ঋণ হওয়ায় অ্যাসেট ও ক্যাশ ফ্লো দ্বারা সুরক্ষিত। তাই পুরোটাই মার যাওয়ার সম্ভাবনা কম। তবুও তর্কের খাতিরে যদি ধরে নি আদানী গ্রুপ ডুবে গেল সেক্ষেত্রে দেশের ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থা গুলির সর্বোচ্চ ক্ষতির পরিমাণ ঐ ১ লক্ষ কোটি টাকাই। যে দেশের মানুষ আচ্ছে দিনের আশায় মশগুল হয়ে ১২ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মুকুব হাসিমুখে ভরপাই করতে পারে তাদের কাছে এই ১ লক্ষ কোটি টাকা তো নস্যি! কাজেই আদানী গ্রুপ ডুবতে বসেছে বলে আম-জনতা গুলতালি যতটা করছে বাস্তবে তার প্রতিক্রিয়া হবে অনেক কম। তাই যেসব মোদি বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট পড়ে আদানী শেষ, এসবিআই/এলআইসি সঙ্কটে আর তাই ২৪-এ মোদী যাচ্ছেই ভেবে চারিদিকে ক্যানেস্তারা পেটাচ্ছেন তাঁরা আদৌ মাটিতে পা-রেখে চলেন না। উল্টে অচিরেই মানুষ যখন দেখবে এর একটিও ঘটছে না তখন এঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তৈরি হবে!

বরং তার জায়গায় পারলে এই জরুরি প্রশ্নগুলো করুন!

এ কেমন চৌকিদার যে কি না আদানীদের বিরুদ্ধে দেশ ও বিদেশের মাটিতে হাজারো অভিযোগ ওঠবার পরেও স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে তদন্তের নির্দেশ দেয় না! তবে কি চৌকিদার চোর ধরতে আগ্রহী নয়! কিসের স্বার্থ তার!

‘সেবি’র মত স্বতন্ত্র নিয়ামক সংস্থাই বা চুপ করে ঘাপটি মেরে বসে থাকে কি করে!

দেশের ব্যাঙ্ক ও বিমা সংস্থাগুলোই বা কি রকম ‘ছানবিন’ করে ঋণ দিল আদানীদের! আদৌ তারা সবকিছু ঠিকঠাক খতিয়ে দেখেছিল কি!

সংবাদমাধ্যমের আলোচনাতেও কেন এই দুর্নীতির তদন্তের জোরালো দাবী উঠছে না! আসলে আমাদের দেশের সংবাদমাধ্যম যদি দৃঢ়ভাবে সুচেতা-পরাঞ্জয়-রবিদের মত সাহসী সাংবাদিকদের পাশে দাঁড়াত তাহলে আমাদেরকে হিন্ডেনবার্গের মত ‘পশ্চিমী বিদেশী’ শক্তির মুখাপেক্ষীও হতে হতো না। আপনারা একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারবেন, অন্য যে কোন উন্নত দেশে কোন কোম্পানির বিরুদ্ধে এই ধরণের গুরুতর অভিযোগ উঠলে, সংবাদমাধ্যমের চাপে কিন্তু এতদিনে সরকারী তদন্ত শুরু হয়ে যেত!

পরিশেষে আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস, মানুষের কথা বলি। মোদি-দিদি কি পারবে জিততে, কংগ্রেস অথবা বামেরা কি পারবে ফিরতে ইত্যাদি রাজনৈতিক কচকচানির বাইরে বেরিয়ে গণতন্ত্র ও আইনের শাসন রক্ষায় আসল ইস্যু বা প্রশ্ন গুলো তুলে ধরবার চেষ্টা করি! কখনও হয়তো পারি, কখনও আবার পারি না। কিন্তু চেষ্টা চালিয়ে যাই। আমাদের বিনীত অনুরোধ, সেই চেষ্টা’টার সঙ্গে থাকুন। ‘ঘর কা মুরগী’ হতে আমাদের কোন অসুবিধা নাই।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://thewire.in/business/modi-government-npas-loans-write-off-12-lakh-crore
b) https://hindenburgresearch.com/adani/