শ্রমকোড এবং ছাঁটাই / Mass Layoffs?

শ্রম আইন আসিতেছে, আর বেশি দিন নয়। একদিন ছুটির বিনিময়ে, একদিনের অতিরিক্ত শ্রম নেওয়া হবে আপনার কাছ থেকে। সাথে ২৪ ঘন্টায় ৩ শিফটে চলা কারখানাগুলোতে দৈনিক ১২ ঘন্টা করে শ্রমদান করতে পারবে শ্রমিকরা। এমনটাই আসতে চলেছে দেশে, এই জুলাই মাসে।

একটা সাধারণ কারখানায় সাধারণভাবে একজন শ্রমিক সপ্তাহে ৬ দিন একটা ৮ ঘন্টা করে সর্বমোট ৪৮ ঘন্টা শ্রমদান করেন। যদিও অনেক ছোট খাটো কারখানায় প্রতিদিনের ৮ ঘন্টার শ্রম বেড়ে ১০-১২ ঘন্টাও হয়ে যায়, কোন রকম ওভারটাইম ছাড়াই। যেটা সম্পূর্ণ ভাবে বেআইনি হলেও, “যা চলছে চলুক, কি আর বলা যাবে”র চক্করে অনেকেই পেটের দায়ে চুপ করে থাকেন। আর সেই সুযোগটাই এত দিন মালিকপক্ষ নিয়ে আসত, এবার সরকারও সেই সুযোগ নিতে আসছে। আর মালিকপক্ষ, তারা আরো সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুনছেন।

কারখানায় ১০ টা পণ্য বেশি উৎপাদন হলে মালিকপক্ষ তা কখনোই বিলিয়ে দেয় না, তারা সেটা বিক্রি করে। আর শ্রমিকপক্ষ, তারা সপ্তাহে ১০ ঘন্টা অতিরিক্ত কাজ করেও, তাদের হকের ওভারটাইমের টাকা পাওয়ার জন্যে একটি বারও মুখ ফুটে বলেন না, হয়ত চাকরির অনিশ্চয়তার ভয়ে অথবা নিজেদের “সুলভ” হওয়ার ভয়ে।

অনিশ্চয়তা সবসময় থাকে তাও নয়, বসকে খুশি করতে এদেশের সুলভ শ্রমিক নিজের অধিকার কিভাবে বিলিয়ে দেন, তা কম বেশি আমরা সবাই কর্মক্ষেত্রে দেখি, খুব কমই মানুষ আছেন, যারা নিজের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন। এই ধরুন আইটির কোট-টাই পরা বাবুরা, এরা তো কখনো কখনো দিনে ১৪-১৬ ঘন্টাও ওভারটাইম ছাড়াই খেটে ফেলেন। ছেঁড়া জমা, কালি-ঝুলি মাখা শ্রমিকদের থেকে এদের অবস্থা শোচনীয় হলেও, “হায়ার অ্যান্ড ফায়ার”রের গেরোয় এদের মুখে “রা” ফোটে না।

আজ আমরা কয়েকটা সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ সমস্যার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করব, সেটা কর্মী ছাঁটাই। নতুন শ্রম আইনের প্রয়োগের ফলে, এমনটা কি হতে পারে! হ্যাঁ, পারে।

সাধারণভাবে ২৪ ঘন্টা চলা একটা কারখানায় শ্রমিকরা সপ্তাহে ৬ দিন ৮ ঘন্টা করে সর্বমোট ৪৮ ঘন্টা কাজ করেন। এক মাসে সাধারণভাবে কর্মদিবস থাকে ২৬ দিন। আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রেন্ডিং ইকোনমিক্সের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালে একজন শ্রমিক দৈনিক ৩৯৭ টাকা অথবা মাসিক ১০,৩২২ টাকা উপার্জন করেন।

আরো ভেঙে বললে, কর্মদিবসের প্রতি ঘন্টায় একজন শ্রমিকের আয় ৪৯.৬২ টাকা। বর্তমান শ্রম আইনে একজন শ্রমিক সর্বাধিক ৫০ ঘন্টা ওভারটাইম করতে পারেন, আর ওভারটাইমের মজুরি সাধারন মজুরির দ্বিগুণ হওয়াতে ৫০ ঘন্টায় একজন শ্রমিক আয় করবেন, ৪,৯৬২ টাকা। সেক্ষেত্রে সাধারণ সময় (মাসিক ২০৮ ঘন্টা বা ২৬ টি কর্মদিবস) এবং ওভারটাইমের পুরো সময় (৫০ ঘন্টা) কাজ করলে একজন শ্রমিক পেতে পারেন ১০,৩৩২+৪,৯৬২=১৫,২৯৪ টাকা। এক মাস হয় ৭২০ ঘন্টা, তার মধ্যে আইনগত ভাবে ২৫৮ ঘন্টা কাজ করলে হাজার পনেরো ঢুকবে একজন শ্রমিকের পকেটে।

এবার ধরুন একটা কারখানায় ৮ ঘন্টা করে ৩ শিফটে, মোট ১,২০০ শ্রমিক (প্রতি শিফটে ৪০০) কাজ করেন এবং সবাই একই বেতন পান। সেক্ষেত্রে কারখানার কেবল বেতন বাবদ খরচ ১,৮৩,৫৭,৬০০ টাকা। এটা বর্তমান শ্রম আইনের হিসেবে।

এবার নতুন শ্রম আইন, যদি একজন শ্রমিক ৮ ঘন্টায় দৈনিক ৩৯৭ টাকা উপার্জন করেন, তবে ১২ ঘন্টার কাজে সেই শ্রমিকের পাওয়া উচিৎ দৈনিক ৫৯৫ টাকা, বা বর্তমান মজুরির ২৫% বেশি। তবে যেটুকু আমরা শুনেছি, লকডাউনের পরে অনেক কারখানাতেই ১২ ঘন্টা করে কাজ শুরু হয়েছিল, যাতে দৈনিক মজুরি এক টাকাও বাড়েনি অনেক কারখানায়। পেটের দায়ে তা মেনেও নিয়েছিলেন অনেকে। এখানে আমরা ধরে নিচ্ছি, সবার ঘন্টাভিত্তিক মজুরি বাড়তে চলেছে।

তাহলে অঙ্ক বলছে একদিন অতিরিক্ত ছুটি নিয়ে সপ্তাহে ৫ দিনে ১২ ঘন্টা করে (মাসিক ২৬৪ ঘন্টা বা ২২টি কর্মদিবস) কাজ করলে, একজন শ্রমিক আয় করবেন : ৫৯৫x২২= ১৩,০৯০ টাকা।

বর্তমান আইনে ওভারটাইম নিয়ে মাসিক ২৫৮ ঘন্টা খেটে আপনি নূন্যতম আয় করেন, ১৫,২৯৮ টাকা, নতুন আইনে ওভারটাইমের ডাবল টাকা পেতে আপনাকে আগে ২৬৪ খাটতে হবে, আর তাতে আয় হবে ১৩,০৯০ টাকা। অর্থাৎ বর্তমানে ওভারটাইমসহ যা পেতেন তার ৬ ঘন্টা বেশি কাজ করলে আপনি ২,২০৮ টাকা কম পাবেন। এবার আসি ওভারটাইমে।

নতুন শ্রম আইন অনুযায়ী আপনি মাসে ১২৫ ঘন্টা ওভারটাইম করতে পারেন, এবং আপনি পুরো ওভারটাইম করলে আপনি উপার্জন করবেন, ১২,৪০৫ টাকা। অর্থাৎ, আপনি এক্ষেত্রে মাসিক ৩৮৯ ঘন্টা কাজ করে উপার্জন করবেন : ১৩,০৯০+১২,৪০৫=২৫,৪৯৫। আর ফাঁদ ঠিক এখানেই।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ১৫,২৯৮ টাকার থেকে ২৫,৪৯৫ টাকা অনেকটাই বেশি, কিন্তু এতটা স্বেচ্ছাশ্রম বা ওভারটাইম করা কি সত্যি সম্ভব? ১২৫ ঘন্টা ওভারটাইম মানে ১২ ঘন্টা করে ১০ টা দিন এবং আরো ৫ ঘন্টা। নতুন শ্রম আইনে আপনার ছুটি ৪ থেকে ৮ হলেও, পুরো ওভারটাইমের টাকা তুলতে আপনাকে মাসের ৩০ দিন কাজ করলেও যথেষ্ট নয়। কারণ সেক্ষেত্রে ১২ ঘন্টা করে হচ্ছে ৩৬০ ঘন্টা, এর পরেও পরে থাকে ২৯ ঘন্টা। মানে মাসের প্রতিদিন ছুটিহীন ভাবে ১৩ ঘন্টা কাজ করলে, আপনি ওভারটাইমের সম্পূর্ণ ফায়দা পাবেন। ধরে নিলাম এটা সবাই করতে পারবেন।

এবার আসি শিফটে। ২৪ ঘন্টা চলা কারখানায় এতদিন ৮ ঘন্টা করে ৩ খানা শিফট হত, কিন্তু কর্মদিবস ১২ ঘন্টা হয়ে গেলে, দুটো শিফটেই ২৪ ঘন্টা হয়ে যাবে, তৃতীয় শিফটের কোন প্রয়োজনীয়তা থাকবে না।

আগেই আমরা যে কাল্পনিক কারখানা ধরে উদাহরণ দিচ্ছিলাম, তাতে বলা ছিল ১২০০ শ্রমিকের কারখানায় ৪০০ লোক নিয়ে ৩ টি শিফট হয়। যদি নতুন শ্রম আইনের প্রয়োগ আপনার কারখানায় চালু হয়, তবে সহজ হিসেবে ৪০০ শ্রমিকের চাকরিতে কোপ পরার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়, কারণ কোনো কারখানা কর্তৃপক্ষ কোনো শ্রমিককে বসিয়ে মজুরি দেবে না। অর্থাৎ, প্রতি ৩ জন শ্রমিকের মধ্যে ১ জনের চাকরি চলে যেতে পারে। আপনি যদি কারখানায় কাজ করেন, তবে সেই লোকটি আপনার হওয়ার সম্ভাবনা ৩৩.৩৩%।

কারণ ১২ ঘন্টা ৮০০ শ্রমিককে নূন্যতম মজুরি দিতে কারখানা কর্তৃপক্ষের খরচ হবে, ১,০৪,৭২,০০০ টাকা। অর্থাৎ নতুন শ্রম আইন চালু হলে বর্তমানের চেয়ে কারখানার সাশ্রয় হবে প্রায় ৮০,০০,০০০ টাকা। সরকারের তরফে এমন বাম্পার অফার কি কারখানা কর্তৃপক্ষ ছাড়বে? আর আপনাকে দিয়ে যদি কতৃপক্ষ ১০ ঘন্টা কাজ করায়, তবে তো তাদের পোয়া বারো, শ্রমিকদের একদিনের অতিরিক্ত ছুটিও দিতে হবে না। তবে আজকের দিনেও, অর্থাৎ শ্রম আইন প্রয়োগের আগে থেকেই, অনেক অফিস, কারখানায় ১০-১২-১৪ ঘন্টাও কাজ হয়ে চলেছে। তা নিয়ে শ্রমিক বা কর্মচারীদের অনেকক্ষেত্রে একটুও অভিযোগ পর্যন্ত নেই, যদি চাকরি চলে যায় সেই ভয়ে। আর মানুষ ভয়কে সম্বল করলেই তো শাসক একুশে আইন চালাবে। এটাই বাস্তব। সবাই একত্রিত হয়ে পেন ডাউন করলে, শাসক থেকে মালিক, সে যেই হোক, শ্রমিক-কর্মচারীদের ন্যায্য অধিকার দিতে বাধ্য।

ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেনের মত সমাজতান্ত্রিক পশ্চিমী দেশগুলোতে এখন কর্মদিবস ৬ ঘন্টায় নেমে এসেছে, যার ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে মানুষের গড় আয়। উন্নতি হয়েছে কর্মচারী-শ্রমিকদের দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের। তাই আজ তারা গ্লোবাল হ্যাপিনেস ইনডেক্সে প্রথম দশে।

“নানা ভাষা নানা মত নানা পরিধান
বিবিধের মাঝে দেখ মিলন মহান”।

অনেক ভাষা, অনেক জাতি, অনেক রক্ত জল করা ঘাম, অনেক মতের পূর্ণাঙ্গ ইউনিয়ন হল এই গনতন্ত্র। যার মূল ভিত্তি কৃষক, শ্রমিক, কর্মচারী। কিন্তু হায়, তাদের অধিকাংশই আজ নিজের অধিকারবোধ সম্বন্ধে নীরব, হয়ত পেটের দায়ে। তাদের কি আর দোষ! সেই সুযোগে বিশ্বের বৃহত্তম গনতন্ত্রকে আইনগত ভাবে দৈনিক ১২ ঘন্টা কাজের নিদান দেওয়া হয়েছে। ফলস্বরূপ, গ্লোবাল হ্যাপিনেস ইনডেক্সে আমাদের দেশে ১৪৬ দেশের মধ্যে ১৩৬ নম্বরে। বাহ্ রে গণতন্ত্র, বাহ্।

পরিশেষে একটা কথাই মনে করিয়ে দিই, অধিকার কোনদিন উপহার হিসেবে আসেনি আর আসবেও না।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস