বিক্ষোভ করে কি হবে? / Why Protest Needed?

পশ্চিমবঙ্গে এখন যেকোন বিক্ষোভ সমাবেশ হলেই একটা প্রশ্ন বারবার ওঠে, “বিক্ষোভ, আন্দোলন, কর্মনাশা বনধ করে হবে কি?” ঠিক, চিন্তার বিষয়। এসব করে আদৌ কিছু হবে কি?

বিগত কয়েক দিনে বেশ কিছু আন্দোলন আছড়ে পড়েছে কলকাতার রাজপথে। কখনো ছাত্রছাত্রীরা স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় অবিলম্বে খোলার দাবিতে রাজপথে সরব হয়েছেন, কখনো চাকরিপ্রার্থীরা ন্যায্য চাকরির দাবিতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন, কখনো বন্ধ চটকল খোলার দাবিতে শ্রমিকরা রাজভবনের গেটে অবস্থান করেছেন। আবার কখনো অ্যাপ ক্যাবচালকরা নেমেছেন রাস্তায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ আংশিক বা পূর্ণ অধিকার আদায় করতে পেরেছেন, কেউ এখনো অধিকারের জন্যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

কিন্তু বিক্ষোভকারীদের নিজের নিজের ক্ষেত্রে সমস্যার জন্যে, সাধারণ মানুষের কি আর আসে যায়? শুধু শুধু পাবলিকের ভোগান্তি। ঠিক এমনই ভেবে থাকেন অনেকে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমনই ভাবানো হয়।

স্কুল কলেজ বহুদিন বন্ধ থাকাতে, ভীষণ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল পড়ুয়ারা। মেলা, ফাংশন, উদযাপন থেকে খেলা সব চলছে, কিন্তু স্কুল কলেজ বন্ধ। এটা মেনে নিতে পারেননি অনেকেই। তাই ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হচ্ছিল সমাজের সর্বস্তরে, কোথাও ছোটখাটো বিক্ষোভ, অবস্থানসহ অন্যান্য কর্মসূচিও চলছিল, আবার কোথাও স্থানীয় গণউদ্যোগে পাড়ায় পাড়ায় পড়ুয়াদের ক্লাসও চালু হয়ে গিয়েছিল। তবে তা বৃহৎ ও সঙ্গবদ্ধ প্রতিবাদের জন্যে যথেষ্ট ছিল না। অবশেষে জানুয়ারির ৩১ তারিখ, সর্বশক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের দিকে দিকে ছাত্র যুবরা নামল রাস্তায়। আর তারপর, বেশ কিছু পড়ুয়া আজ আবার স্কুল যাচ্ছে, বন্ধুদের সাথে মনের কথা ভাগ করে নিতে পারছে। একটা স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলন আংশিক হলেও ছিনিয়ে এনেছে দেশের সংবিধান স্বীকৃত শিক্ষার হক বা অধিকার।

তার পরেও বলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে ছাত্রছাত্রী থেকে অভিভাবকের সংখ্যা যত, তার ০.০১% মানুষ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন এই আন্দোলনে। ছিলেন কিছু ছাত্রছাত্রী, অভিভাবক এবং অন্যান্য সমব্যাথীরা।

যারা গিয়েছিলেন, তাদেরকে হয়তো অনেকেই বলেছিলেন, “বেশ তো আছো, এসব বিক্ষোভ করে হবে কি?” অথবা “পুলিশ পেটাবে, আর জেলে টেনে নিয়ে গেলে তো ভবিষ্যৎ খারাপ হয়ে যাবে।” অথবা “যেমন চলছে, সেভাবেই থাকো। স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা না করাই ভালো। “

ঠিক এমনটাই শুনতে হয়েছিল, সেই চাকরিপ্রার্থীদের, যাদের নিয়োগ তালিকায় নাম আসার পরেও নিয়োগ হচ্ছিল না। এমনটাই হয়তো শুনতে হয়েছিলো সেই শ্রমিকদের, যারা তাদের হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া চটকল খোলার দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন রাজভবনের গেটে। এই এক কথা প্রিয়জনের কাছে শুনতে হয়েছিল সেই অ্যাপ ক্যাব চালকদের, যারা ট্রাফিক জরিমানার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণে রাস্তায় নেমেছিলেন।

এরা জানতেন, বিক্ষোভ চলাকালীন এদের হয়তো পুলিশের মার খেতে হতে পারে, কাউকে জেলে টেনে নিয়ে যাওয়া হতে পারে, কারো মাথা ফেটে যেতে পারে, হাত ভেঙে যেতে পারে, আবার মৃত্যুও হতে পারে মইদুল মিদ্দ্যার মতন। এরা শোনেনি শত বারণ, নিজের মত করে প্রস্তুত হয়ে, শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়েছিলেন রাজপথে, দিনের পর দিন চলতে থাকা অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে। চিৎকার করে বলেছিলন, “আমাদের” দাবি মানতেই হবে। নিজের একার কথা ভাবেননি ওরা। ভেবেছিলেন “ওদের” মত “অনেকের” কথা।

তাই আজ অষ্টম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর পড়ুয়ারা স্কুলে যাচ্ছে, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস খুলেছে। ডব্লিউবিসিএসের প্রিলির, গ্রুপ ডি-এর ফল প্রকাশ হয়েছে, সরকার নির্দেশ দিতে বাধ্য হয়েছে পিএসসি’র ফল দ্রুত প্রকাশ করার জন্যে। সবকটাতেই সাফল্য এসেছে বিক্ষোভ-আন্দোলনের হাত ধরে, যার সুফল পেয়েছেন লাখ লাখ পড়ুয়া, চাকরিপ্রার্থী।

তবে যে লক্ষাধিক মানুষ এই আন্দোলনের সুফল পেলেন, তারা সবাই কিন্তু রাস্তায় ছিলেন না। তবে তাদের সমর্থন করেছিলেন অনেকেই, সেই শুভেচ্ছাকে সম্বল করেই এগিয়ে গিয়েছিলেন কয়েকজন। আর এটাও ঠিক, বিক্ষোভের দিন রাস্তায় ছিলেন মাত্র ০.০১% মানুষ। এই ০.০১% মানুষ কোনোদিন প্রশ্ন তুলবেন না, “বিক্ষোভ করে কি হবে?” কারণ এরা জানেন বিক্ষোভ করে কি হয়।

তাহলে কারা বলবেন, বিক্ষোভ আন্দোলন করে কিস্যু হয় না!

বলবেন তারা, যারা এই আন্দোলন করা মানুষগুলোকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন, “এসব করে কিছু হবে না”, “সুখে থাকতে, ভুতে কিলায়”, “সিস্টেমের বিরুদ্ধে যাওয়া উচিৎ নয়” ইত্যাদি বলে।বলবেন তারা, যারা অনিয়ম দেখে চুপ করে ছিলেন, যাদের সাহস ছিল না, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার। তাই এরা নির্দ্বিধায় বলতে পারেন, বিক্ষোভ আন্দোলন করে কিস্যু হয় না।

তাই বলে কি অধিকারের দাবির তীব্র আওয়াজ বন্ধ হতে পারে? না পারে না। অনেকেই বিভিন্ন কারণে নীরব থাকতে পারেন, সেটা তাদের গনতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু আন্দোলন করে অধিকার ছিনিয়ে আনা মানুষগুলো তো আর থামতে জানে না, তাদের দেখে উজ্জীবিত মানুষেরা তো থামতে জানে না। কারণ এরা জানে, হকের দাবি উপহার হিসেবে আসবে না, হক আদায় করে নিতে হবে। আর এটাও গনতান্ত্রিক অধিকার।

তাই নির্দ্বিধায় এটা বলা যায়, “হয়, বিক্ষোভ আন্দোলন করে অনেক কিছু হয়। অনেক কিছু হয়েছে, অনেক কিছু হচ্ছে এবং অনেক কিছু হবে।”

টিম রাইজ অফ ভয়েসেসের তরফ থেকে শুভেচ্ছা রইল, সেই সব মানুষদের, যারা রাস্তায় নেমেছিলেন বা এখনো রাস্তাতেই আছেন লক্ষ কোটি মানুষের হকের দাবি নিয়ে। হকের দাবির জন্যে যেভাবে আপনারা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন, আমাদের কলমও আপনাদের সাথেই একসাথে এগিয়ে চলবে।

আপনাদের আওয়াজ, আমাদের কলম। কলম চলবে।