চটকলে পড়ছে খিল / Jute Mills Shutting Down

এই মুহূর্তে বাংলার মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম গুলিতে ট্রেন্ডিং নিউজ হল গানওয়ালাবাবুর খিস্তি, লাটসাহেবকে মাননীয়ার ট্যুইটারে ব্লক করে দেওয়া আর নামী চিত্রতারকার বিয়ের মেনুতে জিভে জল আনা টার্কি বা ভেড়ার পদ।

এদিকে রাজ্যে বন্ধ হয়ে গেছে একটা একটা করে চৌদ্দটা চটকল। আরও কয়েকটা প্রহর গুনছে। তা নিয়ে ঘন্টাবাবু থেকে অগ্নিবাবু, কারো কোনো হেলদোল নেই। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ পাঁচটা জুটমিলও বন্ধ। কেন বন্ধ অথবা কারখানার লেখাপড়া না জানা গায়ে-গতরে খাটা মানুষগুলো কেমন আছে, এসব কেউ জানায় না। এসব দেখানো এখন বেশকিছু বছর হল বন্ধ আছে। দশ-পনেরো বছর আগে হলে, এই নিয়ে খবরওয়ালারা ভর সন্ধেবেলা সালিশি সভা অবশ্যই বসিয়ে দিত। কিন্তু আজ তার বদলে সরস্বতী পুজোর নষ্টালজিয়া! ভ্যালেন্টাইন ডে! যশরত-তৃনীলদের আগমনী! মাঝে অবশ্য এক-দুদিন বাজেট নিয়ে কিছু চিৎকার চেঁচামেচি হবে তবে তাও লোকদেখানো। কিন্তু জুটমিল লক আউট নিয়ে খবর নৈব নৈব চ! এমনিতেই সিঙ্গুরে আলু, ধান আর শসা চাষ করবো বলে শিল্পের পায়ে বেড়ি পরিয়ে এখন মাছের ভেড়ির গল্প সামনে আসতেই নম্বর কাটা গেছে! “সিঙ্গুরের সব মাছ একা মমতা কেন খাবে, লকেট-রাজনাথরা কেন পাবে না” তাই নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় জোর ট্রোলিং চলেছে! তারমধ্যে আবার জুটমিল বন্ধের খবর করে মরে আর কি! ভেতরের পাতায় ছোট্ট করে ছেপে হাতধুয়ে ফেলাই শ্রেয় বলে মনে করেছেন সংবাদ মাধ্যমের মহামহিম জ্যাঠা মামারা!

এমনিতে কাঁচাপাটের যোগান নিয়ে রয়েছে শাসক ঘনিষ্ঠ মজুতদার-ফড়েদের বিরুদ্ধে দেদার কালোবাজারীর অভিযোগ। এরজন্যেই কাঁচাপাটের দাম কুইন্টাল প্রতি ৭০০০ টাকা পেরিয়ে গেছে। যদিও পাটচাষীদের অভিযোগ তারা এই দাম পান না। উল্টে খবর রয়েছে সারের কালোবাজারির চোটে উত্তর ও মধ্য বঙ্গের বহু জেলার চাষীরা এবার তাদের সমস্ত জমিতে পাট চাষ করতে পারেন নি। ফলে আগামী দিনেও কাঁচাপাটের যোগান কম থাকবে। কাজেই কাঁচাপাটের দাম অদূর ভবিষ্যতে কম হওয়ার কোন জায়গা নেই। অবশ্য কোন জিনিষের দাম কমে আজকাল সেটাও একটা প্রশ্ন!

এদিকে কেন্দ্রীয় সরকার কাঁচাপাটের কুইন্টাল প্রতি দাম দেয় ৬৫০০ টাকা। ফলে চটকলের মালিকেরা লোকসান করে পাট কিনতে চাইছে না। মার খাচ্ছে উৎপাদন। চলছে লক আউট আর ছাঁটাই। অথচ রাজ্যের শাসকদলের তরফে সমস্যা সমাধানে তেমন কোন উদ্যোগ নেই। এদিকে লক আউট এবং উৎপাদন কমে যাওয়ায় চটের থলের যোগান কমেছে। আর তাই কেন্দ্রীয় সরকারও অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই খাদ্যশস্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে চটের বস্তার জন্য সংরক্ষিত কোটাতেও প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে দিয়েছে। ফলে চটকল মালিক এবং শ্রমিক দুইপক্ষই পড়েছে আতান্তরে।

দেদার লক আউট এবং ছাঁটাইএর পথে হাঁটতে বাধ্য হচ্ছেন চটকল মালিকরা। শ্রমিকদের মজুরি, বোনাস, ইএসআই এবং অবসরকালীন সুযোগ সুবিধা বাবদ কয়েকশো কোটি টাকা বাকি পড়েছে। কাজ হারিয়েছেন এই বাংলার প্রায় ৫৫ হাজার শ্রমিক। অথচ সামাজিক পরিসরের কোথাও টুঁ শব্দটি নেই। যদিও লাটসাহেবের দরজায় চটকল শ্রমিকেরা বিক্ষোভও দেখিয়েছেন! আমরা জানতে পারিনি! কারণ সংবাদমাধ্যম লাটসাহেবের ট্যুইটার অ্যাকাউন্টে “তাক” করে বসে আছে! রাজভবনের দরজার দিকে তাকাবার সময় নেই! এসব ছোটলোক মুটে-মজুরদের খবর আবার খবর নাকি! এমনকি সমস্যা মেটাবার জন্য জানুয়ারী মাসের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় বস্ত্রমন্ত্রীকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে বাম-ডান সব কটি চটকল শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে । কিন্তু সেদিক থেকেও তেমন কোন সদুত্তর আসে নি। দায় চাপানো হয়েছে বেআইনি মজুতদারির দিকে। মানে “ল এন্ড অর্ডার স্টেট সাবজেক্ট” । বেআইনি মজুতদারি ঠেকানো রাজ্য সরকারের দায়। এতে কেন্দ্রের কোন ভূমিকা নেই। অথচ এই সরকারই বিতর্কিত কৃষি আইনের মাধ্যমে অত্যবশ্যকীয় পণ্য আইন শিথিল করে মজুতদারির কথা বলেছিল!

এখন এই কাজ হারানো চটকল শ্রমিকেরা কার দরজায় যাবেন বুঝতে পারছেন না! ওদের তো কোন ট্যুইটার অ্যাকাউন্ট নেই! নেই ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম! ওদের পাতের ডাল-ভাত-নুন-লঙ্কার ছবি বা খবরের মধ্যে না আছে নান্দনিকতা না আছে টিআরপি!

তাই রাইজ অফ ভয়েসেস এসেছে আপনাদের দরজায়। যদি আপনারা একটু মুখ তুলে তাকান! যদি মুখ খোলেন ওদের হয়ে! প্রশাসন মিডিয়াকে বাধ্য করেন এব্যাপারে নজর দিতে। ওদের রোজকার জীবনটাই থেমে যাওয়ার পথে। আগামী ১১ই ফ্রেব্রুয়ারী কিছুটা নিরুপায় হয়েই ওনারা রেল ও পথ অবরোধ করবেন বলে ঠিক করেছেন! তখন তো আমার-আপনার অফিস যেতে অসুবিধে হবে। মিডিয়ার জ্যাঠা-মামাদের প্ররোচনায় ওদেরকে “চীনের দালাল”, “ইউনিয়নবাজ” ইত্যাদি বলে, আমরাই গাল দেবো! তাই তার আগে আমাদের মনে হল সত্যিটা আপনাদের সামনে তুলে ধরা জরুরি।

আর পরিশেষে মনে রাখবেন এই লেখাপড়া না-জানা “ছোটলোক” মজুর-লেবার ক্লাসের লোকগুলোর কথা তুলে ধরবার মানুষের সংখ্যা ইদানীং বড্ড কম। কাজেই যদি মনে হয় এদের কথা তুলে ধরা উচিত, তাহলে এই পোষ্টটা লাইক করে থেমে যাবেন না অবশ্যই আপনার চেনা পরিচিতদের সাথে শেয়ার করবেন।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র

a) https://www.anandabazar.com/business/huge-jute-production-creates-problem-of-hoarding/cid/1305677
b) https://epaper.anandabazar.com/imageview_61170_4408875_4_71_29-01-2022_10_i_1_sf.html
c) https://theprint.in/economy/jute-unions-seek-union-ministers-intervention-to-save-industry-livelihood-of-workers/806738/
d) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-02-02/202202012301453.jpg&category=0&date=2022-02-02&button=