তছরুপ চলছে / CAG Report

লুঠ চলছে, লুঠ!

গত ২৫ মার্চ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ২০২০-২১ অর্থবর্ষের যে অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করেছে কম্পট্রোলার এন্ড অডিটর জেনারেল বা CAG, তা দেখলে প্রথম এটাই মনে হয়েছে আমাদের।

সেই রিপোর্ট অনুযায়ী গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যের কোষাগার থেকে এনজিওগুলিকে ২৭,০৪৮ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি ‘অন্যান্য’ খাতে খরচ করা হয়েছে ১০,৮৫৯ কোটি টাকা। সেখানে ঐ একই অর্থবর্ষে রাজ্যজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পৌরসংস্থা ও পুরনিগমগুলিকে অথবা পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে খরচা হয়েছে যথাক্রমে মাত্র ৫,১৬৬ কোটি এবং ১১,২৮৫ কোটি টাকা। এমনকি রাজ্যজুড়ে সরকার পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে দেওয়া হয়েছে ৮৪৪৭ কোটি টাকা। রাজ্যসরকারের আওতাধীণ রাষ্ট্রীয়সংস্থাগুলি পেয়েছে ১৭৯ কোটি টাকা এবং সমবায় ব্যবস্থার পেছনে খরচা করা হয়েছে নাম মাত্র ১৪৭ কোটি টাকা।

আর প্রশ্নটা উঠেছে এখানেই! আপনার আমার করের টাকায় এটা সরকার চলছে নাকি “এনজিও”! আর অন্যান্য খাতেই বা এত বিপুল ব্যয়ভার কেন যার পাশে পঞ্চায়েত বা পুরপ্রশাসনের মত গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরকেও শিশু বলে মনে হচ্ছে! সেইসঙ্গে বর্তমান সরকারের আমলে রাজ্যজুড়ে সমবায় ব্যবস্থা কেন ভেঙ্গে পড়েছে এবং কেন বাংলার প্রান্তিক মানুষকে ঋণের জন্য মাইক্রোফিন্যান্স বা মহজনদের খপ্পরে পড়তে হচ্ছে, তা এই খাতে নামমাত্র খরচার বহর দেখলেই বোঝা যায়। এমনকি রাজ্যসরকারের আওতাধীন বিভিন্ন রাষ্ট্রীয়সংস্থাগুলিকে পুনরুজ্জীবিত না করে, যে বেচে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হচ্ছে, তা এই খাতের নগণ্য সরকারী সাহায্যতেই স্পষ্ট। কার্যত আমাদের মনে হয়েছে সমবায় ও রাষ্ট্রায়ত্তসংস্থার পেছনে সরকার যে সামান্য পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেছে তা “অন্যান্য” খাতে হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল এবং অন্যান্য খাতের বিপুল অর্থ খরচা করা উচিৎ ছিল পঞ্চায়েত-পুরব্যবস্থার মত গুরুত্বপূর্ণ খাতে।

তাছাড়া এনজিও কে যে টাকা বিলি করা হয়েছে, তা এখনকার নিয়ম অনুযায়ী সরকারের কোনরকম নজরদারি বা অডিটের আওতায় পড়ে না। ফলে এনজিওগুলি নিজেদের ইচ্ছে মত সেই টাকা খরচ করতে পারে। কাজেই প্রশ্ন উঠেছে যে টাকার অডিট সরকার করতে পারবে না, সেই খাতে এমন বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে কার স্বার্থে! এমনকি ক্যাগ রিপোর্টেও এই বিষয়টা উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে “২০২০-২১ আর্থিক বর্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার আয়ের প্রায় ২৬.২৪ শতাংশ এমন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক সহায়তা বাবদ দিয়েছে, যাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য কোনো যথার্থ ব্যবস্থাপনা নেই সরকারের। আবার এই ২৬.২৪ শতাংশের ৮০.৯০ শতাংশ গেছে বিভিন্ন এনজিও এবং অন্যান্যদের কাছে। যারা সরকারের কাছে দায়বদ্ধই নয়। যারা অডিটের আওতাতেই আসেনা। এটা অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়।”

এখন আপনি যদি ভাবেন এটা একটি “বিচ্ছিন্ন” বা “ব্যতিক্রমী” ঘটনা, তাহলে ভুল ভাবছেন। এমনটা চলে আসছে বিগত প্রায় পাঁচ বছর ধরে। ক্যাগের রিপোর্ট অন্তত তাই বলছে। রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৬-২১ অর্থবর্ষে এনজিওগুলোকে সরকারি কোষাগার থেকে মোট ১ লক্ষ ৬ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। সূত্রের খবর, এই এনজিওগুলোর অধিকাংশই শাসক দলের নেতা-নেত্রীদের নামে রয়েছে। কাজেই এরপর আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না কিভাবে জেলায় জেলায় ব্লকে ব্লকে শাসক দলের ছোট-বড়-মাঝারি নেতারা তাদের প্রাসাদের মত বাড়িগুলি বানিয়েছেন বা বাড়িগুলির গ্যারাজে কিভাবে দামী দেশি-বিদেশী এসইউভির ছড়াছড়ি! এই বৈভবের উৎস শুধু কাটমানি আর তোলাবাজির টাকা নয়, সরকারের ঘরে জমা করা আপনার আমার করের টাকাও আছে এরমধ্যে, যা ঘুরপথে এনজিও হয়ে ঢুকছে শাসকদলের নেতাদের পকেটে।

আর তার থেকেও বড় প্রশ্ন, যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কথায় কথায় বিগত চৌত্রিশ বছরের বাম শাসনের সময়কার ২ লক্ষ কোটি টাকা ঋণের কথা স্মরণ করে গাল পাড়েন এবং বলে বেড়ান সেই ঋণের সুদ দিতেই নাকি সব টাকা চলে যাচ্ছে সেই তিনি কিভাবে গত পাঁচ বছরে এক লক্ষ কোটি টাকার ওপর এনজিও কে বিলিয়ে দেন এবং অন্যান্য খাতে ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচা করে ফেলেন!

কিন্তু রাজ্য সরকারের থেকে এসব প্রশ্নের উত্তর চাইবার দায়িত্ব মূলতঃ খাতায় কলমে রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল মানে বিজেপির এবং সংবাদমাধ্যমগুলির। কিন্তু ক্যাগ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে ২৫ শে মার্চ। তারপর এক সপ্তাহ অতিক্রান্ত! অথচ কোথাও এই ইস্যু নিয়ে টুঁ শব্দটি নেই।

এরও কারণটা বেশ স্পষ্ট! বিভিন্ন সূত্র মারফত আমরা যা খবর পাচ্ছি তা হল ক্যাগ রিপোর্টে যেহেতু বিগত পাঁচ বছরের হিসেব দিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, সেহেতু এই রিপোর্ট নিয়ে বেশি কাটাছেঁড়া হলে বেশ কিছু প্রথম সারির বিজেপি নেতাও বিপদে পড়বেন, কারণ আজকের বেশির ভাগ প্রথম সারির বিজেপি নেতাই বছর দুয়েক আগেও তৃণমূল করতেন। কাজেই বিজেপি চুপ। সেইসূত্র মেনে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ কাম বিজেপি বিধায়ক বাংলার প্রথমশ্রেণীর সংবাদপত্রে তৃণমূল সরকারের বাজেট নিয়ে পর্যালোচনা করে শিল্পনীতি পরিবর্তনের হয়ে যখন সওয়াল করেন, তখন এনজিওদের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে এমন বেহিসেবি সরকারী টাকা বিলি-বন্টনের অভিযোগ করতে ভুলে যান। খাতায়-কলমে মিডিয়ার সামনে এমন অপদার্থ ল্যাংচাখেকো বিরোধী পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার এটা তৃণমূল সরকারের নেতা-মন্ত্রীরাও জানেন। তাই এনারা এবং এঁদের স্থানীয়স্তরের পারিষদবর্গ চুরি-চামারিতে কাটমানি-তোলাবাজিতে এতটা বেপরোয়া হয়ে ঊঠেছে। কথায় কথায় বোম পড়ছে-গুলি চলছে। রাজ্যটা মাঝখান থেকে সমাজবিরোধীদের স্বর্গরাজ্য হয়ে উঠছে।

আর বাংলার মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যমগুলির শিরদাঁড়া বিক্রি হয়ে গেছে বহুদিন। এনারা এখন সরকারী “সাপোর্ট” নিয়ে “পজিটিভ” নিউজ করতে ব্যাস্ত। হয়ত ঠিক করে খুঁজলে এদের মাথাদের ঘনিষ্ঠদেরও খোঁজ পাওয়া যেতে পারে এই সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত এনজিওগুলির তালিকায়।

কাজেই ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো বলতে “রাইজ অফ ভয়েসেস” এর মত কিছু অনাম্নী প্ল্যাটফর্ম যাদেরকে এইসব অপ্রীতিকর প্রশ্ন সরকার বাহাদুরের সামনে তুলে ধরতে হচ্ছে। কিন্তু আমরা শুধু প্রশ্ন তুলে পালাচ্ছি না।

পাশাপাশি অবিলম্বে বিগত পাঁচ বছরে যে সমস্ত এনজিওগুলির মধ্যে সরকারী কোষাগার থেকে এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি অনুদান বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের নাম-ধাম সরকারের তরফে শ্বেতপত্রের আকারে প্রকাশ করবার দাবীও জানাচ্ছি।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র
a) https://www.peoplesreporter.in/news/news-from-state/wb-state-government-pays-rs-38000-crore-to-ngos-and-others-before-polls-cag-report
b) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-30/202203292330215.jpg&category=0&date=2022-03-30&button=
c) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-30/202203292333393.jpg&category=0&date=2022-03-30&button=
d) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-03-30/202203292254334.jpg&category=0&date=2022-03-30&button=