দুয়ারে দুর্নীতি / Yo! Corruption

আমরা হলাম গিয়ে সকালবেলা চা-বিস্কুট দিয়ে খবরের কাগজ পড়ে সবজান্তা বনে যাওয়া বাঙালী। সন্ধ্যেবেলা কাজের জায়গা থেকে ফিরে মুড়ি-চানাচুর-চা সহযোগে প্রাইম টাইমে চ্যানেল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খবরের নামে কলতলার ঝগড়া দেখা বাঙালী। আর তারপর দিনের শেষে যখন সব কিছু জেনে বুঝে বিছানায় পাশাপাশি গা এলিয়ে দিই, তখন আমাদের অনেকেরই দুচোখে ঘুম ছাড়াও ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় না পেয়ে, চোখে চোখ রেখে সীমানা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার একটা দুষ্টু-মিষ্টি ইচ্ছে বাসা বাঁধে।

সারাদিন ধরে “যারা কুকর্ম করে তাদের আমি ভালোবাসি না” গোছের একটা গোঙানী বুকের মধ্যে গুনগুন করলেও চুরি চিটিংবাজির কেসে জেলখাটা লেসার এভিল মুখপাত্র অথবা খামে ভরে তোয়ালে মুড়ে টাকা খাওয়া সনাতনীদের দেখলে, যে দিনে তেত্রিশ বার বত্রিশপাটি বেরিয়ে আসে সেটাও অস্বীকার করতে পারি না। বরং চোখে চোখ রেখে ফেললে কিম্বা হাতে হাত ঠেকলে সারা শরীরে কেমন জানি শিহরণ খেলে যায়

অবশ্য কেনই বা জাগবে না! কারণ এনাদেরকেই তো সারাদিন কাগজের পাতায়, টিভির পর্দায় অথবা মুঠোফোনের স্ক্রিন জুড়ে ভাসিয়ে রাখা হয়। আর কে না জানে যাদের কে কাগজে টিভিতে নিয়ে হইচই হয় তারা অবশ্যই একটা কেউকেটা! ছোটবেলা থেকে এই সারসত্যটাই আমরা জেনে এসেছি। কিন্তু ইদানীং যেন খবরের থেকে খবরে থাকা মানুষ গুলোকে নিয়ে আমরা একটু বেশি মাতামাতি করছি বলে আমাদের মনে হচ্ছে। কেন একথা বলছি দু-একটা উদাহরণ দিলেই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

যেমন ধরুণ জনৈক হিরের টুকরো যুব নেতাকে কয়লা পাচারের দায়ে সিবিআই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডাকছে। আপনাকে আমাকে ডাকলে আমরা কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে মাথা নীচু করে যেতাম। কিন্তু মিডিয়ার তরফে মুখপাত্রকে দিয়ে বলিয়ে বড় বড় হেডলাইন করা হল তিনি বাঘের বাচ্চা তাই নাকি জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিবিআই দপ্তরে গেলেন। আর আমরাও বাঘের বাচ্চা দেখব বলে টিভির সামনে। ভুলেই গেলাম চুরি জোচ্চুরি করায় ডাক পড়েছে।

অথবা ধরুন কোন এক নেতা পুলিশকে বোম মারবার নিদান দিলেন বা কেউ একজন বিরোধী দলের লোকজনদের ঊদ্দেশ্য করে বললেন বুকের ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দেব। এমনিতে এসব অকথা-কুকথা বাড়িতে বললে হালুয়া টাইট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। কিন্তু মিডিয়া আমাদের শিখিয়েছে এসব হল দাপুটে নেতার গুণ। দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যক্তিত্বরা এরকম বলে থাকেন। কাজেই আমাদের চোখে এঁরাই হলেন হিরো!

কিন্তু কেন সংবাদ মাধ্যমগুলি এরকম বলে! কি উদ্দেশ্য জানেন কি!

অনেক ভেবে আমরা দেখেছি এর একটা কারণ যদি হয় নিতান্তই ইতিবাচকতা বা পজিটিভিটি খোঁজবার দায়, তাহলে অন্য কারণটা হল মানুষের নজর ঘুরিয়ে দেওয়া। কি রকম ভাবে ব্যাপারটা হয় একটু শুনে নিন!

এই যখন আমি আপনি “কুকর্ম যারা করে তাদের আমি একদম ভালোবাসি না” য় মজে গিয়ে বাম আমলের ‘চাকরি চুরি’র চিরকুট দেখব বলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি, ঠিক তখনই রাজ্য প্রশাসনের সদর দপ্তরে চুপিচুপি ঘটে যাওয়া একটা কুকর্মের খবর সামনে এল, অথচ ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় না পাওয়া, কিম্বা সীমানা পার করে দিয়ে এগিয়ে রাখা কোন জ্যাঠা কাকারা আমাদের জানালো না পর্যন্ত!

কি ব্যাপার!

সম্প্রতি রাজ্য সরকার বিভিন্ন সরাকরি দপ্তরের কাজের তদারকি করবার জন্য একটি বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন কমিটি গঠন করেছেন। কিন্তু সেই কমিটির চেয়ারম্যান সরকারি সচিব পদমর্যাদার কোন অফিসারকে বা ক্যাবিনেট মন্ত্রীর সমান পদমর্যাদা দিয়ে কোন জনপ্রতিনিধিকে করলে ভালো হত। কিন্তু তা না করে সেই দায়িত্ব দেওয়া হল জনৈক কৌস্তভ রায় কে। কে তিনি! চেনেন এই কৌস্তভ রায়কে!

ইনি হলেন সেই ব্যক্তি যিনি ভুয়ো নথি জমা করে ৫১৫ কোট টাকার ব্যাঙ্ক প্রতারণার অভিযোগে সিবিআই এর হাতে গ্রেপ্তার হন এবং জেল খাটেন। এছাড়াও এর আরেকটি পরিচয় হল সরকার/শাসকের পেটোয়া টিভি চ্যানেল কলকাতা টিভির ইনি মালিক। আরও শুনবেন! আনিস খান হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দিতে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে রাতের অন্ধকারে আনিস খানের বাবা সেলিম খানের কাছে হাজির হয়েছিলেন বলে এনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। এমনকি সমাজ মাধ্যমে মধ্যরাতের সেই মিটিং এর ছবিও বেরিয়েছিল। এমনকি গতকালও ইনি নিজাম প্যালেসে ডাক পাওয়া প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর ছায়াসঙ্গী ছিলেন, যদিও নিরাপত্তা বাহিনী তাকে ভেতর পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দেয়নি।

এখন প্রশ্ন হল এরকম একজন জালিয়াতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি কিভাবে রাজ্য প্রশাসনের সর্বোচ্চ অলিন্দে মুক্তকচ্ছ হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে?

“যারা কুকর্ম করে তাদের আমি ভালোবাসি না” বলা নেত্রীর কেনই বা এত আস্থা এরকম একজন বিতর্কিত ব্যক্তির ওপর?

আর সব থেকে বড় কথা, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের কাজকর্মের দেখভাল-তদারকি করবেন একজন বেসরকারী মনোনীত ব্যক্তি! কেন! রাজ্যস্তরে দক্ষ অফিসার কি কম পড়িয়াছে?

এমনই কিছু অপ্রিয় একগুচ্ছ প্রশ্নের সদুত্তর প্রশাসনের কাছ থেকে এখনই না পেলে “কুকর্ম ভালোবাসি না” লাইনটা বেলাইন হয়ে পড়বে। চুরি-জালিয়াতি করে জেলখাটা ব্যক্তিদের সাথে শাসকের এত দহরম মহরম মোটেই কাজের কথা নয়। এমন একজনকে দলীয় মুখপাত্র বানিয়ে ইতিমধ্যেই যে মুখ পুড়েছে, লুঠের ভোটে সেই বার্তাটা ইভিএম মেশিনে প্রতিফলিত হয়নি বলেই কি ফের শাসকের তরফে এমন বেপরোয়া দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত?

জানতে চায় বাংলা।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসুত্র
a) https://www.sundayguardianlive.com/news/12987-bank-fraud-bengal-kolkata-s-shibaji-now-cashless-powerless
b) https://www.firstpost.com/india/cbi-arrests-rp-infosystems-directors-shivaji-panja-kaustav-roy-in-kolkata-bank-fraud-case-4391809.html
c) https://www.thestatesman.com/india/bengal-govt-appoints-tainted-businessman-chairman-key-committee-1503073991.html
d) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-05-20/202205192342353.jpg&category=0&date=2022-05-20&button=
e) http://bangla.ganashakti.co.in/Home/PopUp/?url=/admin/uploade/image_details/2022-05-20/202205200005156.jpg&category=0&date=2022-05-20&button=