আনিস হত্যা : পূর্ব পরিকল্পিত? / Pre-planned?

আনিস খানের হত্যাকান্ড একটি পূর্ব পরিকল্পিত ঘটনা।

কারণ যে চার মূর্তিমান, পুলিশ ও সিভিক পুলিশের বেশে, রাত একটার সময় আনিসের বাড়িতে চড়াও হয়, তাদের কথাবার্তা থেকেই পরিষ্কার, এরা রীতিমত আনিসের গতিবিধির ওপর নজর রাখছিল। আনিসের বাবা যখন পুলিশ ভেবে এনাদেরকে জানায়, আনিস জলসা দেখতে গেছে, তখন তারা উত্তর দেয় যে, আধঘন্টা আগে আনিস কে তারা বাড়িতে ঢুকতে দেখেছে।

এমনকি এরা দুষ্কৃতী না পুলিশ এ নিয়েও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। এর পিছনে মূলতঃ দুটি কারণ রয়েছে।

এক, আনিসের বাবা জানিয়েছিলেন চারজনের মধ্যে তিনজন ছিলেন সিভিক পুলিশ, কিন্তু একজন ছিলেন উর্দিধারী পুলিশ এবং তাঁর কাঁধে বন্দুক ছিল। যে রাইফেলের বর্ণনা তিনি দিয়েছেন তা কেবলমাত্র পুলিশের থাকে।

দুই, খুন করে পালাবার সময় সিভিক পুলিশের পোশাকে থাকা তিনজন, রাইফেল কাঁধে উর্দিধারী পুলিশের বেশে আসা চতুর্থ জনকে বলে “স্যার চলুন। কাজ হয়ে গেছে।” এখন সমাজবিরোধীরা বা দুষ্কৃতীরা কি একে অপরকে “স্যার” বলে। এটা তো শুনে মনে হচ্ছে অনেকটাই পুলিশের ভাষা। সিভিক পুলিশের কর্মীরা থানার উর্দিধারীদের স্যার বলেন এতো আমরা সবাই জানি।

কাজেই হত্যার পিছনে পুলিশ-যোগের কথা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

আবার গতকালকের প্রতিবেদনেই আমরা জানিয়েছিলাম, শহীদ আনিস খান যে শুধু বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের সাথে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত ছিল তাই নয়, আমতা এলাকায় নানা সামাজিক কাজকর্মের সাথেও সে যুক্ত ছিল। এই সূত্রেই গত বছর মে মাসে একটি রক্তদান শিবিরের আয়োজনকে কেন্দ্র করে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের সাথে তার গোলমাল বাঁধে। তাঁকে প্রাণনাশের হুমকিও দেওয়া হয়। ফলে সে বাধ্য হয়ে গত বছরের মে মাসে ঐ স্থানীয় তৃণমূল নেতাদের বিরুদ্ধে লোকাল থানায় এফআইআর করে। ফলে শাসকদলের স্থানীয় নেতারাও এই হত্যাকান্ডে জড়িয়ে থাকতে পারেন।

মানে শাসকদল তৃণমূল অথবা স্বয়ং পুলিশ প্রশাসন এই হত্যাকান্ডের পিছনে জড়িত থাকতে পারে।

এদিকে দেখুন হাওড়া গ্রামীণের পুলিশ সুপার সৌম্য রায় হলেন সোনারপুর কেন্দ্রের তৃণমূল বিধায়িকা লাভলি মৈত্রের স্বামী। এদিকে এই সৌম্য রায়ের নেতৃত্বে এই কেসের তদন্ত করবার জন্য একজন ডেপুটি এবং একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে নিয়ে রাজ্য পুলিশের তরফে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। তাঁদেরকে সাহায্য করবে সিআইডি। এখন এমন তদন্তকারী দলের তদন্ত আদৌ কি নিরপেক্ষ হওয়া সম্ভব? প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা বজায় রাখতেই কিন্তু নির্বাচন কমিশন গত বিধানসভা ভোটের আগে সৌম্য রায়কে সুপার পদ থেকে সাময়িক ভাবে ভোট চলাকালীন সরিয়ে দেয়।

আমাদের মনে হয়েছে এমন একটি হত্যা যেখানে শাসক দল এর ঘনিষ্ঠ লোকজন জড়িত থাকবার সম্ভাবনা রয়েছে বা এমনকি যেখানে খোদ শাসকঘনিষ্ঠ উর্দিধারী পুলিশের লোকজন জড়িত থাকতে পারে বলে ইঙ্গিত রয়েছে, সেখানে একজন “তৃণমূল বিধায়িকার পুলিশ স্বামী” র নেতৃত্বে কতটা নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারে বা উর্দিপরা রাজ্য পুলিশের দলই বা কতটা নিরপেক্ষ তদন্ত করতে পারবে তা নিয়ে জনমানসে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।

এদিকে ইতিমধ্যেই পুলিশের তরফে নানা গাফিলতি সামনে আসতে শুরু করেছে।

পরিবারের দাবী মধ্যরাতে পুলিশকে ফোন করে খবর দিলেও, পুলিশ আসে রাত কাবার করে সকালবেলা সাড়ে আটটা-নটা নাগাদ। সে সময় পুলিশের আসল উদ্দেশ্য ছিল মূলত ময়নাতদন্তের নামে মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা। এমনকি মৃতদেহ ময়নাতদন্তর সময় পরিবারের কেউ উপস্থিত ছিল না বলে জানা যাচ্ছে, যা আদতে বাধ্যতামূলক। মানে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট-এর ক্ষেত্রে পক্ষপাতদুষ্ট রিপোর্ট আসতে পারে, যা আগামী দিনে তদন্তের পথ নির্দেশক। অর্থাৎ শুরুতেই গোজামিল দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি আনিসের বাবার বয়ান অনুযায়ী আনিস পড়বার সময় কোন আর্তনাদ করেনি। মানে উনি শুধু ভারী কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনেছিলেন।

তাহলে কি আনিসকে ছাদে মেরে ফেলে, তারপর ওপর থেকে ফেলা হয়! যাতে মনে হয় ছাদ থেকে পড়ে আস্বাভাবিক মৃত্যু! মানে আনিসকে মেরে ফেলবার পর ছাদ থেকে ফেলা হয়, নাকি ছাদ থেকে পড়ে আঘাতের ফলে সে মারা যায়, সেই সত্যিটা একমাত্র ময়নাতদন্তের রিপোর্টেই সামনে আসতে পারে। আর সেখানে গোঁজামিল দিলে আসল সত্যিটা সামনে আসবে না।

এমনকি আজ বেলার দিকে ফরেন্সিক দল আনিস খানের বাড়িতে যায়। তারাও সেভাবে পরিবারের লোকদের সাথে কথা বলেনি বলে অভিযোগ উঠছে।

এছাড়াও আনিস খানের বাবা নিজে ঐ চার আগন্তুককে দেখেছেন। কাজেই চিত্রশিল্পী এনে অপরাধীদের স্কেচ করলেও বোঝা যাবে কারা সম্ভাব্য অপরাধী। সেরকম কোন ব্যবস্থা পুলিশের তরফে নেওয়া হয়েছে বলে এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। কাজেই এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, কেন পুলিশ অপরাধীদের স্কেচ আঁকাচ্ছে না! তবে কি পুলিশের লোকজন জড়িত বলেই পুলিশ চাইছে না স্কেচ আঁকাতে! নাকি পুলিশ দুষ্কৃতীদের চেনে! তাই আড়াল করতে চাইছে!

এইসব নানা সংশয়ের কারণে পুলিশের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে পরিবারের। তাই তারাও সিবিআই তদন্ত দাবী করেছে।

আবার বামপন্থী দলগুলোর বক্তব্য সিআইডি বা সিবিআই কেউ নিরপেক্ষ নয়। এরা সবাই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট। চিট ফান্ড কান্ড বা নারদ স্টিং অপারেশন নিয়ে সিবিআই তদন্তের অগ্রগতি আদৌ সন্তোষজনক নয়। প্রকৃত দোষীরা এখনও আমার আপনার নাকের ডগায় জনপ্রতিনিধি বা মন্ত্রী হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাই বামদল গুলির দাবী বিচারবিভাগীয় তদন্ত বা আদালতের নজরদারিতে তদন্ত হোক।

ফিরহাদ হাকিমের কনভয় ঘিরে ইসলামপুরে বিক্ষোভ

আজ দুপুরে বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের নেতৃত্বের উপস্থিতিতে আমতা থানা ঘেরাও করা হয়। উপস্থিত ছিলেন দিপ্সীতা ধর, প্রতীকুর রহমান, ময়ুখ বিশ্বাসদের মত বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই-এর প্রথম সারির নেতৃত্ব।

আগামীকাল অর্থাৎ ২১ শে ফেব্রুয়ারী ধর্মতলা থেকে মহাজাতি সদন পর্যন্ত আনিস হত্যার প্রতিবাদে এবং নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষীদের শাস্তির দাবীতে মিছিল রয়েছে। মিছিলে বামপন্থীরা তো থাকবেনই। কারণ আনিস তাঁদের ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন। উদ্যোক্তাদের তরফে সমস্ত সচেতন নাগরিকদের মিছিলে পা মেলাবার আবেদন জানানো হয়েছে। এমনকি ২২ শে ফেব্রুয়ারীও আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনের তরফে কিছু কর্মসূচী নেওয়া হচ্ছে বলে খবর রয়েছে।

আপাতত এই পর্যন্ত।

আমাদের কলম চলবে। নজর থাকবে এই খবরে। মূলস্রোতের সংবাদ মাধ্যম গুলিতে অন্যান্য খবর দেখিয়ে নজর ঘোরানোর চেষ্টা হলেও, আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস থাকব আপনাদের পাশে আপনাদের সাথে । আপনাদের কন্ঠই আমাদের কলম।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস