আনিস হত্যাকান্ড : প্রশাসন কেন মরিয়া? দিশেহারা? / Confused Administration! But Why?

সোমবার সারাদিন ধরে আনিস খান হত্যাকান্ড নিয়ে কলকাতা শহর জুড়ে প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেছে। এরমধ্যে বিকেলবেলা, মূলতঃ বামপন্থীদের উদ্যোগে ধর্মতলা থেকে মহাজাতি সদন পর্যন্ত নাগরিক সমাজের বিশাল মিছিল ছিল শহরের সবথেকে বড় প্রতিবাদ কর্মসূচী। এছাড়াও বেলার দিকে ছাত্র পরিষদের তরফেও বিক্ষোভ সমাবেশের আয়োজন করা হয়, যাকে কেন্দ্র করে এন্টালিতে পুলিশের সাথে ছাত্র পরিষদ সমর্থকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন।

সরকারের তরফে উলুবেড়িয়া দক্ষিণের বিধায়ক এবং জনস্বাস্থ্যমন্ত্রী পুলক রায় আমতায় আনিসের বাড়িতে যান। পরিবারকে পুলিশের তরফে নিরপেক্ষ তদন্ত হবে আশ্বাস দেন। সন্ধ্যের দিকে পরিবারের সাথে দেখা করতে যান সিপিআই(এম) নেত্রী মীনাক্ষী মুখার্জ্জী এবং রাজ্য এসএফআই সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য। এছাড়াও বামপন্থী মহিলা সংগঠন গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির তরফে পরিবারের সাথে দেখা করে সমবেদনা জানাতে যান সংগঠনের রাজ্য সম্পাদিকা কণিনীকা ঘোষ বোসের নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল। এদিকে কলকাতা হাইকোর্টও আনিস কান্ডে আইনজীবী কৌস্তব বাগচীর আবেদনে সাড়া দিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আগামী কালের মধ্যে রাজ্যের কাছে রিপোর্ট তলব করেছে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজ প্রথম আনিস কান্ডে মুখ খুলেছেন এবং আনিস হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য রাজ্য পুলিশের বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট গঠন করে ১৫ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এদিকে আনিসের পরিবারের তরফে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি পূর্ণ আস্থা থাকলেও রাজ্য পুলিশের প্রতি তাদের কোন আস্থা নেই। ফলে সিটের সাথে আনিসের পরিবার তদন্তে আদৌ সহযোগিতা করবেন কি না, প্রশ্ন উঠছে তাই নিয়ে। পরিবার চায় সিবিআই তদন্ত হোক। এমনকি আনিসের বাবা শারীরিক অসুস্থতার কারণে মুখ্যমন্ত্রীর আমন্ত্রনে নবান্নে যেতে আস্বীকার করেন।

চুম্বকে এই ছিল আনিস কান্ডে সোমবারের সাত-সতেরো।

কিন্তু এসবের মধ্যেও আমরা রাইজ ভয়েসেস দু-তিনটি ঘটনার ওপর দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। এই ঘটনাগুলি আমাদের কিছুটা অসঙ্গত এবং মানানসই নয় বলে মনে হয়েছে।

আজ সমাজ মাধ্যমে একটি ভিডিও ঘুরছে। যেখানে আনিসের বাবা অভিযোগ করছেন মুখ্যমন্ত্রীর আপ্ত-সহায়ক বা পিএ-র পরিচয় দিয়ে গতকাল রাত বারোটার পর জনৈক ব্যক্তি আনিসের পরিবারের সাথে দেখা করতে যান। তিনি সরকারের তরফে মোটা টাকা ক্ষতিপূরণ এবং পরিবারের একজনকে সরকারী চাকরির প্রস্তাব দেন। অন্যদিকে অপর একটি সূত্রে জানা যাচ্ছে, সেই ব্যক্তি আদৌ মুখ্যমন্ত্রীর আপ্ত সহায়ক নন। তিনি হলেন শাসক ঘনিষ্ঠ একটি বহুল প্রচারিত টিভি চ্যানেলের মালিক। উনি প্রায় একঘন্টা সেখানে ছিলেন। এমনকি আনিসের বাবার দাবী ঐ ব্যক্তিই বিভিন্ন নম্বরে ফোন করে আনিসের বাড়ির সামনে পুলিশ মোতায়েনের ব্যবস্থা করেন। যদিও আনিসের বাবা চাকরি ও ক্ষতিপূরণের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন বলে জানিয়েছেন সেই ভিডিওতে।

এখন এক গভীর রাতে আনিসকে পুলিশের বেশে, হয় পুলিশ বা অন্য কেউ খুন করে পালাল। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে সরকারের সর্ব্বোচ্চ স্তর থেকে দিনের আলোয় না গিয়ে রাতের অন্ধকারে এমন পেছনের দরজা দিয়ে মিটমাট করবার কৌশল অবলম্বন করতে হচ্ছে কেন? কি এমন সত্যি রয়েছে আনিস খুনের পিছনে? আর মুখ্যমন্ত্রীর পিএ বা আপ্ত সহায়কের পরিচয় দিয়ে কে গেছিলেন আনিসের পরিবারে কথা বলতে? সত্যি আপ্ত সহায়ক মহাশয় গিয়েছিলেন নাকি অন্য কেউ!

এমন প্রস্তাব নিয়ে সরকারের তরফে দিনের আলোতে আমাদের মাননীয় জনস্বাস্থ্য মন্ত্রী পুলক রায় মহাশয় বা মন্ত্রীসভার অন্য কেউ এলে, আরও অনেক বেশি সৌজন্যমূলক এবং গ্রহণযোগ্য হত বলে আমাদের মনে হয়েছে।

এবার আসি আরেকটি ঘটনার কথায়। আজ স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নবান্নে সাংবাদিকদের সামনে বসে দাবি করেছেন আনিস নাকি ছিলেন ওনাদের “ফেভারিট”! ভোটের সময় তৃণমূলকে নাকি আনিস সাহায্যও করেছেন! অন্যদিকে হাওড়া গ্রামীণের পুলিশ সুপার সৌম্য রায় সাংবাদিকদের জানাচ্ছেন, আনিস খানের বিরুদ্ধে নাকি থানায় পকসো আইনে শিশুদের যৌন নির্যাতন করবার অভিযোগ ছিল।

আমরা রাইজ অফ ভয়েসেস মনে করি এই অভিযোগেরও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। কারণ মুখ্যমন্ত্রী এবং তার দলের “ফেভারিট”, একজন এমন একটি নক্কারজনক কাজের সাথে যুক্ত – ভাবতে ভালো লাগে না। আর যদি এই মামলাটি ভুয়ো এবং নিতান্তই আনিসের এবং বিরোধীদের চরিত্রহননের উদ্দেশ্যে শাসক দলের তরফে রুজু করা হয়ে থাকে প্রমাণিত হয় (যা রাজ্যের বিরোধীদলগুলি হামেশাই অভিযোগ করে থাকে) তাহলে কিন্তু তা শাসকের পক্ষে নিতান্তই লজ্জাজনক হবে।

আর সবশেষে এখন আমরা প্রায় সবাই জানি হাওড়া গ্রামীনের পুলিশ সুপার সৌম্য রায় সোনারপুর দক্ষিণের তৃণমূল বিধায়িকা লাভলি মৈত্রের স্বামী। আর আনিস হত্যাকান্ডে এই নিয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট করায় জনৈক এসএফআই সদস্যকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আজ বিকেলের দিকে। কেউ কেউ বলছেন বামপন্থী নেতৃবৃন্দ পরে ওই এসএফআই সদস্যকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছেন। এর সত্যতা আমরা এখনো যাচাই করে উঠতে পারিনি। রাইজ অফ ভয়েসেস এর তরফে প্রশাসনকে অনুরোধ কুরুচিকর পোস্ট হলে অবশ্যই গ্রেপ্তার করবেন। তা নাহলে অযথা ফেসবুক ট্যুইটারে পুলিশগিরি করে সময় নষ্ট করবেন না। এতে বিতর্ক বাড়বে। বরং তারচেয়ে আনিসের হত্যাকারীদের খুঁজুন! কারণ খুনের প্রত্যক্ষদর্শী আনিসের পরিবারের লোকদের মতে সেই খুনীরা কিন্তু পুলিশের ইউনিফর্মে ছিল! আপনাদের উর্দির খাঁকিকে আমরা সম্মান করি। সম্মানটা রাখুন।

ওপরের এই তিনটে ঘটনাতেই পুলিশ প্রশাসন থেকে সরকারের ওপর মহলের মরিয়া -দিশেহারা ভাবটা কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে এবং জনমানসে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই মুহুর্তে আনিসের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থা ফেরানোটা জরুরি।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্রঃ
a) https://youtu.be/NI4aPMwuVaI
b) https://youtu.be/CrajfIUh48U
c) https://www.anandabazar.com/west-bengal/howrah-hooghly/mamata-banerjee-announces-fair-investigation-on-anis-khans-death-dgtld/cid/1330074
d) https://zeenews.india.com/bengali/state/anis-khan-death-case-on-pocso-act-filed-against-anis-khan-said-howrah-rural-police-super_422485.html