হে মৃতদেহ! তুমি কে? / Who Are You?

আনিস খান হত্যাকান্ডের বিচার চাইতে এই মুহুর্তে রাজ্য তোলপাড়।

কিন্তু আনিস খান, তুমি ঠিক কে, তোমার জীবদ্দশায় হয়তো এই প্রশ্নের উত্তর তোমাকে দিতে হয়নি। কিন্তু খুন হয়ে যাওয়ার পর বারে বারে এই প্রশ্ন উঠছে। তারা বারে বারে জিজ্ঞাসা করছে, হে মৃতদেহ তুমি কে? কি তোমার পরিচয়? তুমি কি মানুষ?

এই বাংলার অধিকাংশ মানুষ আজ বলতে পারে না, “একটা মানুষ খুন হয়েছে।”

আর গনতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়াই যে নিয়ম। তাই তুমি আজ শুধু মানুষ নও। তোমার মৃতদেহকে সামনে রেখে খোঁজা হচ্ছে তুমি কে! যতটা আগ্রহ নিয়ে তোমাকে খোঁজা হচ্ছে, ততটা আগ্রহ নিয়ে সমাজের একটা অংশ তোমার খুনীকে খুঁজতে আগ্রহী নয়।

তাদের বক্তব্য খুন তো কতই হয়! সব খুনী কি ধরা পড়ে! তাহলে এত লাফালাফি কেন! দুদিন গেলেই ভিড় পাতলা হয়ে যাবে ! যত্তসব পার্টি-পলিটিক্স !

মানে তাদের মোটামুটি বক্তব্য হল, এই যে মাঝরাত্তিরে চারজন পুলিশ ইউনিফর্মে তোমার বাড়িতে ঢুকে, তোমারই বাড়ির তিনতলার ছাদ থেকে, তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে খুন করে দিয়ে “কাজ হয়ে গেছে, চলুন স্যার” বলে বেরিয়ে গেল, এতে এত হইচই কিসের!

এই ঘটনার পর পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও, এই যে তোমার মৃতদেহের সঠিক ময়নাতদন্ত করা হয়নি বলে জানা গেল অথবা এই যে লোকাল থানার ওসি থেকে জেলার এসপি মায় রাজ্য পুলিশের ডিজিও বুক ঠুকে বলতে পারছেন না, না কোন পুলিশ তোমাকে খুন করেনি, তাই নিয়ে সারা শহর উত্তাল করে আকাশ পাতাল এক করে প্রতিবাদ করা কি আদৌ ঠিক হচ্ছে!

তুমি সিএএ-এনআরসি’র প্রতিবাদী মুখ। তুমি তোমার পাড়ায় রক্তদান শিবির আয়োজনের একজন মাথা। তুমি হলে তোমার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের দাবি দাওয়া আদায়ের আন্দোলনে সামনের সারির একজন। মানে তুমি একজন সমাজ সচেতন শিক্ষিত তরতাজা তরুণ! তাও তোমার খুনের ঘটনাটা নিয়ে এতটা বাড়াবাড়ি বোধহয় মানায় না। এমনকি এভাবে শহর জুড়ে প্রতিবাদ মিছিল অবরোধ চলতে থাকলে নাকি কাজকর্ম ব্যবসা বাণিজ্য লাটে উঠে যাবে, এমন মতামতও চোখে পড়ছে।

মানে “ফেবারিট” মন্ত্রীসভার দুর্নীতিগ্রস্ত সহকর্মীদের জন্য মহামারীর মধ্যেও, সমস্ত স্বাস্থ্য বিধি-নিষেধের তোয়াক্কা না করে লোকজড়ো করে নিজাম প্যালেসের সামনের রাস্তা চার-পাঁচ ঘন্টার জন্য অবরুদ্ধ করা যেতেই পারে!

কিন্তু পুলিশের উর্দি পরা চারজন একজন তরতাজা শিক্ষিত তরুণকে, তার বাড়িতে ঢুকে তারই বাড়ির ছাদ থেকে ধাক্কা মেড়ে ফেলে পালিয়ে গেলেও, এতটা উত্তেজিত হয়ে না পড়াই বাঞ্ছনীয়। এমনটাই মত সমাজের একটা অংশের।

কিন্তু প্রথমটায় তারা ঝেড়ে কাশেনি! প্রথমে বলা হচ্ছিল “ফুটকি বাম” / “শূন্য বাম” একটা মৃতদেহ পেয়ে রাজনীতি করছে। কারণ ইতিমধ্যে তোমার সমাজ মাধ্যমের অ্যাকাউন্ট থেকে করা বিভিন্ন পোস্ট এবং তোমার বাবা দ্ব্যর্থহীন ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তুমি এবং তোমার পরিবার ঘোষিত বামপন্থী। কিন্তু তাতেও প্রতিবাদের কলেবর উত্তরোত্তর বাড়ছে দেখে শেষমেশ তারা আর উপায় না দেখে ঝেড়ে কাশলেন! বললেন তুমি মুসলমান তাই তোমায় নিয়ে এত বাড়াবাড়ি! তোমার মৃতদেহের দখলদারি নিয়ে এত কারাকারি! রাজনীতি তোমার কতটা “ফেভারিট” ছিল আর তুমি কাদের ফেভারিট ছিলে সেটা তোমার বামঘেঁষা ফেসবুক পোস্ট দেখলেই বোঝা যায়!

কিন্তু তোমাকে মুসলমান বানিয়ে ফেলবার রাজনীতিটা রাইজ অফ ভয়েসেস এর মোটেই ফেভারিট লাগেনি। তাই আজ লিখতে বসা। লিখতে বসা সেইসমস্ত আমাদের জন্য যাঁরা তোমার মৃতদেহের ধর্ম খুঁজে বার করলেন।

শুরুতেই তাঁদেরকে একবার বলবো বিশিষ্ট অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রের “জলজ্যান্ত খুন” শিরনামে যে লেখাটি গতকাল থেকে সমাজ মাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে সেটিতে চোখ বোলাতে। আমরা সেটিকে তথ্যসূত্রে হুবহু তুলে দিয়েছি। তাতে রয়েছে ২০১১ সালে পালাবদলের পর থেকে এই বাংলার বুকে ঘটে যাওয়া একেরপর এক রাজনৈতিক খুনের একটি তালিকার যার সুবিচার আজও হয়নি। যদিও ওনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে তৈরি করা এই তালিকাটি অসম্পূর্ণ। আমরা নিশ্চিত এর বাইরেও আরও এমন বহু উদাহরণ খুঁজলে পাওয়া যাবে। এই তালিকায় হিন্দু আছে্ন। আছেন মুসলিম। আছেন মতুয়া। রয়েছেন সুবিচার না পাওয়া আদিবাসী, তফশিলি জাতি ও উপজাতির মানুষ। আছে উত্তরবঙ্গ, আছে দক্ষিণবঙ্গ। আছে রাঢ়বঙ্গ, আছে সুন্দরবন।

কিন্তু আমরা কজন এই খুনগুলির বিরুদ্ধে সুবিচার চেয়ে সোচ্চার হয়েছি! সেকি নিছকই বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে, তাই নিজেদের সংযত রেখেছি নাকি শাসকের (কেন্দ্র হোক অথবা রাজ্য) আনুগত্যে বাঁচবো বলে লেজ গুটিয়ে পালিয়েছি।

ঐ তালিকায় যে সমস্ত তথাকথিত “হিন্দু” মৃতদেহ গুলি আছে তাদের অনেককে নিয়েও কিন্তু “ফুটকি বাম” বা “শূন্য বাম”রা প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিল। উদাহরণ-সুদীপ্ত গুপ্ত, কমল গায়েন বা প্রদীপ তা, যেগুলি তৎকালীন সংবাদ মাধ্যমও প্রচার করেছিল। কিন্তু এই আমরা যারা আনিসের মৃতদেহকে মুসলমান বলে দাগিয়ে দিলাম কিন্তু সারিসারি “হিন্দু মৃতদেহ” দেখেও “সাতে-পাঁচে থাকি না” স্ট্যান্ড নিয়ে বিগত এক দশক দরজায় খিল এঁটে বসে রইলাম, একবার ফিরেও তাকালাম না সেগুলির দিকে, তারা নিজেদের আখের গুছিয়ে নিতে কাদের কাছে বন্ধক রাখলাম নিজেদের শিরদাঁড়াটা!

কাজেই যারা প্রতিবাদ করছে, করতে দিন। ধর্মের জিগির তুলে তাদের গালমন্দ করতে যাবেন না। এভাবে নিজেদের অমেরুদণ্ডী আপসকামী চরিত্রকে লুকিয়ে ফেলা যায় না। ভারতের সংখ্যালঘু আসলে ভারতীয়রা, রাজনৈতিক মেরুকরনের ওষুধে সংখ্যাগরিষ্ঠরা নিজেদের হিন্দু, মুসলমান বলতেই আজ বেশি স্বচ্ছন্দ। এর থেকে বেরিয়ে এসে বরং সোচ্চারে বলুন আনিস খান এর খুন নিন্দনীয়। খুনের পর পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও তার খুনের কিনারা করতে না-পারাটা পুলিশি ব্যর্থতা!

সেই সঙ্গে মৃতদেহর ধর্ম না খুঁজে উত্তর খোঁজবার চেষ্টা করুন নীচের প্রশ্ন গুলির।

● কেন মৃতদেহর দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের প্রয়োজন পড়ছে!

● প্রথমবারের ময়না তদন্ত কেন নিয়ম মাফিক হয় নি? সেকি নিছকই পদ্ধতিগত ভুল নাকি অপরাধ আড়ালের চেষ্টা হয়েছিল?

● হত্যাক্যান্ডের পর পাঁচদিন পেরিয়ে গেলেও পুলিশ কেন বলতে পারছে না, পুলিশের কেউ এই হত্যাকান্ডে জড়িত কি না?

● সেদিন রাতে আনিসের বাড়িতে পুলিশই গিয়েছিল নাকি পুলিশের ছদ্মবেশে গিয়েছিল অন্যকেউ?

● রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিনিধি হয়ে মাঝরাতে কে গেলেন আনিসের পরিবারের কাছে?

● আনিসের বাবা ঘটনার জীবিত প্রত্যক্ষদর্শী। তাহলে কেন তাঁকে দিয়ে অপরাধীদের স্কেচ করানো হচ্ছে না?

● কেনই বা আমতা থানা বা বাগনান থানার সমস্ত পুলিশ কর্মীর ছবি এনে আনিসের বাবা কে দেখানো হচ্ছে না!

● আর আজ যে দুজন পুলিশকর্মীদের গ্রেপ্তার করবার খবর সংবাদ মাধ্যমের সামনে আনা হয়েছে সেই দুজনকে কি আনিসের বাবা সনাক্ত করতে পেরেছেন? এরা কি আদৌ সেদিন অকুস্থলে উপস্থিত ছিলেন! প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি গ্রেপ্তার হওয়া হোমগার্ড কাশীনাথ বেরার স্ত্রীর অভিযোগ, তাঁর স্বামীকে ফাঁসানো হচ্ছে। তিনিও সিবিআই তদন্ত চাইছেন! তাঁর দাবি উঁচুতলার লোকদের বাঁচাতে নীচুতলার লোকদের বলির পাঁঠা করা হচ্ছে।

এছাড়াও আরও অনেক প্রশ্নই হয়তো অনেক পাঠকের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে । সেগুলিও জানান আমাদের!

আর সবশেষে জানাই মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন “রাস্তা আটকে আন্দোলন বরদাস্ত করবেন না।”

কাজেই বুঝতে পারছেন ওপরের “বাড়াবাড়ি” কাদের পছন্দ নয়!

দুগগা দুগগা।

চলি।

ধন্যবাদান্তে
রাইজ অফ ভয়েসেস

তথ্যসূত্র

অম্বিকেশ মহাপাত্রের পোষ্ট থেকে পাওয়া তালিকা:

● তপন দত্ত (বালি, ০৬.০৫.১১) ● সেখ জিয়া (সিউড়ি, ০১.০৯.১১) ● প্রদীপ তা ও কমল গায়েন (বর্ধমান, ২২.০২.১২) ● বরুণ বিশ্বাস (গাইঘাটা, ০৫.০৭.১২) ● কাজী নাসিরুদ্দিন (ধনেখালি, ১৪.০১.১৩) ● তাপস চৌধুরী (গার্ডেনরীচ, ১২.০২.১৩) ● সুদীপ্ত গুপ্ত (সোনারপুর, ০২.০৪.১৩) ● শিপ্রা ঘোষ (শাসন, ০৭.০৬.১৩) ● সাগর ঘোষ (পাড়ুই, ২১.০৭.১৩) ● স্বপ্নাকুমারী ঝা (মধ্যমগ্রাম, ৩১.১২.১৩) ● সাইফুদ্দিন মোল্লা (বারুইপুর, ১৯.০১.১৪) ● সেখ হীরালাল (সিউড়ি, ১৮.০৪.১৪) ● আশমিরা বেগম (কেতুগ্রাম, ২১.০৫.১৪) ● সুমিত নাহা (রাজারহাট, ২৩.০৬.১৪) ● সৌরভ চৌধুরী (দত্তপুকুর, ০৫.০৭.১৪) ● অমিত চক্রবর্তী (চুচুড়া, ২৮.০৭.১৪) ● দীপালি গিরি (কাঁথি, ১৮.০৮.১৪) ● হিমানী বর্মণ (ধূপগুড়ি, ০২.০৯.১৪) ● কোরপান শাহ (উলুবেড়িয়া, ১৬.১১.১৪) ● হীরেন্দ্রনাথ ঘোষ (বোলপুর, ০১.১২.১৪) ● সীমা সরকার (ধূপগুড়ি, ২০.১২.১৪) ● অরূপ ভান্ডারী (সালকিয়া, ০৩.০২.১৫) ● সঞ্জয় দাস (বীজপুর, ২০.০৯.১৫) ● রাণু বিশ্বাস (কাকদ্বীপ, ২০.১১.১৫) ● কৌশিক পুরকাইত (মন্দিরবাজার, ০৯.০৫.১৬) ● নরোত্তম মন্ডল (হারুড পয়েন্ট কোস্টাল, ২০.০৭.১৬) ● সেখ নজরুল ইসলাম (মেটিয়াব্রুজ, ২৯.০৭.১৬) ● মিতা দাস মন্ডল (উলুবেড়িয়া, ১১.১০.১৬) ● সুশান্ত হালদার (কুলতলি, ১৩.১২.১৬) ● আরতি গুড়ে (মথুরাপুর, ০৭.০১.১৭) ● মহম্মদ মফিজুল খান ও আলমগীর মোল্লা (কাশীপুর, ১৭.০১.১৭) ● হারুন মীর (ক্যানিং, ০৫.০৩.১৭) ● স্নেহাশিস দাশগুপ্ত (শ্রীরামপুর, ২৯.০৯.১৭) ● রিয়াজুল মোল্লা ও হাসান লস্কর (বাসন্তী, ১৮.০১.১৮) ● হাফিজুর রহমান মোল্লা (কাশীপুর, ১১.০৫.১৮) ● পুতুল পাল (চন্দননগর, ১২.০৫.১৮) ● রুবিয়া খাতুন (পারুলিয়া কোস্টাল, ১২.০৭.১৮) ● দেবাশিস হালদার (রায়দিঘী, ৩১.০৭.১৮) ● মণিকা মাহাতো (বোরো, ১০.০৫.১৯) ● লক্ষী ধাড়া (ডোমজুড়, ২৭.১০.১৯) ● সীমা দত্ত (বাগনান, ২৪.০৬.২০) ● ম‌ইদুল ইসলাম মিদ্যা (কোতুলপুর, ১৫.০২.২১) ● ….

খুনিরা সাজা পেয়েছে? না। কোনদিন পাবে? ভবিষ্যৎ বলবে।

জলজ্যান্ত খুন আনিশ খান (আমতা, ১৮.০২.২২); ৫ দিন অতিক্রান্ত হতে চলেছে। দুজন গ্রেপ্তার হলেও এরাই মূল অপরাধী কি না পুলিশের তরফে এখনও খোলসা করা হয়নি।