উৎসবের ট্রেন্ড / The Trend

আগামী ২৭ শে ফেব্রুয়ারি রাজ্যের ১০৮ টি পৌরসভায় উৎসব। আর এই উৎসব থেকেই নির্বাচিত হবেন জনপ্রতিনিধিরা।

আর কারা জনপ্রতিনিধি হিসেবে অগ্রগণ্য বলে বিবেচিত হন? ইন্সট্যান্ট উত্তর একটাই, যাকে পাড়ায় সবচেয়ে বেশি মানুষ ভয় পায়, তিনি। অবাক হলেন? না, না, অবাক হওয়ার কিছু নেই। এটাই তো হয়ে আসছে। এটাই ট্রেন্ড।

তারপরেও রাস্তা ঘাটে মানুষ জন কেন যে মাথা চাপাড়ান, তা বোঝা যায় না। আক্ষেপ শোনা যায়, আজকাল ভালো প্রার্থী পাওয়া না।

সত্যি কি পাওয়া যায় না? সৎ, শিক্ষিত, চরিত্রবান, আদর্শবাদী ও সমাজসেবার মানসিকতাসম্পন্ন যোগ্য মানুষ জনপ্রতিনিধি হিসেবে কি আপানার ওয়ার্ডে পুর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন না? হয়তো করেন না। তাই ভোটের ফল বেরোনোর পর দেখা যায়, সুখে-দুঃখে জনগণের পাশে যাদের পাওয়া যায়, তারাই বিপুল সংখ্যক ভোটে পরাজিত হয়েছে। এটাই ট্রেন্ড। আর এই ট্রেন্ড সেট করার দায় শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর হতে পারে কি?

আপনার আমার মত সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা আত্মসাৎ করে, যারা নিজের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বৃদ্ধি করে, যারা ছোট খাটো কাজের জন্যে কাটমানি নেয়, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য এ দলের ও দলের পায়ে ধরে, ক্ষমতায় আসার পর যাদের আর দেখা পাওয়া যায় না, তাদেরকেই ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে মানুষরা চায়। এই মুহুর্তে এটাই ট্রেন্ড।

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। এসব বইতে লেখা থাকে আর বইতেই ভালো লাগে। কারণ এই রাজ্যে ভোট তো ৩০ টাকা থেকে এক প্লেট বিরিয়ানিতে বিক্রি হয়। অনেকের ক্ষেত্রে আবার সেটুকুও লাগে না, নির্বাচনে বাহুবলী প্রার্থী থাকলে, তিনি আবার এমনি এমনিই বিজয়ী হয়ে যান। ট্রেন্ড তো এমনই সেট হয়েছে।

আবার এটাও দেখা যায়, অনেক জনপ্রতিনিধি সেবার পরিবর্তে নিজের ব্যবসার জন্য নির্বাচনে প্রার্থী হন। তারপর তিনি জিতেও যান। আর নির্বাচিত হয়ে জনসেবার কথা না ভেবে, ওয়ার্ডের মানুষের প্রাপ্য পরিষেবার টাকা দিয়ে নিজের ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নয়ন করেন। মাঝে মধ্যে একটু ড্রেন পরিষ্কার, রাস্তায় তাপ্পি মারলেই কেল্লা ফতে। মানুষ বলবে, দেখো দেখো নিজে ভালোই কামাচ্ছে কিন্তু পাড়ায় কাজও করছে, ভালো ক্যান্ডিডেট, কাজের ছেলে। এটাই ট্রেন্ড।

আর যদি জনপ্রতিনিধি প্রমোটার হন, তাহলে তো কথাই নেই, প্রথমে রাস্তা আপনার বাড়ির চেয়ে উচু হবে, যদি আপনার পকেটে পয়সা থাকে আপনার তবে বাড়ির মেঝে উচু করবেন। আর তা না পারলে, প্রমোটার জনপ্রতিনিধিকেই বলবেন, একটা টু বিএইচকে ফ্ল্যাট পেয়ে যাবেন আপনার জমির ওপর। কিন্তু মাথা কুটে মরে গেলেও, বর্ষা কালে আপনার পাড়ায় জমা জল সরানোর জন্যে পাম্প বসবে না। দিস ইজ দ্যা ট্রেন্ড।

পৌরসভায় জনপ্রতিনিধি থাকে ওয়ার্ডের মানুষের সাথে আলোচনা করে যথাযথ পরিষেবা দেওয়ার জন্যে। অথচ দেখা যায়, তারা জনগণের পক্ষে যতটা না কথা বলেন, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বক্তব্য বলেন। এই ট্রেন্ড সেট হয়েছে, মানুষ এটাই চাইছে বলে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের অনেক শর্ত থাকলেও প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, ক্রিমিনাল অ্যাক্টিভিটি নিয়ে কোনো শর্ত নেই। কারণ, এটা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।

একটি শিক্ষিত জাতি গঠন করার জন্য, দেশ, রাজ্য থেকে লোকসভা, বিধানসভা, পৌরসভা, ওয়ার্ড, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা উন্নত থেকে উন্নততর করার জন্য জনপ্রতিনিধিদের শিক্ষিত এবং সৎ হওয়া বাঞ্ছনীয় বলে বইয়ের পাতায় লেখা থাকে। কিন্তু এই সংজ্ঞা আমূলে বদলে গেছে। একইভাবে বদলে গেছে আদর্শ জনপ্রতিনিধির সংজ্ঞাও। সেটা কোন রাজনৈতিক দল বদলায়নি। বদলেছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ। এটাই ট্রেন্ড এখন।

আগে জনসেবার লক্ষ্য নিয়ে কিছু শিক্ষিত ও সৎ মানুষদের জনপ্রতিনিধি হতে যাও দেখা যেতো, এখন তা দূরবীন দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যায় না। এখন অবৈধ অর্থের মালিক, সন্ত্রাসী বা পেশিশক্তিতে বলীয়ান ব্যক্তিরাই জনপ্রতিনিধি বনে যাচ্ছেন। তাই নিজের মান-সম্মানের ভয় আছে, এমন কোনো ব্যক্তি এসব প্রার্থীর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা করারই সাহস পান না। আর কেউ সাহস করে দাঁড়ালেও তাকে মানুষজন তেমন একটা পাত্তা দেন না। ট্রেন্ড বলে কথা। তাই আজকাল জনপ্রতিনিধি সম্পর্কে মানুষের ধারণাই পাল্টে গেছে, তাই ফল যা হওয়ার সেটাই হচ্ছে।

“রাইজ অফ ভয়েসেস”-এর পক্ষ থেকে সব দলের কাছে আবেদন, দলীয় প্রার্থী বাছাই করার সময় তাদের সততা, দক্ষতা ও জনগণকে মূল্যায়নের সক্ষমতা বিবেচনায় আনবেন। সৎ ও আদর্শবান রাজনৈতিক নেতাকে নির্বাচনে প্রার্থী করা হলে জনগণের প্রকৃত ক্ষমতায়ন হবে-যার দরজা শুধু দলীয় নেতাকর্মীদের জন্য নয়, বরং সাধারণ মানুষের জন্যও খোলা থাকবে সারা বছর। যিনি রাজনৈতিক সহাবস্থানে বিশ্বাসী হবেন। দল মত নির্বিশেষে পাড়ার সব মানুষের কথা ভাববেন এবং একইসঙ্গে সৎ, যোগ্য এবং নিবেদিতপ্রাণ মানুষ হবেন। স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতিতে জড়িত কেউ বারে বারে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতে থাকলে সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

এই যে আমরা এত লেখালেখি করলাম, জানি এ দেখে সংখ্যাগরিষ্ঠ পাঠকের কিছু আসবে যাবে না। তবুও লিখতে তো হবেই। যে ট্রেন্ড তৈরি হয়ে আছে, তাকে তো ভাঙ্গতেই হবে। না হলে তো আমাদের সমাজেরই ক্ষতি।

পুনশ্চ: তবে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, করোনাকালে যারা তাদের নিকট পরিজনদের হারিয়েছেন, তারা যদি তাদের উপস্থিতি অনুভব করতে চান, তবে আপনার পাড়ার বুথের সামনে দাঁড়িয়ে থাকুন, দেখা পেলেও পেতে পারেন।

এবার হয়তো আপনারা বলবেন, এত জ্ঞানের কথা বলে, শেষে আজেবাজে কথা বললেন কেন? আসলে এটাই ট্রেন্ড, ওপরে যা যা বলেছি, যা যা চেয়েছি, আগামীকালের নির্বাচনে তার কিছুই হয়তো পাওয়া যাবে না। তবে শেষ অনুচ্ছেদের বক্তব্য সফল হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই বেশি। কারণ এটাই ট্রেন্ড।

ধন্যবাদান্তে,
রাইজ অফ ভয়েসেস